আবার তৎপর মানবপাচারকারীরা, কক্সবাজারে দুই শীর্ষ পাচারকারী গ্রেপ্তার
2015.09.18

শীত মৌসুম চলে আসায় সাগর এখন শান্ত, আর মানবপাচারকারী চক্রগুলো ফের সক্রিয় হয়ে উঠেছে। সাগরপথে মানবপাচারের বড় রুট কক্সবাজার থেকে চক্রের অন্যতম হোতা দিল মোহাম্মদ ও মো. ইউনুছ গ্রেপ্তার হওয়ার পর তাদের কৌশলী তৎপরতা সম্পর্কে তথ্য পেয়েছে পুলিশ। তারা দুইজনই থাইল্যান্ড ও মালয়েশিয়ায় ‘মোস্ট ওয়ান্টেড’ হিসেবে চিহ্নিত।
গত ১২ সেপ্টেম্বর টেকনাফের সাবরাং ইউনিয়নের শাহপরীর দ্বীপ এলাকায় পৃথক অভিযান চালিয়ে তাদের গ্রেপ্তার করা হয়। পুলিশ জানায়, তাঁরা দুজনই স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তালিকাভুক্ত মানব পাচারকারী। নতুন করে মানবপাচার শুরুর জন্য তাঁরা টেকনাফে এসেছিলেন বলে ধারণা করা হচ্ছে।
“দিল মোহাম্মদের (৪৫) বিরুদ্ধে মানব পাচারের তিনটি মামলা রয়েছে। আর মো. ইউনুছের (৪০) বিরুদ্ধে হত্যা, নারী নির্যাতনসহ মানব পাচারের পাঁচটি মামলায় গ্রেপ্তারি পরোয়ানা রয়েছে,” বেনারকে জানান টেকনাফ মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আতাউর রহমান খন্দকার।
তিনি বলেন, গ্রেপ্তারকৃত ইউনুছের বড় ভাই ধলু হোসেন ওরফে ধলু মাঝিও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তালিকাভুক্ত মানব পাচারকারী ছিলেন। ধলু মাঝি গত ৮ মে টেকনাফে পুলিশের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে নিহত হন।
এদিকে কক্সবাজার ও চট্টগ্রামের পতেঙ্গায় মানবপাচারের মামলায় তাঁকে গ্রেপ্তার দেখানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে পুলিশ।
দিল মোহাম্মদ মালয়েশিয়া ও থাইল্যান্ডে মোস্ট ওয়ান্টেড
গত বৃহস্পতিবার বার্তা সংস্থা এএফপির খবরে টেকনাফ থানা-পুলিশ পরিদর্শক কবির হোসেনের বরাত দিয়ে বলা হয়, দিল মোহাম্মদ মালয়েশিয়া ও থাইল্যান্ডে মোস্ট ওয়ান্টেড আসামি। বাংলাদেশ থেকে শত শত মানবপাচারের সঙ্গে তার সম্পৃক্ততা রয়েছে। মালয়েশিয়া থেকেই সে বাংলাদেশে এসেছিল বলে ওই পুলিশ কর্মকর্তা জানান।
এদিকে পুলিশ পুরোনো মামলার সূত্র ধরে দিল মোহাম্মদের সংশ্লিষ্টতা পাচ্ছে। গত বছরের নভেম্বরে অবৈধভাবে সাগর পাড়ি দেওয়ার প্রস্তুতি নেওয়ার সময় পতেঙ্গা থানা এলাকা থেকে ৪৯২ জনকে আটক করা হয়। এ ঘটনায় অজ্ঞাতদের আসামি করে মামলা করা হয়েছিল।
“ওই মামলায় দিল মোহাম্মদের সংশ্লিষ্টতা মিলেছে। মামলাটি এখন পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ- সিআইডি তদন্ত করছে,” বেনারকে জানান চট্টগ্রামের পতেঙ্গা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মো. আলমগীর।
পুলিশ জানায়, দিল মোহাম্মদ ৯০ দশক থেকেই মানব পাচারে জড়িত। তিনি মূলত মিয়ানমারের নাগরিক। আগে উড়োজাহাজে করে বাংলাদেশি নাগরিকদের থাইল্যান্ডের সীমান্ত দিয়ে মালয়েশিয়ায় পাচার করতেন। পরে তিনি নৌ রুটের দিকে ঝুঁকে পড়েন।
“মানবপাচার সংশ্লিষ্ট বিষয় ছাড়া দিল মোহাম্মদের কক্সবাজার যাওয়ার কারণ আছে বলে মনে হয় না। মানবপাচারের পথও পরিবর্তন করার চেষ্টা চলছে বলে আভাস পাওয়া যাচ্ছে,” বেনারকে জানান মালয়েশিয়া ভিত্তিক অভিবাসন বিষয়ক সংস্থা কারাম এশিয়ার আঞ্চলিক সমন্বয়ক হারুন-উর-রশিদ।
তিনি বলেন, এরই মধ্যে তাঁরা থাইল্যান্ডের চিয়াংমাই ও মালাক্কা সিটি হয়ে কিছু লোক পাঠিয়েছে। এই পথটিকে এবার তারা মানবপাচারের মূল পথ হিসেবে ব্যবহার করতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
পাচারকারীরা আবার তৎপর হয়ে উঠছে
হারুন-উর-রশীদ বলেন, বাংলাদেশ হলো মানবপাচারের উৎস দেশ। এখানকার আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী এখন পর্যন্ত মানবপাচারের হোতা বা গডফাদারদের পর্যন্ত পৌঁছতেই পারেনি। মাঠ পর্যায়ের কিছু লোকই তাদের হাতে ধরা পড়েছে, তাও খুবই সীমিত পর্যায়ে।
তাঁর মতে, সাগর যখন উত্তাল থাকে তখন মানবপাচারকারীদের ব্যবসা এমনিতেই ধীর হয়ে যায়। সামনে শীতকাল, সাগর শান্ত হয়ে আসছে। এই সময়ে মানবপাচারকারীরা আবারও তৎপর হয়ে উঠবে।
অভিবাসন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, গণমাধ্যমে সমালোচনা আর আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী কঠোর হওয়ায় কিছুদিন বিরতির পর মানবপাচার আবার শুরু হওয়ার লক্ষণ দেখতে পাচ্ছেন তাঁরা ।
অভিবাসী কর্মী উন্নয়ন প্রোগ্রাম (ওকাপ) এর চেয়ারম্যান শাকিরুল ইসলামও মনে করেন, সাগর শান্ত হয়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে মানবপাচারকারীরা আবারও গা ঝাড়া দিয়ে ওঠার চেষ্টা করছেন।
“ওরা যে ক্ষতির শিকার হয়েছেন তা পুষিয়ে নিতে নতুন করে মানবপাচারের জন্য দল গোছানোর কাজ শুরু হয়েছে। এ ছাড়া দিল মোহাম্মদের টেকনাফে আসার আর কোনো কারণ নেই,” বেনারকে জানান শাকিরুল।
অভিবাসন বিশেষজ্ঞদের পর্যবেক্ষণ হচ্ছে, বাংলাদেশসহ মানবপাচারে জড়িত দেশ মিয়ানমার, থাইল্যান্ড ও মালয়েশিয়ার সীমান্ত রক্ষী বাহিনী ও আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর যেসব কর্মকর্তা মানবপাচারে জড়িত ছিলেন তাদের সবার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়নি দেশগুলো। ওই কর্মকর্তাদের অনেকেই আবার আগের মতো অবৈধ কর্মকাণ্ডে জড়াচ্ছেন।
“বাংলাদেশে যশোরের সেই কালাম থেকে থাইল্যান্ডের উপ সেনাপ্রধান পর্যন্ত এই চক্রের সঙ্গে যুক্ত হয়ে পড়েছেন। এর ফলে দুই-একজন গ্রেপ্তার হলে তাদের ক্ষতি নেই। হোতাদের কেউ কেউ সরে গেলেও পাচারকারীদের কার্যক্রম বন্ধ হবে না। কারণ এটি বড় ধরনের ব্যবসা এবং এর সঙ্গে মোটা অঙ্কের অর্থ লেনদেন জড়িত,” জানান হারুন-উর-রশীদ।