বর্ষবরণের দিনে যৌন হয়রানির ঘটনায় সমালোচনার ঝড়, শাস্তি দাবি
2015.04.16

বাংলা নববর্ষের দিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এসে যৌন হয়রানির শিকার হয়েছেন কয়েকজন নারী। ১৪ এপ্রিল বিকেলে বিশ্ববিদ্যালয়ের সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের গেটে এই ঘটনা ঘটে।
এ ঘটনায় নিন্দা ও প্রতিবাদের ঝড় উঠেছে ছাত্র, নারী, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলোর মধ্যে। স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে ১৬ এপ্রিল রুল দিয়েছেন হাইকোর্ট।
“কয়েকটি দৈনিকে প্রকাশিত এ সংক্রান্ত প্রতিবেদন আদালতের নজরে আনেন দুজন নারী আইনজীবী। পরে আদালত রুলে জানতে চান, এ ঘটনার জন্য দায়ীদের বিরুদ্ধে কেন শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হবে না,” বেনারকে জানান ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল তাপস কুমার বিশ্বাস।
স্বরাষ্ট্রসচিব, পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজিপি), ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) কমিশনার, পুলিশের রমনা বিভাগের উপকমিশনার, শাহবাগ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যকে রুলের জবাব দিতে বলা হয়েছে।
এ ছাড়া ঘটনা তদন্ত করে ১৭ মের মধ্যে তদন্ত প্রতিবেদন দাখিলের জন্য আইজিপি ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
“আমরা হাইকোর্টে প্রতিবেদন দেব। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে বিষয়টি জানিয়েছি। তারা তদন্ত করবে, দোষীদের বের করে শাস্তির আওতায় আনবে। পাশাপাশি বিশ্ববিদ্যালয়ের যৌন হয়রানি প্রতিরোধ কমিটি তদন্ত করবে,” বেনারকে জানান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক।
নিপীড়নকারীদের ঠেকাতে গিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র ইউনিয়ন শাখার সভাপতি লিটন নন্দীর হাত ভেঙেছে। অভিযোগ উঠেছে, পুলিশ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টরকে এই ঘটনা জানানো হলেও তাঁরা যথাসময়ে ব্যবস্থা নেননি।
‘‘আপনারা বলেছেন পুলিশ ছিল না। কিন্তু পুলিশ তার ডিউটি পালন করছে। যে ঘটনাটি ঘটেছে তার পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে তদন্ত করছি। যেখানে ঘটনাটি ঘটেছে সেখানে সিসিটিভি ছিল। যারা এ ঘটনা ঘটিয়েছে তাদের আইনের আওতায় আনা হবে," বেনারকে জানান রমনা জোনের পুলিশের সহ-সহকারী কমিশনার আব্দুল বাতেন।
নারীর শ্লীলতাহানির জন্য সরকারি দলের ছাত্রসংগঠন ছাত্রলীগকে দায়ী করেছে বিএনপির অঙ্গসংগঠন ছাত্রদল। ১৬ এপ্রিল এক বিবৃতিতে সংগঠনের সভাপতি রাজিব আহসান ও সাধারণ সম্পাদক আকরামুল হাসান বলেন, বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় এমন ন্যক্কারজনক ঘটনায় দেশের মানুষ স্তম্ভিত।
বিবৃতিতে আরও বলা হয়, নিরাপত্তার চাদরে ঘেরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় পুলিশের সামনেই এ ধরনের ঘটনা এ দেশের নারী সমাজের ওপর বড় আঘাত। অবাক করা ব্যাপার দুই নিপীড়নকারীকে ধরে পুলিশে দিলেও ছাত্রলীগ পরিচয়ে তাদের ছেড়ে দেয়।
অন্যদিকে বাংলাদেশ ছাত্রলীগ অতি দ্রুত অপরাধীদের আইনের আওতায় এনে শাস্তির মুখোমুখি করতে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ও পুলিশ প্রশাসনের নিকট জোরালো দাবি জানিয়েছে। ছাত্রলীগ নেতারা মনে করেন, যারা অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ চায়না, সাম্প্রদায়িকতার বিষবাস্প সমাজ-রাষ্ট্রে ছড়িয়ে দিতে চায় তারা হীন উদ্দেশ্য চরিতার্থ করার জন্য বাঙালি জাতিসত্তার প্রাণের অস্তিত্ব এ নববর্ষে কালিমা লেপন করার চেষ্টা করতে পারে।
ঘটনার বর্ণনা দিতে গিয়ে ছাত্র ইউনিয়ন নেতা লিটন নন্দী বলেন, “এ দৃশ্য বর্ণনা করা যায় না। আমি আমার পাঞ্জাবি খুলে এক নারীকে দিয়েছিলাম। আরেকটি মেয়ে অজ্ঞান হয়ে পড়েছিল। আমরা পুলিশ সদস্য ও প্রক্টরকে ঘটনা জানালেও তাঁরা কেউ যথাসময়ে আসেনি।”
ঘটনার প্রতিবাদে ১৫ ও ১৬ এপ্রিল ক্যাম্পাসে মিছিল-সমাবেশ করেছে ছাত্র ইউনিয়ন ও প্রগতিশীল ছাত্র জোটসহ বিভিন্ন ছাত্রসংগঠন। এসব সংগঠন অভিযোগ করেছে, পুলিশ ও বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের দায়িত্ব হীনতার কারণেই যেকোনো উৎসবের দিনে এই ধরনের ঘটনা ঘটে।
“ছাত্র ইউনিয়নের নেতারা আমাকে খবর দেওয়ার পর পরই আমি পুলিশকে সোহরাওয়ার্দীর গেট বন্ধ করা ও এ বিষয়ে ব্যবস্থা নিতে বলেছি। আমরা পুলিশকে বলেছি সিসিটিভির ফুটেজ দেখে এ বিষয়ে ব্যবস্থা নিতে,” বেনারকে জানান বিশ্ববিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত প্রক্টর আমজাদ আলী।
ফেব্রুয়ারি মাসে ব্লগার অভিজিৎ যেখানে খুন হন তার পাশেই সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের গেটেই এই ঘটনা ঘটে। বিশ্ববিদ্যালয়ের একাধিক ছাত্র অভিযোগ করেন, সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের গেট এবং এর ভেতরে প্রায়ই এ ধরনের ঘটনা ঘটে। এসব ব্যাপারে প্রশাসনের ব্যবস্থা নেওয়া উচিত। একই সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদেরও এসব প্রতিরোধে এগিয়ে আসা উচিত।
ছাত্র ইউনিয়নের নেতারা বলেন, ঘটনাস্থলে ক্লোজ সার্কিট ক্যামেরা ছিল বলে পুলিশ দাবি করেছে। কাজেই সেগুলো দেখে যেন দ্রুত দুষ্কৃতকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়।
জানতে চাইলে ঢাকা মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত উপকমিশনার (গণমাধ্যম ও জনসংযোগ) বিভাগের জাহাঙ্গীর আলম সরকার বলেন, “ঘটনাস্থলে সিসিটিভি ছিল। সেটা দেখে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।”
“এ ধরনের পৈশাচিক ঘটনা জাতির জন্য অত্যন্ত লজ্জা ও কষ্টের,” দিনাজপুরে অবস্থানরত সংস্কৃতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূর সাংবাদিকদের এ কথা জানিয়েছেন। তীব্র ক্ষোভ ও ঘৃণা প্রকাশ জানিয়ে মন্ত্রী ঘটনার সঙ্গে জড়িত লোকজনকে খুঁজে বের করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি জানান।
বিশ্ববিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত প্রক্টর এ এম আমজাদ বলেন, “যে সময়ের বর্ণনা দেওয়া হয়েছে তার এক ঘণ্টার সিসিটিভি ভিডিও ফুটেজ আমরা দেখেছি। কিন্তু সেখানে এই রকম বীভৎস ঘটনা দেখলাম না। আবার আলোক স্বল্পতার কারণে ভিডিওগুলো ভালো মতো বুঝাও যাচ্ছিল না।”
নারী ও কন্যাশিশুর ওপর হামলা ও যৌন নিপীড়নের প্রতিবাদে মানববন্ধন করেছে সামাজিক প্রতিরোধ কমিটি। গতকাল বৃহস্পতিবার বিকেলে জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে এ মানববন্ধন হয়।
“সমগ্র বাঙালি জাতি যখন একটি উৎসব, উদ্দীপনার মধ্য দিয়ে নানা আয়োজনে নববর্ষ উৎসব পালন করছে সেইরকম একটি দিনে উন্মুক্ত স্থানে নারী ও কন্যাশিশুর প্রতি সহিংসতার এই ঘটনা দেশে নারীর নিরাপত্তা কতটা হুমকির সম্মুখীন তা আজ চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছে,” জানান বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি ফওজিয়া মোসলেম।
ঐতিহ্যবাহী একটি উৎসবে যোগ দিতে আসা নারীদের সঙ্গে এমন আচরণ চরম নিন্দনীয়। যারা এই ঘটনা ঘটিয়েছে তাদের চিহ্নিত করে কঠোর শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিতে হবে," এক বিবৃতিতে জানান আইন ও সালিস কেন্দ্রের নির্বাহী পরিচালক সুলতানা কামাল।