বাংলাদেশ দূর্নীতি দমনে কোন সফলতা দেখাতে পারেনি, টি আই
2016.01.27
দুর্নীতি দমনে বাংলাদেশের তেমন কোন সফলতা নেই। গত বছরের পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করে তেমনটাই জানিয়েছে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল। তাদের পর্যবেক্ষণের সঙ্গে একমত হয়েছেন সরকারের অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত। দুর্নীতিতে বাংলাদেশের তেমন কোন অগ্রগতি হয়নি বলে স্বীকার করেছেন তিনি।
বার্লিনভিত্তিক দুর্নীতিবিরোধী এই সংস্থাটির প্রকাশিত ‘দুর্নীতির ধারণাসূচক’ (সিপিআই) ২০১৫ বলছে, বিশ্বের সবচেয়ে দুর্নীতিগ্রস্ত দেশগুলোর মধ্যে ১৩তম অবস্থানে রয়েছে বাংলাদেশ। ২০১৪ সালে ছিল ১৪তম স্থানে। এ বছর অবস্থানের দিক থেকে বাংলাদেশের একধাপ অবনমন ঘটেছে, তবে স্কোর গতবছরের সমানই।
বুধবার সকালে নিজ কার্যালয়ে এই প্রতিবেদন আনুষ্ঠানিকভাবে প্রকাশ করে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)।
টিআইবি বলছে, বৈশ্বিক গড় স্কোরের তুলনায় বাংলাদেশের এ স্কোর অত্যন্ত কম। বাংলাদেশ দূর্নীতি দমনে কোন সফলতা দেখাতে পারেনি। তাই দুর্নীতির ব্যাপকতা ও গভীরতা এখনো অত্যন্ত উদ্বেগজনক। এমন অবস্থায় দেশে দুর্নীতি দমনে আরও কঠোর ও কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়ার আহ্বান জানিয়েছে প্রতিষ্ঠানটি। একই সঙ্গে দাবি উঠেছে দুর্নীতি দমন কমিশনসহ (দুদক) জবাবদিহিমূলক অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের স্বাধীনতা নিশ্চিতের।
বিশ্বের ১৬৮টি দেশ ও অঞ্চলে ২০১৫ সালের পরিস্থিতি বিবেচনায় নিয়ে এ সূচক তৈরি করা হয়েছে। প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়, ঊর্ধ্বক্রম অনুযায়ী (ভাল থেকে খারাপের দিকে) বাংলাদেশের অবস্থান ১৩৯ । যা আগের বছর ১৭৫ দেশের মধ্যে ছিল ১৪৫তম।
আর উল্টোভাবে ‘সবচেয়ে দুর্নীতিগ্রস্ত’ দেশের তালিকায় বাংলাদেশের জায়গা হয়েছে ১৩তম স্থানে। যা গতবার ছিল ১৪তম-তে। সূচকের ১০০ মানদণ্ডের মধ্যে এবার বাংলাদেশের স্কোর বা নম্বর ২৫। আগের বছরও একই স্কোর ছিল বাংলাদেশের।
সংবাদ সম্মেলনে টিআইবি’র নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান বলেন, উচ্চক্রম অনুযায়ী ২০১৫ সালে বাংলাদেশের ছয় ধাপ অগ্রগতি কিছুটা সন্তোষজনক মনে হতে পারে। যদিও বাস্তবে তা হয়েছে এবার সাতটি দেশ জরিপের আওতাভুক্ত না হওয়ায়। তারা সবসময় বাংলাদেশের তুলনায় বেশি স্কোর পেয়েছে।
দক্ষিন এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে এবারও বাংলাদেশের অবস্থান আফগানিস্তানের পর দ্বিতীয় সর্বনিম্ন। নিম্নক্রম অনুযায়ী বাংলাদেশ এবার ২০১৪ সালের ১৪তম অবস্থানের একধাপ নিচে ১৩তম, যা ২০১৩ সালের তুলনায় ৩ ধাপ নিচে ও ২ পয়েন্ট কম। অর্থাৎ সার্বিক বিবেচনায় এবারও আমাদের অগ্রগতি হলো না।”
‘উদ্যোগ সত্বেও দৃষ্টান্তের সংকট’
দুর্নীতি না কমার কারণ হিসেবে ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, “সরকার ও সংশ্লিষ্ট রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান কিছু কিছু দুর্নীতি বিরোধী উদ্যোগ গ্রহণ স্বত্ত্বেও প্রয়োগ ও চর্চার ঘাটতির ফলে কার্যকরভাবে দুর্নীতি নিয়ন্ত্রনের দৃষ্টান্তের সংকট প্রকটতর হয়েছে। দুর্নীতি প্রতিরোধ ও দমনের দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রতিষ্ঠান দুদকের কার্যকরতা ও স্বাধীনতা খর্ব করার অপপ্রয়াস যেমন অব্যাহত রয়েছে, তেমনি দুদকের নিজস্ব সক্রিয়তা, দৃঢ়তা ও নিরপেক্ষতার ঘাটতি রয়েছে চলমান। এছাড়াও সরকারের নীতি কাঠামো দুর্নীতি সহায়ক, দুর্নীতিতে লাভবান ও দুর্নীতিকে প্রশ্রয়দানকারী মহলের করাভূত হওয়ার ঝুঁকির সম্মুখিন হয়েছে।”
সূচকে অন্যান্য দেশের অবস্থান
টিআই’র দুর্নীতির ধারণা সূচক অনুযায়ী, এবার বিশ্বের সবচেয়ে কম দুর্নীতিগ্রস্ত দেশ ডেনমার্ক। দেশটির স্কোর ৯১। এর পরের অবস্থানে রয়েছে যথাক্রমে ফিনল্যান্ড ও সুইডেন। আর মাত্র ৮ স্কোর নিয়ে বিশ্বের সবচেয়ে দুর্নীতিগ্রস্ত দেশের তালিকায় যৌথভাবে রয়েছে উত্তর কোরিয়া ও সোমালিয়া। দ্বিতীয় ও তৃতীয় অবস্থানে আছে যথাক্রমে আফগানিস্তান ও সুদান।
বৈশ্বিক দুর্নীতি পরিস্থিতির ক্রমশ অবনতির তথ্য তুলে ধরে টিআইবি জানায়, ২০১৫ সালের দুর্নীতির ধারণা সূচকে বৈশ্বিকভাবেই অবস্থার অবনতি হয়েছে। সূচকে কোন দেশই শতভাগ স্কোর পায় নি। বিশ্বের সর্বোচ্চ উন্নত দেশসমূহের অনেকেই, যেমন অস্ট্রেলিয়া, আইসল্যান্ড, বেলজিয়াম, জাপান, অষ্ট্রিয়া, আয়ারল্যান্ড, যুক্তরাষ্ট্র, ফ্রান্স, স্পেন, ইতালী ইত্যাদি ৮০ শতাংশের কম স্কোর পেয়েছে।
১৬৮টি দেশের মধ্যে ১১৪টি, অর্থাৎ ৬৮ ভাগ দেশ ৫০ এর কম স্কোর পেয়েছে। ১০৩টি দেশ সূচকের গড় স্কোর ৪৩ এর চেয়ে কম পেয়েছে। এছাড়াও ২০১৪ সালে যেখানে ৯২টি দেশের স্কোর বেড়েছিল, ২০১৫ সালে সেখানে ৬৫টি দেশের স্কোর বেড়েছে। অন্যদিকে ২০১৪ সালে ৩৬টির তুলনায় ২০১৫ সালে ৪৯টি দেশের স্কোরে অবনতি হয়েছে। উদাহরনস্বরূপ, ডেনমার্ক গতবার ৯২ স্কোর নিয়ে সবচেয়ে কম দুর্নীতিগ্রস্থ দেশের তালিকার শীর্ষে থাকলেও এবার তাদের স্কোর ৯১। এছাড়া নিউজিল্যান্ড, নেদারল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া, লুক্সেমবার্গ ও সিঙ্গাপুরের মত দেশের স্কোরেও অবনতি হয়েছে।
‘রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে দূর্নীতির বিরুদ্ধে লড়তে হবে’
এ প্রেক্ষিতে দুর্নীতির বিরুদ্ধে রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে লড়তে হবে বলে জানান ড. ইফতেখারুজ্জামন। তিনি বলেন, দেশে দুর্নীতি দমনে রাজনৈতিক দল ও সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের অঙ্গীকার বাস্তবায়ন করতে হবে। রাষ্ট্রীয়ভাবে দুর্নীতিবাজ ও দুর্নীতির প্রশ্রয়কারীদের চিহ্নিত করে যথাযথ শাস্তির বিধান করতে হবে। তবেই দেশে দুর্নীতি কমানো সম্ভব।’
তিনি বেনারকে বলেন, বর্তমান সরকারের নির্বাচনি ইশতেহার, ষষ্ঠ পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনাসহ বিভিন্ন দলিলে দুর্নীতির বিরুদ্ধে শক্ত অবস্থানের কথা বলা হয়েছে। সেসবের প্রয়োগ নেই। দুর্নীতিবাজরা বিনা বিচারে বের হয়ে যাচ্ছে, এই বিচারহীনতার সংস্কৃতি বন্ধ করে ন্যায় বিচার নিশ্চিত করতে হবে, আইনের শাসন জোরদার করতে হবে। এছাড়া সংসদ ও দুর্নীতি দমন কমিশনকে আরও কার্যকর করতে হবে।
সংবাদ সম্মেলনে টিআইবির ট্রাস্টি বোর্ডের চেয়ারম্যান সুলতানা কামাল বলেন, ‘কিছুটা স্বস্তির বিষয় যে, বাংলাদেশ নিচে নেমে যায়নি। তবে এতেই বসে থাকলে চলবে না। কারণ আমরা এখনো গড় স্কোরের কাছে পৌঁছাতে পারিনি। দেশের সামগ্রিক উন্নয়নের সঙ্গে দুর্নীতি কমছে কি না, গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা ঠিক আছে কি না সেসব বিষয়ও লক্ষ্য রাখতে হবে।’
টিআইবি’র ট্রাস্টি এম. হাফিজউদ্দিন খান বলেন, “যদি সংসদীয় কমিটিগুলো কার্যকর হয়, প্রশাসনযন্ত্র সংসদের জবাবদিহিতার মধ্যে থাকে, বিরোধী দল কার্যকর ভূমিকা পালন করতে পারে তাহলে আমাদের অবস্থার আরো উন্নতি হতে পারে।”
সিপিআই সূচকে স্কেলের ‘০’ স্কোরকে দুর্নীতির ব্যাপকতার ধারণায় সবচেয়ে বেশি দুর্নীতিগ্রস্ত এবং ‘১০০’ স্কোরকে দুর্নীতির ব্যাপকতার ধারণার মাপকাঠিতে সবচেয়ে কম দুর্নীতিগ্রস্ত বা সর্বোচ্চ সুশাসন প্রতিষ্ঠিত দেশ বলে ধারণা করা হয়। উল্লেখ্য, ২০১৫ সালের সিপিআই-এ ফেব্রুয়ারি ২০১৩ থেকে আগস্ট ২০১৫ পর্যন্ত সময়ের তথ্য সংগৃহীত হয়েছে।
আপমর জনগণ দুর্নীতিগ্রস্ত নয়
টিআইবি’র সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয় যে, সিপিআই সম্পর্কে যথাযথ ধারণার অভাবে বাংলাদেশ বা তার অধিবাসীদের দুর্নীতিগ্রস্ত মনে করা হয়। বাস্তবে দেশের আপামর জনগণ দুর্নীতিগ্রস্ত নয়। তারা দুর্নীতির কারণে ক্ষতিগ্রস্ত ও ভুক্তভোগী মাত্র। ক্ষমতাবানদের দুর্নীতি এবং তা প্রতিরোধে দেশের নেতৃত্ব ও সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানসমূহের ব্যর্থতার কারণে দেশ বা জনগণকে কোনোভাবেই দুর্নীতিগ্রস্ত বলা যাবে না বলে সংবাদ সম্মেলনে বক্তারা অভিমত প্রকাশ করেন।
স্বীকার করলেন অর্থমন্ত্রী
এদিকে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের পর্যবেক্ষণের সঙ্গে একমত হয়েছেন সরকারের অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত। দুর্নীতিতে বাংলাদেশের তেমন কোন অগ্রগতি হয়নি বলে স্বীকার করেছেন তিনি। একইসঙ্গে ডিজিটালাইজেশনের চলমান প্রক্রিয়ার গতিশীলতার সঙ্গে সঙ্গে দুর্নীতি কমবে বলেও আশা প্রকাশ করেন মুহিত।
ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের প্রতিবেদনের প্রসঙ্গে অর্থমন্ত্রী বলেন, “দুর্নীতি দমনে কোন উন্নতি হয়নি বলেই আমার ধারণা। দুর্নীতির ব্যাপারটাতে আমরা টাচই করতে পারি নাই।”
তবে সরকার পদক্ষেপ নিচ্ছে জানিয়ে তিনি বলেন, “ডিজিটালাইজেশনের কাজ চলছে। বিভিন্ন কাজ ডিজিটালি হলে দুর্নীতি কমে যাবে।”
সেইসঙ্গে তিনি হল-মার্ক কেলেঙ্কারিসহ বিভিন্ন ঘটনায় সরকারের নেওয়া পদক্ষেপের কথা স্মরণ করিয়ে দেন।