বাঘ সংকটে সুন্দরবন, ডেকে আনছে পরিবেশ বিপর্যয়
2015.07.29
বাংলাদেশের সুন্দরবনে এখন সব মিলিয়ে বাঘের সংখ্যা মাত্র ১০৬টি। যেখানে জীববৈচিত্র্য ও খাবারের ভিত্তিতে বাংলাদেশ অংশে কমপক্ষে ২০০ বাঘ থাকার কথা, সেখানে বাংলাদেশ ও ভারত মিলিয়ে পুরো সুন্দরবনে বাঘের সংখ্যা এখন ১৭০টি। ক্যামেরা পদ্ধতিতে সুন্দরবনের বাঘ গণনা জরিপ-২০১৫ এর ফলাফলে উঠে এসেছে এ তথ্য।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, গত এক দশকে বাঘের সংখ্যা অর্ধেকে নেমে এসেছে, যা পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষার জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর। তারা বলছেন, চোরা শিকারি, বনের ভেতর দিয়ে অবাধে নৌযান চলাচল এবং বনের পাশে শিল্প অবকাঠামো নির্মাণ বাঘের অস্তিত্বের জন্য বড় হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে।
এর আগে সর্বশেষ ২০১০ সালে বন বিভাগ ও ওয়াইল্ড লাইফ ট্রাস্ট অব বাংলাদেশ যৌথভাবে সুন্দরবনের খালে বাঘের বিচরণ পর্যবেক্ষণের ভিত্তিতে জরিপ করে। তাতে বাঘের সংখ্যা ৪০০ থেকে ৪৫০টি বলে উল্লেখ করা হয়।
তবে এবার ক্যামেরায় ছবি তুলে, খালে বাঘের পায়ের ছাপ গুনে ও তার গতিবিধির অন্যান্য তথ্য-প্রমাণ ব্যাখ্যা করে এই সংখ্যা সম্পর্কে নিশ্চিত হয়েছে বলে জানিয়েছে বন বিভাগ।
এ প্রসঙ্গে প্রধান বন সংরক্ষক ড. তপন কুমার দে বেনারকে বলেন, ক্যামেরা ফুটেজের মাধ্যমে করা এই জরিপ গত এপ্রিলে শেষ হয়েছে। তাতে দেখা যাচ্ছে, সুন্দরবনে বাঘের সংখ্যা ৮৩ থেকে ১৩০ এর মধ্যে রয়েছে। গড় হিসাবে বাঘের সংখ্যা ধরা হয়েছে ১০৬টি। এটি অনেক সঠিক হিসাব।’
ভারসাম্যহীন পরিবেশ ডেকে আনছে
তারও আগে ২০০৬ সালে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক মনিরুল হাসান খান ব্রিটিশ জুয়োলজিক্যাল সোসাইটির সহায়তায় সুন্দরবনে বাঘ গণনা জরিপে ২০০টি বাঘের সন্ধান পান।
তিনি বেনারকে বলেন, “নানা জরিপের ফল বলছে, সুন্দরবনে বাঘের সংখ্যা কমে এসেছে। যা মূলত: পরিবেশে এক ধরনের ভারসাম্যহীনতার সৃষ্টি করবে। বাঘ ভারসাম্য নিয়ন্ত্রক। বাঘের সংখ্যা কমে গেলে বনে হরিণের সংখ্যা বৃদ্ধি পাবে। একটা সময় হরিনেরও খাবার পাওয়া যাবেনা। এককথায় পুরো বন ভারসাম্যহীন হয়ে পড়বে। এছাড়া বাঘের দর্শন না পেলেও বাঘকে কেন্দ্র করেই সুন্দরবনের পর্যটন শিল্প গড়ে উঠেছে। বাঘের সংখ্যা কমে গেলে পর্যটন শিল্পও ক্ষতিগ্রস্ত হবে।”
শুধু সরকারি জরিপে নয়, বাঘের সংখ্যা কমেছে বলে দাবি করেছেন জীবিকার তাগিদে নিয়মিত সুন্দরবনে যাওয়া মৌয়াল বা জেলেরাও।
সাতক্ষীরা জেলার শ্যামনগর থানার কালিঞ্চি গ্রামের জেলে রাজ্জাক গাইন, যিনি গত ২০ বছর ধরে সুন্দরবনে মাছ ধরেন; বেনারকে জানান, “আমরা যারা দীর্ঘদিন ধরে বনে যাওয়া আসা করি, তারা বুঝতে পারি বনে বাঘের সংখ্যা কমে গেছে। আগে যে হারে মানুষ বাঘের হামলার শিকার হত এখন তা অনেকাংশে কমে এসেছে। বিশেষ করে গত দুই বছরে খুব বেশি সংখ্যক মানুষকে বাঘে ধরেছে বলে জানতে পারিনি। তাছাড়া বনের পরিবেশ দেখেও আমরা ধারণা করতে পারি।”
বাঘ গণনা জরিপ-২০১৫-এর প্রধান পরামর্শক ভারতের বন্য প্রাণী ইনস্টিটিউটের প্রধান রাজভেন্দর ঝালা বলেছেন, “সুন্দরবনের ভারতীয় অংশের নদীতে লবণাক্ততার পরিমাণ বেশি এবং সেখানে বাঘের প্রধান খাবার হরিণের সংখ্যা কম হওয়া স্বত্বেও ভারতীয় সুন্দরবনে বাঘ বিচরণ এলাকায় প্রতি ১০০ বর্গকিলোমিটারে চারটি ও বাংলাদেশ অংশে দুটি বাঘ রয়েছে বলে ক্যামেরা জরিপে দেখা গেছে। যা বাংলাদেশ অংশে বাঘের অস্তিত্ব হুমকির মুখে বলে প্রমাণ করে।”
বন্ধ করতে হবে চোরা শিকার
বাঘ গবেষক মনিরুল হাসান খান বলেন, “সুন্দরবনের ভারসাম্য রক্ষা এবং অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে বাঘের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে হবে। চোরাশিকারীদের বিরুদ্ধে শক্তিশালী অবস্থান নিতে হবে। প্রয়োজনে বিভিন্ন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর যৌথ উদ্যোগের মাধ্যমে এসব চোরা শিকার বন্ধ করতে হবে”।
তাঁর মতে, সুন্দরবনের ভেতর দিয়ে নৌযান চলাচলও বাঘের অস্তিত্বকে হুমকির মুখে ফেলছে। নৌযান চলাচলের কারণে অনিয়ন্ত্রিভাবে বনে বিপুল সংখ্যক মানুষ প্রবেশ করে। বনে পর্যটক প্রবেশের নিয়ন্ত্রণ থাকলেও এসব নৌযান করে কত মানুষ সুন্দরবনে প্রবেশ করে তার উপর কোন নিয়ন্ত্রন নেই। এছাড়া এসব নৌযান চলাচলের ফলে বনের পরিবেশ দূষণও হচ্ছে।
আর রাজভেন্দর খুলনায় সুন্দরবনের পাশে রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের সমালোচনা করে বলেন, “নৌযান চলাচল ও বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনার মত তৎপরতা বাংলাদেশ অংশে সুন্দরবনের অস্তিত্ব আরও হুমকির মুখে ফেলবে। বাঘ রক্ষা করতে হলে এসব বাধা দূর করতে হবে।”
বাঘ রক্ষার উদ্যোগ সম্পর্কে প্রধান বন সংরক্ষক তপন কুমার বেনারকে বলেন, “বাঘের অস্তিত্ব রক্ষায় চোরাশিকার বন্ধে আমরা কঠোর ব্যবস্থা নিচ্ছি। আধুনিক অস্ত্র-শস্ত্রে বনবিভাগকে শক্তিশালী করাসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সহায়তা নিয়ে বনে ডাকাতি ও চোরা শিকার বন্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে”।
তিনি আরো বলেন, তবে বনের পরিবেশ রক্ষায় করণীয় সবকিছু বনবিভাগের হাতে নেই। তাই ইচ্ছে করলেই আমরা সুন্দরবনের ভেতরের নৌপথ বন্ধসহ আরো অনেক জরুরি পদক্ষেপ নিতে পারিনা। এর জন্য আন্তঃমন্ত্রণালয় সমন্বয় জরুরি। নৌপথ বা রামপাল বিদ্যুতকেন্দ্র স্থাপনে সুন্দরবনে কি ধরনের প্রভাব পড়তে পারে সে সম্পর্কে সরকারে উচ্চমহল জ্ঞাত আছে। আশা করব খুব শীঘ্রই এই নৌপথ বন্ধসহ প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেবে সরকার।
বাঘের বিচরণ ক্ষেত্র
এবারের জরিপে সুন্দরবনে মোট ৩৮টি পূর্ণবয়স্ক ও চারটি বাঘের বাচ্চার ছবি তুলতে পেরেছে বন বিভাগের জরিপ দল। বাকি ৬৮টি বাঘের সংখ্যা নির্ধারণ করা হয়েছে খালে তাদের পায়ের ছাপ গুনে ও বিচরণের অন্যান্য তথ্য-প্রমাণের ভিত্তিতে। ক্যামেরাবন্দী হওয়া ৩৮টি বাঘের ৩০ শতাংশ পুরুষ এবং বাকিগুলো নারী।
জরিপের ফলাফল বলছে, সুন্দরবনের বাংলাদেশ অংশের ৬ হাজার বর্গ কিলোমিটারের মধ্যে ৪ হাজার ৮৩২ বর্গকিলোমিটার এলাকায় বাঘ বিচরণ লক্ষ্য করা গেছে। বাগেরহাটের কটকা, কচিখালী ও সুপতি; সাতক্ষীরার মুন্সিগঞ্জ, দোবেকি ও কৈখালী এবং খুলনার নীলকমল, পাটকোষ্টা ও গেওয়াখালী এলাকা এদের বিচরণের প্রধান ক্ষেত্র। তিনটি অঞ্চলের মধ্যে বাগেরহাটে ১৭টি, সাতক্ষীরায় ১৩টি ও খুলনায় আটটি বাঘের ছবি ধারণ করা হয়েছে।
লক্ষ্য অর্জনে পিছিয়ে পড়ছে বাংলাদেশ
বাংলাদেশ, ভারত, ভুটান, নেপাল, মিয়ানমার ও চীনে রয়েল বেঙ্গল টাইগার দেখতে পাওয়া যায়। ২০১০ সালে রাশিয়ায় অনুষ্ঠিত বাঘ সম্মেলনে ২০২২ সালের মধ্যে বিশ্বে বাঘের সংখ্যা দ্বিগুণ করার পরিকল্পনা নেওয়া হয়। কিন্তু বাংলাদেশ সে লক্ষ্য পূরন করতে তো পারছেই না বরং বাঘের সংখ্যা কমে আসছে।
বাংলাদেশ ওই ঘোষণায় স্বাক্ষর করে। এতে বলা হয়েছিল, বিশ্বের বাঘসমৃদ্ধ ১৩টি দেশ প্রতি দুই বছর পর পর বাঘ গণনা করবে। এই দেশগুলো হল বাংলাদেশ, ভারত, ইন্দোনেশিয়া, চীন, ভুটান, নেপাল, মায়ানমার, থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া, কম্বোডিা, লাওস, ভিয়েতনামও রাশিয়া। বাংলাদেশ ওই ঘোষণার পাঁচ বছর পর বাঘগণনা শেষ করল।
প্রতিবেশি দেশ ভারত ও নেপাল এই ক্যামেরা পদ্ধতিতে বাঘ গণনা শেষ করেছে। সে জরিপ অনুসারে বর্তমানে ভারতে দুই হাজার ২২৬টি এবং নেপালে একশ ৭৮টি বাঘ আছে।
বাঘ বিধবা
সুন্দরবন ঘেষা গ্রামগুলোতে অসংখ্য বিধবার দেখা মেলে, যাদের বনজীবী স্বামীরা বাঘের থাবায় প্রাণ হারিয়েছেন। গাবুরা ইউনিয়নের সোনামনি বিবি (৫০) তাদেরই একজন।
তিনি জানান, ২০ বছর আগে তার স্বামী বনে মধু সংগ্রহ করতে গেলে বাঘের শিকারে প্রান দেন। বিধবা হয়ে নিজের বাবা মায়ের বাড়িতেও তাকে 'অপয়া' অপবাদ শুনতে হত। এর কিছুদিনের মধ্যে দেবরের সঙ্গে সোনামনির আবার বিয়ে হয়, তিনিও বনজীবী ছিলেন।
প্রথম স্বামীর রেখে যাওয়া সন্তানসহ বনে গিয়ে তিনিও বাঘের হামলায় প্রাণ দেন। বর্তমানে সোনামনির দুই ছেলে ও এক মেয়ে। তার ছেলেরাও সুন্দরবন থেকে জীবিকা নির্বাহ করেন। এই বৃদ্ধা বেনারকে বলেন, সুন্দরবন থেকে বাঘের থাবা আমার জীবনের সব সুখ নিয়ে গেছে। জীবনের তাগিদে সেই বনেই ছুটছে আমার সন্তানরা। প্রতি মুহুর্ত শঙ্কায় কাটে আমার।