রাজনীতি স্থিতিশীল, সমাজে বাড়ছে অস্থিরতা, বাড়ছে মানুষের অসন্তোষ
2015.09.21

দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে এক ধরনের স্থিতিশীলতা থাকলেও সামাজিক অস্থিরতা ক্রমেই বেড়ে যাওয়ায় মানুষের অসন্তোষ বাড়ছে। সরকার বিভিন্ন সুবিধা দিয়ে বা কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ করে পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার চেষ্টা করলেও নাগরিক উদ্বেগ ও অস্থিরতা কাটছে না।
দেশে ব্যাপক উন্নয়ন কর্মকাণ্ড ও মাথাপিছু আয় বাড়াসহ বিভিন্ন অর্থনৈতিক সূচকে অগ্রগতির পরও নাগরিক জীবনে স্বস্তি ফিরছে না। এর মূল কারণ হিসেবে বিশেষজ্ঞরা সুশাসনের অভাব থাকার বিষয়টি উল্লেখ করছেন ঘুরেফিরে।
অতি সম্প্রতি ঘটে যাওয়া উত্তেজনাকর এক পরিস্থিতিতে ফুটে উঠেছে অস্থিরতার চিত্র। মা-ছেলেকে নির্যাতনের ঘটনার প্রতিবাদে কালিহাতী ও ঘাটাইলের মানুষ গত শুক্রবার কালিহাতী উপজেলা সদরে বিক্ষোভ শুরু করলে পুলিশ গুলি চালায়। এতে প্রথমে তিনজন নিহত হন। পরে আরো একজন মারা যান। আহত হয়েছেন অন্তত ৫০ জন।
ওই ঘটনায় পুলিশের সাত সদস্য ও দুই থানার ভারপ্রাপ্ত ওসিকে প্রত্যাহার করা হয়েছে। এ ছাড়া ঘটনা তদন্তে পুলিশ ও প্রশাসনের পক্ষ থেকে দুটি তদন্ত কমিটি করা হয়েছে।
কালিহাতীর ঘটনা প্রসঙ্গে সাংবাদিকের প্রশ্নের জবাবে পুলিশের ভারপ্রাপ্ত মহাপরিদর্শক মোখলেসুর রহমান বলেন, ঘটনার (মা-ছেলেকে নির্যাতন) পরপরই পুলিশ উদ্যোগ নিয়েছে। কয়েকজন আসামিকে গ্রেপ্তারও করেছে। এর পরও বিক্ষোভকারীরা গুরুত্বপূর্ণ মহাসড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ করেছে। তারা একপর্যায়ে থানায় হামলা চালানোরও চেষ্টা করেছিল।
সর্বশেষ সরকারি ও বেসরকারি মেডিকেল কলেজে ভর্তির জন্য লিখিত পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস হওয়ার অভিযোগ উঠেছে। গত শুক্রবার এই পরীক্ষা হয়, রোববার স্বাস্থ্য অধিদপ্তর অনেকটা তড়িঘড়ি করে ভর্তি পরীক্ষার ফল প্রকাশ করলে ঢাকাসহ দেশের বিভিন্নস্থানে ভূক্তভোগী শিক্ষার্থীরা বিক্ষোভ করে। এই আন্দোলন সহসা বন্ধ হবে না বলে ধারণা করা হচ্ছে। উল্লেখ্য, দেশের সেরা মেধাবীরাই মেডিকেল বা বুয়েটে ভর্তি হয়।
গত কয়েক মাসের ঘটনা প্রবাহ
গত কয়েক মাসে একের পর এক ব্লগার হত্যা ও সরকার দলীয় নেতা–কর্মীদের বেশ কয়েকটি নৃশংস কর্মকাণ্ডে আইন শৃঙ্খলা পরিস্থিতির চরম অবনতি ঘটে। ব্লগার হত্যায় জড়িতদের গ্রেপ্তার ও বিচার চলছে। নিজ দলের নেতাদের সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড ঠেকাতে অন্তত চারজন সরকার দলীয় নেতাকে ক্রসফায়ারে হত্যার অভিযোগ ওঠে।
এরই মধ্যে শিশু ও নারী নির্যাতনের ঘটনাগুলো বেড়ে যায়, এ নিয়ে মানবাধিকার সংগঠন ও নারী সংগঠনগুলো সোচ্চার হয়ে ওঠে। আইন শৃঙ্খলা বাহিনী কিছুটা তৎপর হয়।
এক পর্যায়ে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইনের বিতর্কিত ৫৭ ধারায় সাংবাদিক প্রবীর সিকদারকে গ্রেপ্তার করে রিমান্ডে নেওয়ার ঘটনায় দেশজুড়ে প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়। আন্দোলনের মুখে তাঁকে দ্রুতগতিতে জামিন দেওয়া হয়, সেইসঙ্গে ওই আইনটি পর্যালোচনার সিদ্ধান্ত নেয় সরকার।
সাম্প্রতিক সময়ে গ্যাস-বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধি করায় গণ অসন্তোষ সৃষ্টি হয় । বিশ্ববাজারে তেলের দাম কমায় বিদ্যুতের উৎপাদন খরচও কমেছে। তারপরও দাম বাড়ানোর ঘটনায় মানুষ বিক্ষুব্ধ হয়।
এরপর আসে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের টিউশন ফির ওপর ভ্যাট বসানোর ঘটনায় ছাত্র আন্দোলন। ছাত্রদের বক্তব্য ছিল, বিশ্ববিদ্যালয়ের ওপর সাড়ে সাত শতাংশ ভ্যাট বসানো হলেও চূড়ান্তভাবে শিক্ষার্থীদেরই তা দিতে হতো।
এই আশঙ্কায় একটানা পাঁচ দিন ঢাকা শহর প্রায় অচল করে দেয় শিক্ষার্থীরা। আন্দোলনের মুখে সরকার বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ওপর থেকে ভ্যাট প্রত্যাহার করে নেয়।
ভ্যাট নিয়ে ছাত্র আন্দোলন থামতে না থামতেই শুরু হয় শিক্ষক আন্দোলন। বেতন বৈষম্যের অভিযোগে সব স্তরের শিক্ষকেরা ক্ষোভ–বিক্ষোভ ছাড়াও থেমে থেমে কর্মবিরতি শুরু করে।
জাতীয় বেতন স্কেল ঘোষণার পর সিলেকশন গ্রেড ও টাইম স্কেল তুলে দেওয়ায় সরকারি কর্মকর্তা–কর্মচারীদের ক্ষোভ চলছে, তাঁরাও বিভিন্ন সমিতি বা সংগঠনের ব্যানারে কর্মসূচি পালন করছেন।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা বলেছেন, দেশে সেই অর্থে রাজনৈতিক আন্দোলন নেই। বিরোধী দলের মাঠের কোনো কর্মসূচি নেই গত কয়েক মাস ধরে। কিন্তু দেশে সামাজিক অস্থিরতা বেড়েই চলছে।
তাঁদের মতে, গণতন্ত্র ও সুশাসনের অভাবে হয়রানির শিকার হয়ে একদিকে মানুষের ক্ষোভ বাড়ছে, অন্যদিকে আইন, শাসন ও বিচার ব্যবস্থার প্রতি তাদের আস্থা কমছে।
“সমাজে যে অস্থিরতা দেখা দিয়েছে, তার কারণ আইনের শাসনের ভঙ্গুর অবস্থা,” জানান জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান ড. মিজানুর রহমান খান।
তাঁর মতে, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, অফিস–আদালত, গ্রাম থেকে শহর–সব ক্ষেত্রেই সামাজিক অস্থিরতা দেখা দিয়েছে।
সবচেয়ে বড় পেশাজীবী গোষ্ঠী ক্ষুব্ধ
অষ্টম জাতীয় বেতন স্কেল ঘোষণার পর দেশের সবচেয়ে বড় পেশাজীবী গোষ্ঠী শিক্ষক সমাজ ক্ষুব্ধ। এঁদের মধ্যে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের ক্ষোভ সবচেয়ে বেশি, কারণ জাতীয় বেতন স্কেলে তাদের মর্যাদা অবনমন হয়েছে।
দেশের সরকারি প্রাথমিক ও মাধ্যমিক বিদ্যালয়, সরকারি কলেজের শিক্ষকেরাও খুশি নন, থেমে থেমে তাঁরা বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করছেন। সরকারি কলেজ শিক্ষকরাও কর্মবিরতি পালন করেছেন।
প্রাথমিক শিক্ষকেরা হুমকি দিয়েছেন বেতন বৈষম্য নিরসন না করা হলে তাঁরা আগামী নভেম্বরে অনুষ্ঠিতব্য প্রাথমিক সমাপনী পরীক্ষার দায়িত্ব পালন করবেন না, যেটি এ দেশের সবচেয়ে বড় পাবলিক পরীক্ষা।
“সরকার যখন কোনো সিদ্ধান্ত নেয়, তখন বিভিন্ন শ্রেণি ও পেশার মানুষের ওপর এর ভিন্ন ভিন্ন প্রভাব পড়ে। আলাপ–আলোচনার মাধ্যমে এসব সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে,” বেনারকে জানান শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ।
তিনি বলেন, শিক্ষকদের আশ্বস্ত করা হয়েছে, তারা ক্ষতিগ্রস্ত হবেন না। কিন্তু তারপরও তাঁরা যেন সময় দিতে চাইছেন না।
স্বস্তি ও শঙ্কা সরকারি চাকরিজীবীদের
গত ৭ সেপ্টেম্বর সরকার দেশের প্রায় ২১ লাখ সরকারি চাকরিজীবীর জন্য নতুন বেতনস্কেল ঘোষণা করে যেখানে মূল বেতন বাড়ে প্রায় দ্বিগুণ। কিন্তু এ নিয়ে অস্থিরতা ছড়িয়ে পড়েছে, অভিযোগ উঠেছে বৈষম্য সৃষ্টি করার।
নতুন জাতীয় বেতন স্কেলে প্রায় শতভাগ বেতন বৃদ্ধি পাওয়ায় সরকারি চাকরিজীবীদের মধ্যে যেমন স্বস্তি আছে, তেমনি টাইম স্কেল ও সিলেকশন গ্রেড তুলে দেওয়ায় তাঁদের অস্বস্তির মাত্রাও কম নয়। এত দিন তাঁরা পদোন্নতি না পেলেও নতুন গ্রেডের আর্থিক সুবিধা পেতেন এই দুটি বিশেষ ব্যবস্থা থাকার কারণে।
ইতিমধ্যে সচিবালয়ে কর্মচারীদের একটি সংগঠন হিসাব দিয়েছে, এই দুটি বিশেষ ব্যবস্থা তুলে দেওয়ায় ৬৫ শতাংশ কর্মচারী আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। কর্মকর্তা-কর্মচারীদের প্রায় সবগুলো সংগঠন বা সমিতি একযোগে টাইমস্কেল-সিলেকশন বাতিলের প্রতিবাদ জানিয়ে থেমে থেমে কর্মসূচি পালন করছে।
“সরকারকে সবার সুবিধার কথা মাথায় রেখে কাজ করতে হয়। নতুন বেতন স্কেল ঘোষণা করতে গিয়ে কোনো কোনো স্তরে কিছু ব্যতিক্রম হয়েছে। অর্থ মন্ত্রণালয় এ–সংক্রান্ত বিস্তারিত প্রজ্ঞাপন জারির সময় সমস্যাগুলো বিবেচনা করবে,” বেনারকে জানান মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের সচিব মোহাম্মদ মোশাররাফ হোসাইন ভূঁইয়া।
তবে সাধারণ থেকে বিশিষ্ট নাগরিক, সরকার সমর্থক থেকে সরকার বিরোধী ব্যক্তি—সবাই কমবেশি উদ্বিগ্ন বর্তমান পরিস্থিতিতে।
“সরকার একের পর এক গণবিরোধী সিদ্ধান্ত নিচ্ছে। দেশে এখন বিরোধী দল থেকেও নেই। তাই সাধারণ মানুষকে ঐক্য গড়ে তুলে তাদের অধিকার আদায় করে নিতে হবে,” বেনারকে জানান লেখক ও সাংবাদিক সৈয়দ আবুল মকসুদ।
তিনি বলেন, নাগরিক জীবনের সর্বস্তরে ক্ষোভ–হতাশা বাড়ছে, যা কমার লক্ষণ নেই। এই সংকট বাড়তে থাকলে নাগরিক জীবন আরও দুর্বিষহ হয়ে উঠবে।
“আমরা এতসব রাজনীতি, সমাজনীতি বুঝি না। কিন্তু সরকারের সিদ্ধান্তে জীবনের ওপর যেসব নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে তা বুঝতে পারি”, বেনারকে জানান ঢাকার কারওয়ানবাজার এলাকায় কর্মরত রাজমিস্ত্রী মো. নজরুল ইসলাম (৩২)।
তাঁর মতে, এমনিতেই নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের দাম বেড়েছে। তার ওপর গ্যাস ও বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর ফলে সবকিছুর ওপর এর প্রভাব পড়ছে। পরিবহন ভাড়া বেড়েছে। এতে জিনিসপত্রের দাম বাড়বে। বাড়িভাড়াও বেড়ে যাবে।