সীমাহীন নৃশংসতায় বাড়ছে সামাজিক অস্থিরতা

ঢাকা থেকে শাহরিয়ার শরীফ
2015.07.31
BD-violence মাগুরায় ছাত্রলীগের দুই পক্ষের গোলাগুলির সময় গুলিবিদ্ধ অন্তঃসত্তা মা নাজমা বেগমকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নামানোর সময়ে তোলা ছবি, ২৯ জুলাই।
বেনার নিউজ

বাংলাদেশে প্রায় প্রতিদিনই একাধিক নৃশংস ঘটনা ঘটছে, যা নিয়ে সামাজিক অস্থিরতা, মানুষের ক্ষোভ বা হাহাকার বাড়ছে।  

গত এক মাসের পত্রপত্রিকা ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম সরব থেকেছে একের পর এক নৃশংস ঘটনায়। একটি ঘটনার রেশ না কাটতেই নতুন আরেকটি ঘটনা ঘটেছে।

ইলেকট্রিক টেস্টার দিয়ে রবিউল স্ত্রী সুখী আক্তারের চোখ তুলে নেওয়া, বুকের মাঝখানে তিনটি ফুটো করে তরুণীকে হত্যা, চোর সন্দেহে কিশোর রাজনকে পিটিয়ে হত্যা করে সামাজিক মাধ্যমে ভিডিও আপলোড করা, ট্র্যাফিক জ্যামে পড়ায় ক্ষুব্ধ সাংসদের ছেলের গুলিতে তিনজন নিহত হওয়ার ঘটনায় হইচই চলছে দেশজুড়ে।

এরই মধ্যে সরকারি ছাত্রসংগঠন বাংলাদেশ ছাত্রলীগের দুই পক্ষের গোলাগুলিতে মাগুরায় গর্ভবতী নারী গুলিবিদ্ধ হলে অপরিপক্ব শিশুকে অস্ত্রোপচার করে ভূমিষ্ঠ করা, উত্তরায় তরুণীকে গণধর্ষণের ঘটনায় শুরু হয়েছে তোলপাড় অবস্থা।

মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিস কেন্দ্রের ২০১৫ সালে হিসাব বলছে, জানুয়ারি থেকে মার্চ, এই তিন মাসে ১২৩টি ধর্ষণের ঘটনায় ১৫টি ক্ষেত্রে ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে। ২০১৪ সালে প্রথম ছয় মাসের হিসাব বলছে, সারা দেশে ৬ মাসে ধর্ষণের শিকার হয়েছে ২৬৫জন। ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে ২৯জনকে। ধর্ষণের পর আত্মহত্যা করেছে ৭জন।

“গত কিছুদিন ধারাবাহিকভাবে আমরা ধর্ষণের খবর পাচ্ছি। যখন কোনো অপরাধী বা আমাদের বিপদগামী তরুণ প্রজন্ম মনে করে ধর্ষণ করলে শাস্তি পেতে হবে না, তখনই এই প্রবণতা বাড়ে,” সাংবাদিকদের জানান বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের সভাপতি আয়শা খানম।

চিকিৎসক, সামাজিক মনোচিকিৎসকেরা বলছেন, সহনশীলতার অভাব, নীতিবোধের চর্চা না থাকা এবং সুশাসনের অভাব আজকের পরিস্থিতির জন্য দায়ী। এর সবচেয়ে নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে শিশুদের ওপর।

“আমাদের কাছে আসা লাশগুলো সাক্ষ্য দেয়, মানুষের মধ্যে বিকৃতির বিস্তার কতটা হয়েছে। আগে ছুরি মেরে বা পিস্তল দিয়ে খুন করা হতো। এখন লাশ টুকরো করে বস্তাবন্দী করাসহ মৃতদেহকে নানাভাবে অসম্মান করার ঘটনা ঘটছে,” বেনারকে জানান বাংলাদেশ মেডিকোলিগ্যাল সোসাইটির সভাপতি ও সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজের ফরেনসিক মেডিসিন বিভাগের শিক্ষক সেলিম রেজা।

সুশাসনের অভাবে নৃশংসতার ঘটনা বাড়ছে কি না, সে সম্পর্কে পুলিশের বক্তব্য কিছুটা আলাদা।

“খুন-জখম-নির্যাতনের ঘটনা আগেও ঘটেছে। নানা কারণে শুধু এর ধরন বদলেছে,” জানান পুলিশের এআইজি ক্রাইম (অপরাধ দমন) আবদুর রাজ্জাক, যিনি পড়াশোনা করেছেন অপরাধ বিজ্ঞান বিষয়ে।

আবদুর রাজ্জাকের মতে, সমাজবিজ্ঞানী দুর্খেইম দেখিয়েছিলেন সমাজের অগ্রগতির পেছনে যে চালিকাশক্তিগুলো আছে তার সবগুলো যদি সুষমভাবে না আগায় তাহলে সমাজে অস্থিরতা দেখা দেয়। সামাজিক অস্থিরতা থেকে অপরাধ বাড়ে। হাতাহাতিতে যে ঘটনা শেষ হওয়ার কথা সেটি হত্যায় গড়ায়।


আরও কিছু রোমমহর্ষক ঘটনা

পত্রপত্রিকায় সাতক্ষীরায় দুটি শিশুকে গাছে বেঁধে পেটানোর খবর বেরিয়েছে। এ ছাড়া খুলনায় তরুণকে হত্যা করা হয়েছে হাতুড়ি দিয়ে পিটিয়ে।

২৫ জুন উত্তরায় ড্রেনে ভাসছিল তরুণীর লাশ। পুলিশের সুরতহাল রিপোর্টে দেখা গেল তরুণীর বুকের মাঝখানে ইলেকট্রিক টেস্টার দিয়ে তিনটি ছিদ্র করেছে খুনিরা। এ ঘটনায় কেউ আটক হয়নি। হত্যার কারণ জানে না পুলিশ।  

গত ২ জুলাই রংপুর মেডিকেল কলেজের জিয়া ছাত্রাবাসে চোর সন্দেহে সাব্বির হোসেন (২০) নামে এক যুবককে শিক্ষার্থীরা পিটিয়ে হত্যা করে। এ বিষয়ে মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ জাকির হোসেন বলেন, ‘বেশ কিছুদিন থেকে ওই ছাত্রাবাসের টেলিভিশন সহ জামাকাপড় চুরি হচ্ছিল। চোর সন্দেহে ছেলেটিকে মারধর করা হয়েছে’ (প্রথম আলো, ৪ জুলাই’১৫)।

“আমরা জানি, মেধাবী শিক্ষার্থীরা মেডিকেলে পড়ার সুযোগ পান। কিন্তু তাদের ওই নিষ্ঠুর আচরণে প্রমাণ হয়, যারা এ ঘটনা ঘটিয়েছে তাদের মেধার সঙ্গে মানবিক চেতনার সংযোগ নেই,” বেনারকে জানান মোশাররফ হোসেন মুসা, যিনি একটি বেসরকারি সংস্থার গণতন্ত্রায়ণ ও গণতান্ত্রিক স্থানীয় সরকার বিষয়ে গবেষক।

সর্বশেষ ৩১ জুলাই রাজধানীর উত্তরায় কর্মজীবী একজন তরুণী ধর্ষণের শিকার হন। বাসায় ফেরার পথে আরিফ নামে এক সহকর্মী এবং তার দুই সহযোগী মিলে মেয়েটিকে পালাক্রমে ধর্ষণ করে বলে পুলিশ জানায়।


মানুষকে ঘুড়ে দাঁড়াতে হবে

সামাজিক মনোচিকিৎসকেরা বলছেন, যখন একজন মানুষ দেখছে, অপরাধ করলে বিচার হয় না, বেশির ভাগ ক্ষেত্রে অপরাধীরাই পুরস্কৃত হয়, তখন তারা অপরাধ করতে ভয় পায় না।

“ইদানীং যেসব ঘটনা ঘটছে, সেগুলো খতিয়ে দেখলে বোঝা যায় কিছু মানুষের মধ্যে বিবেকের ঘাটতি আছে, অনুশোচনার কোনো বোধ নেই, অনেকেই স্যাডিস্ট। মানুষকে নির্যাতন করে এরা আনন্দ পায়,” বেনারকে জানান জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক তাজুল ইসলাম।

ওই চিকিৎসকের মতে, সমাজের ভালো মানুষ যদি ঘুরে দাঁড়ায় তাহলে এসব ঘটনাও কমে আসবে। ইভটিজিং, অ্যাসিড নিক্ষেপ কিন্তু মানুষই ঠেকিয়েছে। এই দুটি অপরাধপ্রবণতা নির্মূল না হলেও কমেছে।

ওই বক্তব্যের সঙ্গে একমত পোষণ করে মন্ত্রিসভায় সম্প্রতি নিয়োগপ্রাপ্ত ডাক ও টেলিযোগাযোগ প্রতিমন্ত্রী ও সাংস্কৃতিক কর্মী তারানা হালিম বেনারকে বলেন, কিছু সমস্যা ও ঝুঁকি থাকলেও মানুষকেই ঘুরে দাঁড়াতে হবে। নিজের জীবনে বেশ কয়েকটি ঘটনার প্রতিবাদ করার দৃষ্টান্ত তুলে ধরে তিনি বলেন, “শেষবিচারে আমার অবস্থানেরই বিজয় হয়েছে।”

সড়ক দুর্ঘটনার বিরুদ্ধে আন্দোলন করা মানবাধিকারকর্মী তারানা হালিম আরও বলেন, “সমাজে মূল্যবোধের চরম অবক্ষয় হয়েছে বলেই অমানবিকতা ও নিষ্ঠুরতা বেড়েছে। এ ক্ষেত্রে রাষ্ট্র বিচার করে দৃষ্টান্ত সৃষ্টি করতে পারে, কিন্তু পরিবারের দায়িত্বও অনেক বেশি”।




মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।