জামায়াতের আমির নিজামীর ফাঁসি বহাল, শহীদ পরিবারে স্বস্তি

ঢাকা থেকে শাহরিয়ার শরীফ
2016.01.06
BD-warcrimes জামায়াতে ইসলামীর আমির মতিউর রহমান নিজামীর ফাঁসির দণ্ড বহাল রাখায় শাহবাগে গণজাগরণ মঞ্চের কর্মিরা উল্লাস প্রকাশ করে।
বেনার নিউজ

মুক্তিযুদ্ধকালে বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ডের নীলনকশা বাস্তবায়নকারী গুপ্তঘাতক আলবদর বাহিনীর প্রধান ও জামায়াতে ইসলামীর আমির মতিউর রহমান নিজামীর ফাঁসির দণ্ড বহাল রেখেছেন দেশের সর্বোচ্চ আদালত।

এর প্রতিবাদে  বৃহস্পতিবার সারা দেশে সকাল-সন্ধ্যা শান্তিপূর্ণ হরতাল কর্মসূচি ঘোষণা করেছে দলটি। জামায়াত  প্রতিক্রিয়া জানালেও রাজনীতিতে দলটির সহযোগী বিএনপি কোনো প্রতিক্রিয়া  দেয়নি।

নিজামী ২০০১ থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের শিল্পমন্ত্রী ছিলেন। তার ফাঁসির রায়ে সন্তোষ প্রকাশ করেছে গণজাগরণ মঞ্চসহ বিভিন্ন  সংগঠন।

রায়ের প্রতিক্রিয়ায় আদালতের ভেতরে-বাইরে উপস্থিতদের স্বস্তি প্রকাশ করতে দেখা যায়, বিভিন্ন স্থানে শুরু হয় আনন্দ মিছিল।

এই রায় যখন হয়, ৭২ বছর বয়সী নিজামী তখন গাজীপুরের কাশিমপুর কারাগারে। সাবেক এই মন্ত্রী চট্টগ্রামের চাঞ্চল্যকর দশ ট্রাক অস্ত্র মামলারও মৃত্যুদণ্ডাদেশ পাওয়া আসামি।

'' আমরা দীর্ঘদিন ধরে এই রায়ের জন্য অপেক্ষা করেছি।  বাবাসহ লাখো মুক্তিযোদ্ধার রক্তের বিনিময়ে আনা লাল-সবুজের পতাকা এই নিজামীর গাড়িতে তুলে দেওয়া হয়েছিল,"  বেনারকে জানান শহীদ বুদ্ধিজীবী রাশিদুল হাসানের মেয়ে রোকাইয়া হাসিনা ।

বুধবার প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহার নেতৃত্বাধীন আপিল বিভাগের চার সদস্যের বেঞ্চ এই রায় ঘোষণা করেন।

২০১২ সালের ২৮ মে ট্রাইব্যুনাল নিজামীর বিরুদ্ধে ১৬টি অভিযোগ গঠন করে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলার বিচার শুরু করেন।

২০১৪ সালের ২৯ অক্টোবর এই মামলার রায়ে নিজামীকে ফাঁসির আদেশ দেন ট্রাইব্যুনাল।

আপিল বিভাগ তিনটি অভিযোগে নিজামীর ফাঁসি বহাল রেখেছেন। দুটি অভিযোগে তাঁর যাবজ্জীবন কারাদণ্ড বহাল রাখা হয়েছে। ফাঁসির সাজার একটি অভিযোগসহ তিনটি অভিযোগ থেকে তাঁকে খালাস দেওয়া হয়েছে।

" এই রায় একদিকে জাতিকে দায়মুক্ত করেছে, অন্যদিকে শহীদ পরিবারগুলোর জন্য ন্যায়বিচার নিয়ে এসেছে,"  প্রতিক্রিয়ায়  বেনারকে জানান শহীদ মুনির চৌধুরীর ছোট ছেলে আসিফ মুনীর ।

আসিফ মুনীর বলেন,  "বুদ্ধিজীবী হত্যায় আরও যারা জড়িত ছিল, যারা এখন বিদেশে পলাতক তাদেরও বিচারের আওতায় আনতে হবে।"

ট্রাইব্যুনালে নিজামীর বিরুদ্ধে ১৬টি অভিযোগের মধ্যে আটটি প্রমাণিত হয়। এর মধ্যে বুদ্ধিজীবী হত্যা, গণহত্যাসহ চারটি অভিযোগে (২, ৪, ৬ ও ১৬) নিজামীকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়।

হত্যা, অপহরণ ও নির্যাতনের মতো মানবতাবিরোধী অপরাধের ষড়যন্ত্র ও সহযোগিতা করার চারটি অভিযোগে (১, ৩, ৭ ও ৮) তাঁকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেওয়া হয়। বাকি আটটি অভিযোগ প্রমাণিত না হওয়ায় সেগুলো থেকে তাঁকে খালাস দেন ট্রাইব্যুনাল।

আপিলে পাঁচটি অভিযোগে (২, ৬, ৭, ৮ ও ১৬) নিজামীর সাজা বহাল রেখেছেন সর্বোচ্চ আদালত। এর মধ্যে ২, ৬ ও ১৬ নম্বর অভিযোগে মৃত্যুদণ্ড এবং ৭ ও ৮ নম্বর অভিযোগে তাঁর যাবজ্জীবন কারাদণ্ড বহাল রেখেছেন আপিল বিভাগ। আপিলে তিনটি অভিযোগ (১, ৩ ও ৪) থেকে তাঁকে খালাস দেওয়া হয়েছে।

গত ৮ ডিসেম্বর নিজামীর আপিলের ওপর দুই পক্ষের যুক্তি উপস্থাপন শেষ হয়। এরপর আপিল বিভাগ রায় ঘোষণার তারিখ ৬ জানুয়ারি ধার্য করেন।

নিজামীর আপিলের রায়টি জামায়াতের শীর্ষস্থানীয় নেতাদের বিরুদ্ধে পঞ্চম রায়। অপর চারটি রায় হয়েছে দলটির সেক্রেটারি জেনারেল আলী আহসান মোহাম্মাদ মুজাহিদ, নায়েবে আমির দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী, দুই সেক্রেটারি জেনারেল মুহাম্মদ কামারুজ্জামান ও আবদুল কাদের মোল্লার বিরুদ্ধে।

এঁদের মধ্যে রায়ে ফাঁসি বহাল থাকায় মুজাহিদ, কামারুজ্জামান ও কাদের মোল্লার দণ্ড কার্যকর হয়েছে। সাঈদীর আমৃত্যু কারাদণ্ডের পূর্ণাঙ্গ রায় ৩১ ডিসেম্বর প্রকাশিত হয়েছে।

ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দেওয়ার অভিযোগে করা এক মামলায় ২০১০ সালের ২৯ জুন নিজামীকে গ্রেপ্তার করা হয়। একই বছরের ২ আগস্ট তাঁকে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় গ্রেপ্তার দেখানো হয়।

রায়ে ট্রাইব্যুনাল বলেন, একাত্তরে নিজামী ছিলেন জামায়াতের তৎকালীন ছাত্রসংগঠন ইসলামী ছাত্রসংঘের সভাপতি। ছাত্রসংঘই পরে আলবদর বাহিনীতে পরিণত হয়, আর গুপ্তঘাতক আলবদর বাহিনীই মুক্তিযুদ্ধের শেষ দিকে পাকিস্তানি সেনাদের সঙ্গে মিলে বুদ্ধিজীবী নিধন চালায়। আলবদর বাহিনীর অপরাধ ও কৃতকর্মের দায়-দায়িত্ব নেতা হিসেবে নিজামীর ওপর বর্তায়।

ট্রাইব্যুনাল বলেন, অথচ এটা বিশ্বাস করতেই কষ্ট হয়, স্বাধীনতার সক্রিয় বিরোধিতাকারী এমন এক ব্যক্তিকে এই রাষ্ট্রের মন্ত্রী করা হয়েছিল। তাঁকে মন্ত্রী হিসেবে নিয়োগ করা ছিল তৎকালীন সরকারের গুরুতর ভুল এবং মুক্তিযুদ্ধের ৩০ লাখ শহীদ ও সম্ভ্রমহারা দুই লাখ নারীর গালে সরাসরি চপেটাঘাত। এ ধরনের লজ্জাজনক কাজ গোটা জাতির জন্য অবমাননাকর।


এখন যা হবে

নিয়ম অনুযায়ী, সুপ্রিম কোর্ট এই রায়ের পূর্ণাঙ্গ অনুলিপি প্রকাশের পর তা ট্রাইব্যুনালে পাঠানো হবে। সেটি হাতে পেলে মৃত্যু পরোয়ানা জারি করবে ট্রাইব্যুনাল। সেই মৃত্যু পরোয়ানা ফাঁসির আসামিকে পড়ে শোনাবে কারা কর্তৃপক্ষ।

পূর্ণাঙ্গ অনুলিপি প্রকাশের ১৫ দিনের মধ্যে রায় পুনর্বিবেচনার (রিভিউ) আবেদন করতে পারবে আসামিপক্ষ। তবে রিভিউ যে আপিলের সমকক্ষ হবে না, তা যুদ্ধাপরাধে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত জামায়াত নেতা আবদুল কাদের মোল্লার ‘রিভিউ’ খারিজের পূর্ণাঙ্গ রায়েই স্পষ্ট করা হয়েছে।

রিভিউ আবেদনের নিষ্পত্তি হয়ে গেলে এবং তাতে মৃত্যুদণ্ড বহাল থাকলে আসামিকে তা আনুষ্ঠানিকভাবে জানিয়ে সংবিধান অনুযায়ী রাষ্ট্রপতির কাছে প্রাণভিক্ষার সুযোগ দেওয়া হবে। তিনি স্বজনদের সঙ্গে দেখাও করতে পারবেন।

রাষ্ট্রপতির ক্ষমার বিষয়টি ফয়সালা হয়ে গেলে সরকার কারা কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে সেই সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করবে।


জামায়াত হরতাল ডেকেছে

একাত্তরে মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে মতিউর রহমান নিজামীর মৃত্যুদণ্ডাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগে বহাল থাকায় প্রতিবাদ জানিয়েছে তার দল বাংলাদেশ জাময়াতে ইসলামী।

বৃহস্পতিবার সারা দেশে সকাল-সন্ধ্যা শান্তিপূর্ণ হরতাল কর্মসূচি ঘোষণা করেছে দলটি।

বুধবার জামায়াতে ইসলামীর ভারপ্রাপ্ত আমির মকবুল আহমাদ ও ভারপ্রাপ্ত সেক্রেটারি জেনারেল ডা. শফিকুর রহমান স্বাক্ষরিত এক বিবৃতিতে এই হরতালের ঘোষণা দেওয়া হয়।

বিবৃতিতে বলা হয়, "সরকার পরিকল্পিতভাবে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর আমির, সাবেক মন্ত্রী, আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন ইসলামি চিন্তাবিদ ও ২০ দলীয় জোটের অন্যতম শীর্ষ নেতা মাওলানা মতিউর রহমান নিজামীকে হত্যার উদ্দেশ্যে তথাকথিত মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে মিথ্যা মামলা দায়ের করে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত করার চেষ্টা করেছে।"

এর তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানিয়ে বৃহস্পতিবার সারা দেশে সকাল-সন্ধ্যা শান্তিপূর্ণ হরতাল কর্মসূচি ঘোষণা করা হয়েছে।

সরকার জামায়াতে ইসলামীকে নেতৃত্বশূন্য করার জন্য মতিউর রহমান নিজামীসহ শীর্ষ নেতাদের বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে মিথ্যা মামলা দায়ের করেছে বলেও অভিযোগ করা হয়।

বিবৃতিতে আরও বলা হয়, মতিউর রহমান নিজামীর বিরুদ্ধে সরকারের পক্ষ থেকে যে সব অভিযোগ উত্থাপন করা হয়েছে তা সম্পূর্ণ মিথ্যা, ভিত্তিহীন, বানোয়াট ও কাল্পনিক।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।