প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপে আবারও সচল বিশ্ববিদ্যালয়
2016.01.19
অবশেষে কাজে ফিরলেন বেতন কাঠামোর বৈষম্য নিয়ে আন্দোলনরত বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকরা। একটানা আটদিন বন্ধ থাকার পর শেষমেষ প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপেই গতি ফিরছে বাংলাদেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে। মঙ্গলবার সে ঘোষণাই দেন বাংলাদেশ শিক্ষক সমিতি ফেডারেশনের মহাসচিব এ এস এম মাকসুদ কামাল খান।
তবে এ আন্দোলনের মাধ্যমে দেশের সকল পর্যায়ের শিক্ষকদের দাবি স্পষ্ট হয়নি বলে অভিযোগ তুলেছেন সাধারণ শিক্ষকরা।
প্রায় নয় মাস আগে ঘোষণা করা অষ্টম বেতন কাঠামোতে মর্যাদার অবনমন, টাইম স্কেল ও সিলেকশন গ্রেড বাতিলের প্রতিবাদে দেশের ৩৭টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা আন্দোলন শুরু করেন। তাদের দাবি না মানায় গত আটদিন ধরে কর্মবিরতিতে নামেন তারা। ফলে পরীক্ষা গ্রহণ ছাড়া বাকি সকল কাজ বন্ধ হয়ে যায় বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে।
প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপেই সমাধান
গত ১১ জানুয়ারি থেকে কর্মবিরতিতে যাওয়া শিক্ষকদের কাজে ফেরাতে নানামুখী তৎপরতা চালায় সরকার। শিক্ষক নেতাদের সঙ্গে দফায় দফায় বৈঠকও চলে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়গুলোর। তাতেও যখন কাজে ফেরানো যাচ্ছিল না তখন আন্দোলনরত শিক্ষকদের ডাক দেন খোদ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। অবশেষে সরকার প্রধানের নিকট থেকে আশ্বাস পেয়েই ক্লাসে ফেরার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন তারা।
প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরের কাঙ্খিত ডাকে গত সোমবার (১৮ জানুয়ারি) বিকেলে গণভবনে শেখ হাসিনার সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন আন্দোলনরত শিক্ষক নেতারা। এদিন অন্যান্য শ্রেণি-পেশার মানুষকেও গণভবনে পিঠা উৎসবে দাওয়াত দেন প্রধানমন্ত্রী।
সে অনুষ্ঠানের ফাঁকেই শিক্ষক নেতাদের সঙ্গে বৈঠকে বসেন তিনি। বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি ফেডারেশনের সভাপতি ফরিদ উদ্দিন আহমেদ, মহাসচিব এ এস এম মাকসুদ কামালসহ বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের আটজন শিক্ষকনেতা এবং প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের মুখ্য সচিব আবুল কালাম আজাদ, জনপ্রশাসনসচিব কামাল আবদুল নাসের চৌধুরী ও অর্থসচিব মাহবুব আহমেদও দেড়ঘণ্টাব্যাপী ওই বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন।
বৈঠক শেষে প্রধানমন্ত্রীর প্রেস সচিব ইহসানুল করিম জানান, শিক্ষকদের সঙ্গে প্রধানমন্ত্রীর একটি অনানুষ্ঠানিক বৈঠক হয়। বৈঠকটি ফলপ্রসূ হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী আশ্বাস দিয়েছেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা যাতে গ্রেড-৩ থেকে গ্রেড-১ এ যেতে পারেন, তার সোপান তৈরি করা হবে। এছাড়া অন্য দাবিগুলো পর্যালোচনা করে পূরণ করা হবে।
বুধবার থেকেই ক্লাসে যোগদান
বুধবার থেকেই ক্লাসে যোগদানের ঘোষণা দিয়েছে আন্দোলনরত বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি ফেডারেশন। তবে সরকারের কোন প্রজ্ঞাপণে নয়, প্রধানমন্ত্রীর মৌখিক আশ্বাসের উপর নির্ভর করেই আন্দোলনে ইতি টেনেছেন তারা। প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাতের পরদিন মঙ্গলবার সন্ধ্যায় নিজেদের মধ্যে আলোচনা শেষে শিক্ষকদের পক্ষ থেকে সে ঘোষণা আসে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সামাজিক বিজ্ঞান ভবনের মুজাফফর আহমেদ চৌধুরী মিলনায়তনে প্রায় এক বৈঠকের পর ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক এ এস এম মাকসুদ কামাল সাংবাদিকদের বলেন, “প্রধানমন্ত্রী আমাদের আশ্বাস দিয়েছেন। তার কথায় আমাদের আস্থা রয়েছে। আপাতত কর্মবিরতি কর্মসূচি আমরা স্থগিত করেছি। বুধবার থেকে আবার আমরা ক্লাসে যাব।”
এর আগে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠক শেষে শিক্ষকরা বলেন, প্রধানমন্ত্রীর কাছে শিক্ষকদের দাবিগুলো উপস্থাপন করা হয়েছে এবং সেসব দাবির বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী খুব ইতিবাচক মনোভাব দেখিয়েছেন। তিনি নিজে আমাদের দাবিগুলো দেখে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ার আশ্বাস দিয়ে শিক্ষকদের ক্লাসে ফিরে যাওয়ার আহবান জানান।
আন্দোলন স্থগিত, প্রত্যাহার নয়
তবে আন্দোলন প্রত্যাহার করা হয়নি জানিয়ে মাকসুদ কামাল বলেন, আমাদের আন্দোলন প্রত্যাহার করে নেওয়া হয়নি। আন্দোলনেরই একটি অংশ হিসেবে চলমান আন্দোলন স্থগিত করা হয়েছে। আগামী ৩ ফেব্রুয়ারি ফেডারেশনের পর্যালোচনা সভা হবে। সেখানে অবস্থা পর্যালোচনা করে পরবর্তী করণীয় ঠিক করা হবে।
‘কূট-কৌশল মানব না’
তবে তবে দাবি মেটানোর ক্ষেত্রে কোন কূট-কৌশল অবলম্বন করা হলে তা মেনে নেবে না বলেও হুশিয়ারি উচ্চারণ করেছেন আন্দোলনরত শিক্ষকরা। শিক্ষক নেতা মাকসুদ এ বিষয়ে বলেন, “কোনো আমলাতান্ত্রিক জটিলতার কারণে বা কোনো কোনো আমলার কূট-কৌশলের কারণে দাবি-দাওয়া আদায়ের ক্ষেত্রে কোনো বিলম্ব হয় মেনে নেওয়া হবে না। এমনকি খণ্ডিতভাবে দাবি-দাওয়াগুলোকে মেনে নেওয়া হলেও পরবর্তী করণীয় সম্পর্কে পদক্ষেপ নেবো আমরা।”
তিনি বলেন, “আমাদের দাবিগুলো যে ন্যায্য, তা আমরা প্রধানমন্ত্রীকে বুঝাতে পেরেছি। সুতরাং খণ্ডিতভাবে দাবি মানা অথবা দাবি মানতে বিলম্ব শিক্ষক সমিতি ফেডারেশন মেনে নেবে না। এ ধরনের কোনো আমলাতান্ত্রিক জটিলতা বা তার সঙ্গে সংশ্লিষ্টদের বিষয়ে পরবর্তি সভা করে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।
শিক্ষক সমিতি ফেডারেশনকে সম্পৃক্ত করেই দাবিগুলোর নিষ্পত্তি করতে হবে বলে জানান তিনি।
এছাড়া আগামী ৩ ফেব্রুয়ারি ফেডারেশনের পর্যালোচনা সভা হবে। সেখানে অবস্থা পর্যালোচনা করে পরবর্তী করণীয় ঠিক করা হবে বলে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক ফেডারেশনের পক্ষ থেকে জানানো হয়।
‘আপামর শিক্ষকদের দাবি স্পষ্ট করতে ব্যর্থ এ আন্দোলন’
এদিকে শিক্ষকদের কাজে ফেরাতে প্রধানমন্ত্রীর হ্স্তক্ষেপ ও দাবি মেটাতে তাঁর প্রতিশ্রুতি ইতিবাচকভাবে দেখছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের সাধারণ শিক্ষকরা। তবে তারা বলছেন, এ আন্দোলনের মাধ্যমে দেশের আপামর শিক্ষকদের দাবি স্পষ্ট হয়নি। স্থান পায়নি শিক্ষকদের আলাদা পে-স্কেলের দাবিও। এমনকি আন্দোলনে দলানুগত্যের ছাপ পড়েছে বলেও অভিযোগ অনেকের।
এ বিষয়ে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের শিক্ষক রাজীব মীর বেনারকে বলেন, “যেকোন দাবি সরকার মানতে চায় না বলেই সেটা আন্দোলনে পরিণত হয়। শিক্ষকদের আন্দোলনে প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ ও আশ্বাসের মধ্য দিয়ে ‘আন্দোলন’ জিতল এবং সাধারণ শিক্ষকরা বাঁচলো। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক নেতৃত্ব কী ‘দাবি’ করলেন সেটা নিয়ে সংশয় রয়ে গেছে। তারা শিক্ষকদের স্বতন্ত্র পে-স্কেল কতটুকু চাইতে পেরেছেন, এই জায়গাটিতে যে সংকটটি তৈরি হয়েছে তার সমাধান হয়নি”।
তাছাড়া এই আন্দোলনে দীর্ঘদিনের উপনিবেশিক আনুগত্যের ছাপ বা দলানুগত্যের ছাপ পড়েছে উল্লেখ করে তিনি আরো বলেন, স্পষ্ট করে শিক্ষকদের মূল অবস্থান চাইতে পারিনি আমরা। প্রাইমারি থেকে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত সকল শিক্ষকদের জন্য পৃথক বেতন স্কেল চাইতে পারিনি। চেয়েছি শুধু বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের দাবি, সেখানে প্রধানমন্ত্রী আশ্বাস দিয়েছেন। তবে সে দাবি কীভাবে মেটাবেন তা এখনো স্পষ্ট নয়। যারা নেতৃত্ব দিয়েছেন তারাই বিষযটি পরিস্কার করবেন আশা করি।
শিক্ষকদের সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে এতদিন প্রধানমন্ত্রী বা অন্যান্য মন্ত্রীরা শিক্ষকদের নিয়ে যেসব অপমানসূচক কথা বলেছিলেন তার একটা মানসিক উপশম প্রধানমন্ত্রী দিয়েছেন বলেও মন্তব্য করেন রাজীব মীর।
শিক্ষকদের প্রস্তাব
এর আগে গত রোববার প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাতের জন্য শিক্ষাসচিবের কাছে লিখিত প্রস্তাব দেন শিক্ষকেরা। ওই প্রস্তাবে সরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত বিশ্ববিদ্যালয়ের মোট অধ্যাপকের মধ্য থেকে ৫ শতাংশকে ডিস্টিঙ্গুইশড (বিশিষ্ট বা সম্মানিত) অধ্যাপক করার প্রস্তাব রাখেন তারা। এসব পদের মূল বেতন জ্যেষ্ঠ সচিবের সমান হবে। পাশাপাশি আগের মতো মোট অধ্যাপকের মধ্য থেকে ২৫ শতাংশকে গ্রেড-১ করাসহ কিছু বিকল্প প্রস্তাবও দেন শিক্ষকরা।