মানবপাচারকারীদের বিরুদ্ধে ‘জিরো টলারেন্স’ নীতি, ৪ পাচারকারী আটক, ফিরেছে আরো ৪১
2015.06.24

অবৈধ মানবপাচারের বিরুদ্ধে শক্ত অবস্থান নিয়েছে বাংলাদেশ। দেশ জুড়ে শক্ত হাতে পাচারকারীদের বিরুদ্ধে অভিযান চালাচ্ছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। মানবপাচারকে একটি ‘আন্তর্জাতিক সমস্যা’ হিসাবে উল্লেখ করে এর বিরুদ্ধে সরকারের ‘জিরো টলারেন্স’ নীতির কথা জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
বুধবার জাতীয় সংসদ অধিবেশন চলাকালীন প্রশ্নোত্তর পর্বে তিনি বলেন, “মানবপাচারকারীরা আন্তর্জাতিক চক্রের সাথে জড়িত। সাম্প্রতিককালে অবৈধভাবে মানবপাচারের বিষয়টি আশঙ্কাজনক হারে বৃদ্ধি পেয়েছে। বাংলাদেশ এই মানবপাচারের বিরুদ্ধে শক্ত অবস্থান গ্রহণ করেছে।”
সংসদ সদস্য গোলাম মোস্তফার প্রশ্নের জবাবে প্রধানমন্ত্রী আরো বলেন, “মানবপাচারকারীদের বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নীতি গ্রহণ করতে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। এছাড়া পাচারের শিকার বাংলাদেশি নাগরিকদের দ্রুত দেশে ফিরিয়ে আনা এবং মানব পাচার রোধে এ অঞ্চলের দেশগুলোকে সঙ্গে নিয়ে সমন্বিতভাবে কাজ করার বিষয়ে বাংলাদেশ ‘কূটনৈতিক প্রচেষ্টা’ অব্যাহত রেখেছে।”
গত এপ্রিলে থাইল্যান্ডের জঙ্গলে পাচারকারীদের একটি পরিত্যক্ত আস্তানায় গণকবর পাওয়ার পর সাগর পথে মানবপাচারের বিষয়টি আন্তর্জাতিক অঙ্গনে সাড়া ফেলে। এরপর মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া ও থাইল্যান্ড উপকূলে সাগরে ভাসমান অবস্থায় পাচারকারীদের কয়েকটি নৌকা থেকে তিন হাজারের বেশি মানুষকে উদ্ধার করা হয়েছে। যারা বাংলাদেশি ও মিয়ানমারের রোহিঙ্গা হিসেবে চিহ্নিত হয়ে আসছে।
প্রধানমন্ত্রী আরো জানান, মানব পাচারবিষয়ক তথ্য পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সম্ভাব্য স্বল্পতম সময়ের মধ্যে বাংলাদেশ কোস্ট গার্ড অভিযান পরিচালনা করছে। কোস্ট গার্ড সমুদ্রপথে অবৈধভাবে বিদেশ যাওয়ার সময় এ পর্যন্ত মোট ১ হাজার ৭৩৬ জন বিদেশগামী নাগরিককে আটক করেছে।
প্রধানমন্ত্রীর এ নীতিতে সন্তোষ প্রকাশ করেছে জনশক্তি রপ্তানিকারকদের সংগঠন বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ইন্টারন্যাশনাল রিক্রুটিং এজেন্সিজ (বায়রা)।
সংগঠনটির সভাপতি আবুল বাশার বেনারকে বলেন, “আমরা যারা বৈধভাবে জনশক্তি রপ্তানি করি তারা প্রধানমন্ত্রীর এ নীতিকে সাধুবাদ জানাই। আমরা চাই যেকোন মূল্যে মানব পাচার বন্ধ হোক। কারণ, অবৈধ শ্রমিক যাওয়ার কারণে বৈধ শ্রমিকদের বাজার সংকুচিত হয়ে আসে। এছাড়া ব্যপকভাবে দেশ ভামূর্তির সংকটে পড়ে”।
৮৫০ জাল পাসপোর্টসহ চার মানবপাচারকারী আটক
এদিকে দেশব্যাপী মানব পাচারকারীদের বিরুদ্ধে চলা নিয়মিত অভিযানে গত সোমবার রাজধানীর মতিঝিলের একটি ভবন থেকে অন্তত সাড়ে আট’শ জাল পাসপোর্ট ও শিপিং লাইনের ৪০টি জাল সনদসহ চার মানবপাচারকারীকে আটক করেছে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)। এ সময় ওই অফিস থেকে বিদেশে পাচারের জন্য অপেক্ষায় রাখা চার যুবককে উদ্ধার করে সিআইডি। এ ঘটনায় মতিঝিল থানায় মামলা হয়েছে।
আটক চার মানবপাচারকারী হলো - মহিদুল ইসলাম, হিম্মত আলী, মো. রাসেল ও উজ্জ্বল খান। উদ্ধারকৃত চার যুবকের নাম আশরাফুল ইসলাম, মোহাম্মদ আলী, আবুল কালাম আজাদ ও সাইফুল।
সিআইডির বিশেষ পুলিশ সুপার আবদুল কাহহার আকন্দ এবিষয়ে বলেন, “সোমবার রাতে মতিঝিলের শাপলা ভবনের অষ্টম তলার একটি অফিসে অভিযান চালানো হয়। সেখান থেকে বিভিন্ন দেশের জাল ভিসার সিলসহ ৮৫০টি জাল পাসপোর্ট উদ্ধার করা হয়। তাছাড়া জাহাজের নাবিকদের ৪০টি জাল সনদও উদ্ধার করা হয়। এসব ভুয়া কাগজ ব্যবহার করে চক্রটি বিদেশে মানবপাচার করত।”
কাহহার আকন্দ জানান, “আটক চারজনের কাছ থেকে ইরাক, দুবাই, লিবিয়া, মোজাম্বিক, মিসর, ওমান, সৌদি আরব, কাতার, ইথিওপিয়া, মালয়েশিয়া, নাইরোবিসহ বিভিন্ন দেশের জাল ভিসা, বিমান টিকিট, সাগরপথে বিদেশে মানবপাচারের শিপিং লাইনের ডিসচার্জ জাল সনদ, বিভিন্ন বিমানবন্দরের অ্যারাইভাল ও ইমিগ্রেশন জাল সিল, বিভিন্ন দূতাবাসের জাল সিল ও প্যাড উদ্ধার করা হয়।”
তিনি বলেন, “কম্পিউটারে জাল করা ভিসার ওপর স্টিকার বসিয়ে পাসপোর্টে জুড়ে দিয়ে হাজারো মানুষকে পাঠিয়ে দেওয়া হতো বিদেশে। আকাশ, স্থল ও নৌপথ তিনভাবেই বিদেশে লোক পাঠাত এসব পাচারকারীরা।”
থাইল্যান্ড থেকে ফিরলেন আরো ৪১ জন
সাগর পথে অবৈধভাবে বিদেশ যাওয়ার পথে আটকে পড়া আরও ৪১ বাংলাদেশিকে বুধবার থাইল্যান্ড থেকে দেশে ফিরিয়ে আনা হয়েছে।
বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের একটি ফ্লাইটে বুধবার সন্ধ্যা সাড়ে ৭টার দিকে তারা ঢাকা পৌঁছান। গত সপ্তাহেও থাইল্যান্ড থেকে ৪৭ বাংলাদেশিকে দেশে ফিরিয়ে আনা হয়। একইভাবে তারা অবৈধভাবে বিদেশ যেতে গিয়ে সাগর থেকে আটক হন।
দেশে ফিরিয়ে আনার বিষয়ে থাইল্যান্ডে নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত বেনারকে বলেন, “সাগর থেকে আটক হওয়ার পর তাদেরকে যাচাই-বাছাই করে সরকারিভাবে দেশে ফেরত পাঠানো হচ্ছে। ‘দ্রুততার’ সঙ্গে এসব বাংলাদেশিকে ফেরত নেওয়া হবে সরকারের এমন প্রতিশ্রুতি থেকেই তাদেরকে দেশে ফেরত নিতে কাজ করছে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়।”
এসব বাংলাদেশিদের দেশে ফিরিয়ে আনতে পুরো খরচ যোগাচ্ছে সরকার। নাগরিকত্ব যাচাই-বাছাইসহ পুরো প্রক্রিয়া সমন্বয় করছে ব্যাংককে বাংলাদেশ মিশন।
বুধবার ফেরত আসা ৪১ জনের মধ্যে কক্সবাজারের ১৩ জন, ঝিনাইদহের ছয়জন, নরসিংদী ও সিরাজগঞ্জের পাঁচ জন করে, সাতক্ষীরার চারজন, মাগুরার তিনজন, যশোর ও বান্দরবানের দুইজন করে এবং ফরিদপুরের একজন রয়েছেন।
বিমানবন্দরে আসার পর তাদেরকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পক্ষ থেকে ব্যাপক জিজ্ঞাসাবাদ করার পর নিজ নিজ বাড়িতে পাঠানো হয়।