এবার নিজামীর ফাঁসির দিনক্ষণ এগিয়ে আসছে

ঢাকা থেকে শাহরিয়ার শরীফ
2016.03.15
BD-warcrimes বুদ্ধিজীবী হত্যার নীলনকশা বাস্তবায়নে ভূমিকাসহ তিন অভিযোগে মতিউর রহমান নিজামীর মৃত্যুদণ্ড বহালের রায় দেন সর্বোচ্চ আদালত।
অনলাইন

মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় আলবদর বাহিনীর শীর্ষ নেতা ও জামায়াতে ইসলামীর আমির মতিউর রহমান নিজামীর ফাঁসি কার্যকরের প্রক্রিয়া শুরু হয়ে গেছে। আপিল বিভাগ গতকাল মঙ্গলবার রায়ের পূর্ণাঙ্গ অনুলিপি প্রকাশ করায় ৩০ মার্চের মধ্যে তিনি রিভিউ আবেদনের সুযোগ পাবেন।

এদিকে রিভিউ আবেদন করে শুনানির অপেক্ষায় আছে আমৃত্যু কারাদণ্ডের সাজা পাওয়া জামায়াতের নায়েবে আমির দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর মামলা।

আইনজীবীরা বলছেন, নিজামীর ফাঁসি ২৬ মার্চ স্বাধীনতা দিবসের আগে কার্যকর হওয়ার সুযোগ নেই। আইনি প্রক্রিয়া শেষে এপ্রিলের প্রথমে ফাঁসি কার্যকর করা সম্ভব বলে আইনজীবীরা মনে করছেন।

আসামিপক্ষ পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশের ১৫ দিনের মধ্যে পুনর্বিবেচনার (রিভিউ) জন্য আবেদন করার সুযোগ পেয়ে থাকে। নিজামীর পক্ষেও সেই আবেদন করা হবে বলে জানিয়েছেন তাঁর আইনজীবী।

মঙ্গলবার বিকেলে সুপ্রিম কোর্টের রেজিস্ট্রার কার্যালয় রায়ে বিচারকদের সই করার বিষয়টি নিশ্চিত করেন । রাতেই পূর্ণাঙ্গ রায়ের অনুলিপি সুপ্রিম কোর্ট থেকে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে পৌঁছেছে।

“রায় পুনর্বিবেচনা (রিভিউ) চেয়ে আবেদন করার জন্য ১৫ দিন সময় পাবেন নিজামী। বুধবার থেকে এই দিনগণনা শুরু হবে,” রায় প্রকাশের পর বেনারকে জানান অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম।

অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, যদি ১৫ দিনের মধ্যে নিজামী রিভিউ আবেদন না করেন, তবে আইন অনুসারে দণ্ড কার্যকর প্রক্রিয়া শুরু করবে সরকার। আর যদি সময়মতো রিভিউ আবেদন করা হয়, তবে রায়ের কার্যকারিতা স্থগিত থাকবে।


আনুষ্ঠানিকতা শুরু

আপিল বিভাগের চূড়ান্ত রায় ঘোষণার প্রায় আড়াই মাস পর গতকাল বিকেলে নিজামীর মামলার পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশিত হয়।

“পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশিত হয়েছে। এখন তা কার্যকর করতে আইনি প্রক্রিয়া অনুসরন করা হবে,” বেনারকে জানান আপিল বিভাগের অতিরিক্ত রেজিস্ট্রার অরুনাভ চক্রবর্তী।

আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে পাঠানোর পাশাপাশি এই রায় সুপ্রিম কোর্টের ওয়েবসাইটেও প্রকাশ করা হবে। ট্রাইব্যুনালে উপস্থাপন করার পর প্রত্যয়িত কপি পাঠানো হবে কারা কর্তৃপক্ষ ও জেলা ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে। নিয়ম অনুসারে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কেও বিষয়টি অবহিত করা হবে।

এরপর আসামি রাষ্ট্রপতির কাছে প্রাণভিক্ষার আবেদন করতে পারবেন। তিনি স্বজনদের সঙ্গে দেখা করার সুযোগ পাবেন।

২০১৪ সালের ২৯ অক্টোবর নিজামীকে ফাঁসির আদেশ দিয়ে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল বলেছিলেন, নিজামী যে ঘৃণ্য অপরাধ করেছেন, মৃত্যুদণ্ড ছাড়া আর কোনো সাজা তাঁর জন্য যথেষ্ট নয়। ট্রাইব্যুনালের ওই রায়ের বিরুদ্ধে নিজামী আপিল বিভাগে যান।

শুনানিতে নিজামীর আইনজীবীরা তাঁকে ফাঁসি ছাড়া যে কোনো দণ্ড দেওয়ার পক্ষে মত দিয়েছিলেন।  

গত ৬ জানুয়ারি ট্রাইব্যুনালের দেওয়া সর্বোচ্চ দণ্ড বহাল রাখেন আপিল বিভাগ। এ মামলায় নিজামীর বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষ যে ১৬টি অভিযোগ আনে, ট্রাইব্যুনালে তাঁর মধ্যে আটটি প্রমাণিত হয়।


বুদ্ধিজীবী হত্যার তিন অভিযোগে ফাঁসি

বুদ্ধিজীবী হত্যার নীলনকশা বাস্তবায়নে ভূমিকাসহ তিন অভিযোগে মতিউর রহমান নিজামীর মৃত্যুদণ্ড বহালের রায় দেন সর্বোচ্চ আদালত। এতে বলা হয়, মহান মুক্তিযুদ্ধে বাঙালি জাতিকে মেধাশূন্য করতে তাঁর ভুমিকা প্রমাণিত হয়েছে।

গত ৬ জানুয়ারি প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহার নেতৃত্বে চার সদস্যের আপিল বেঞ্চ এই রায়ের সংক্ষিপ্তসার প্রকাশ করেন। গতকাল পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশ হয়েছে।

বেঞ্চের অপর তিন সদস্যদের মধ্যে রয়েছেন বিচারপতি নাজমুন আরা সুলতানা, বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন ও বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকী।

একাত্তরের ১০ মে বেলা ১১টার দিকে পাবনার সাঁথিয়া উপজেলার বাউশগাড়ি গ্রামের রূপসী প্রাথমিক বিদ্যালয়ে একটি সভা হয়। ওই সভার সিদ্ধান্তে ১৪ মে ভোর সাড়ে ৬টার দিকে বাউশগাড়ি, ডেমরা ও রূপসী গ্রামের প্রায় সাড়ে ৪০০ মানুষকে পাকিস্তানি সেনারা হত্যা করে। প্রায় ৩০-৪০ জন নারীকে সেদিন ধর্ষণ করে পাকিস্তানি সেনা ও রাজাকার বাহিনীর সদস্যরা।

নিজামীর নির্দেশে ১৯৭১ সালের ২৭ নভেম্বর পাবনার ধুলাউড়ি গ্রামের ডা. আব্দুল আউয়াল ও তার আশেপাশের বাড়িতে হামলা চালিয়ে নারী, পুরুষ ও শিশুসহ ৫২ জনকে হত্যা করা হয়।

এ ছাড়া মুক্তিযুদ্ধে বাঙালির বিজয়ের উষালগ্নে অসংখ্য বুদ্ধিজীবীকে হত্যা করে আলবদর বাহিনী। জামায়াতের তৎকালীন ছাত্রসংগঠন ইসলামি ছাত্রসংঘ ও আলবদর বাহিনীর প্রধান হিসেবে ওই গণহত্যার দায় নিজামীর ওপর পড়ে।


সাতজনের আপিল নিষ্পত্তি

যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনালে দণ্ডিতদের মধ্যে এ নিয়ে মোট সাতজনের আপিলের নিষ্পত্তি শেষে পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশিত হয়ে রিভিউয়ের পর্যায়ে এল।

এর আগে আপিল বিভাগের রায়ে ফাঁসি কার্যকর হয়েছে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী, জামায়াতের সেক্রেটারি জেনারেল আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ, দুই সেক্রেটারি জেনারেল মুহাম্মদ কামারুজ্জামান ও আবদুল কাদের মোল্লার।

আপিলের রায়ে আমৃত্যু কারাদণ্ড ভোগ করছেন জামায়াতের নায়েবে আমির দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী।

সম্প্রতি জামায়াত নেতা মীর কাসেমের মৃত্যুদণ্ড বহাল রাখেন আপিল বিভাগ। গতকাল জামায়াতের আমির মতিউর রহমান নিজামীর ফাঁসির আদেশের পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশ হলো।


নেতৃত্বে ছিলেন নিজামী

রাষ্ট্রপক্ষের দাখিল করা বিভিন্ন নথি এবং মৌখিক সাক্ষ্য অনুযায়ী, একাত্তরের মে মাসে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর বাঙালি নিধনযজ্ঞে যোগ দেয় জমিয়তে তলাবা (জামায়াতের তৎকালীন ছাত্রসংগঠন ইসলামি ছাত্র সংঘ)। মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতিহত করার জন্য ছাত্র সংঘ দুটি আধা সামরিক জঙ্গি বাহিনী গঠন করে: আলবদর ও আলশামস।

এর মধ্যে আলবদরে যোগ দেয় জমিয়তে তলাবার বিপুলসংখ্যক সদস্য। এই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন মতিউর রহমান নিজামী, তখন তিনি ছিলেন জমিয়তের নাজিম-এ-আলা (প্রধান)।

১৯৬৬ থেকে ১৯৬৯ সাল পর্যন্ত নিজামী ছিলেন পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র সংঘের সভাপতি, এরপর তিনি নিখিল পাকিস্তান ছাত্র সংঘের সভাপতি হন। ১৯৭১ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত নিজামী ছাত্র সংঘের প্রধান ছিলেন।

নিজামী এখন কাশিমপুর কারাগারে আছেন।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।