বাংলাদেশে নারী শ্রমিকেরা মজুরি বৈষম্যের শিকার
2015.07.01
কৃষি-শিল্প-নির্মাণ খাত ও গার্মেন্টস সহ প্রায় সকল ক্ষেত্রে নারী শ্রমিকের অবদান বেড়ে যাওয়া সত্তেও তা্দেরকে পুরুষের সমান পারিশ্রমিক ও মর্যাদা দেয়া হচ্ছে না। সেইসঙ্গে গৃহশ্রমিকের অধিকাংশই কোনো বেতন পান না।
চার দশক আগে ১৯৭৫ সালে আন্তর্জাতিক শ্রমিক সম্মেলনে নারী শ্রমিকদের প্রতি সমআচরণ ও সমান সুযোগের ‘আইএলও’ ঘোষণা গৃহীত হলেও নারী শ্রমিকরা কার্যত সেই সুবিধা ভোগ করতে পারছেন না।
পুরুষ শ্রমিকের সমান, এমনকি কিছু ক্ষেত্রে তার চেয়ে বেশি শ্রম দিয়েও নারী শ্রমিকেরা পুরুষ শ্রমিকের চেয়ে কম পারিশ্রমিক পাচ্ছেন ।
বেসরকারি সংস্থা অক্সফামের হিসাবে, গত এক দশকে শ্রমবাজারে নারী শ্রমিকের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে প্রায় অর্ধ কোটি। যার ৭৭ শতাংশই গ্রামীণ নারী শ্রমিক। আর এদের অধিকাংশই মজুরি বৈষম্যের শিকার।
জানা যায়, ইটভাটা, পোশাক শিল্প, কৃষিকাজ, গৃহশ্রম, নির্মাণ কাজ ও চাতালের কাজসহ অপ্রাতিষ্ঠানিক কোনো কাজেই নারীরা পুরুষের সমান মজুরি পান ন। ঢাকার বাইরে এ বিভেদ আরও প্রকট। পুরুষদের তুলনায় নারীরা ১০০ থেকে ৫০ টাকা কম মজুরি পান।
“এ নিয়ে ম্যানেজার বা দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তিকে অভিযোগ জানালে আমাদের কাজ থেকে বের করে দেওয়ার হুমকি দেওয়া হয়,” জানান ঢাকার নিউমার্কেট এলাকার একজন শ্রমিক যিনি মঙ্গলবার রাস্তা খোড়ার পর ঝুড়িতে করে মাটি সরাচ্ছিলেন। তিনি জানান, এ নিয়ে কথা বললে ঠিকাদার কাল থেকে কাজে আসতে নিষেধ করবেন।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক আনু মোহাম্মদ বলেন, “নারী শ্রম সস্তা বলে মুনাফা বৃদ্ধির জন্য মালিকরা নারী শ্রমিকদের নিয়োগ দেন। দিনমজুর থেকে সব ধরনের অপ্রাতিষ্ঠানিক কাজে নারী শ্রমিকদের অংশগ্রহণ বেশি। তাদের বিষয়ে নজর দেওয়া গেলে জাতীয় উন্নয়ন ও অথর্নীতিতে এর ইতিবাচক প্রভাব পড়বে”।
তিনি জানান, জাতীয় ন্যূনতম মজুরি কাঠামো না থাকার সুযোগে নারীদের কম মজুরি দিয়ে বঞ্চিত করা হচ্ছে। এ বিষয়ে তদারকির প্রয়োজন আছে। তা না হলে নারী ও পুরুষ শ্রমিকের মধ্যে বৈষম্য কমবে না।
ওয়ার্ল্ড ভিশন বাংলাদেশ ও স্টেপস টুয়ার্ডস ডেভেলপমেন্টের যৌথ এক গবেষণাপত্রে বলা হয়, “নারীর জন্য অর্থনৈতিক ন্যায্যতা’ থেকে জানা যায়, শতকরা ৬১ জন নারী শ্রমিক দৈনিক ১০০ টাকা থেকে ২০০ টাকা পর্যন্ত মজুরি পেয়ে থাকেন এবং শতকরা ৩২ জন দৈনিক ১০০ টাকার কম মজুরি পান”।
অন্যদিকে, শতকরা ৫৬ জন পুরুষ শ্রমিক ২০০ থেকে ৪০০ টাকা পর্যন্ত মজুরি পান। শহরে উৎপাদনমুখী কারখানা, পোশাক খাত, খাদ্য ও কোমল পানীয় তৈরি, বিড়ি শিল্প ইত্যাদিতে কম মূল্যে শ্রম পাওয়া যায় বলেই নারী শ্রমিকদের নিয়োগ দেয়া হয় বেশি।
তবে গার্মেন্টস খাতে অবস্থা এখন তুলনামূলক ভালো। ৩৫ লক্ষ নারী শ্রমিক সহ ৪২ লক্ষ গামের্ন্টস শ্রমিক অথর্নীতির চাকা সচল রেখেছে। সেখানে মজুরি বৈষম্য কম।
পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্যমতে, দেশে ৫ থেকে ১৭ বছর বয়সী প্রায় ২০ লাখ গৃহশ্রমিক কাজ করছেন। যার অর্ধেকের বেশি বেতন পান না।
ঢাকার একটি বাসায় গৃহশ্রমের জন্য একজন নারীকে যেখানে থাকা-খাওয়াসহ আড়াই থেকে সাড়ে তিন হাজার টাকা দেওয়া হয় সেখানে একজন পুরুষ যদি বাড়ির কেয়ারটেকারের দায়িত্ব পালন করেন তবে তাকে ৬-৭ হাজার টাকা দেওয়া হয়।
কৃষিতে নারীর অংশগ্রহন বেড়েছে
কৃষিক্ষেত্রেও নারীরা বঞ্চনার শিকার। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরে পুরুষ কৃষকের জন্য সুনির্দিষ্ট ডাটাবেজ থাকলেও নারী কৃষকদের নেই। রাষ্ট্রীয় প্রণোদনার অংশ হিসেবে ১ কোটি ৩৯ লাখ ‘কৃষক কার্ড’ বিতরণ করা হয়েছে।
শ্রমশক্তি জরিপের তথ্য অনুযায়ী, গত এক দশকে যেখানে কৃষিক্ষেত্রে পুরুষের অংশগ্রহণ কমেছে, সেখানে নারীর অংশগ্রহণ বেড়েছে। মাঠভিত্তিক কৃষিকাজ ও গৃহভিত্তিক কৃষিকাজ—এ দুটি পর্যায়েই নারীর অংশগ্রহণ বৃদ্ধি পেলেও বাস্তবে কৃষিতে নারীর অবদান এখন পর্যন্ত স্বীকৃতি পায়নি।
“কৃষি খাতের ২১টি কাজের ধাপের মধ্যে নারীর অংশগ্রহণ ১৭টিতে, অথচ কৃষিকাজে নারীর স্বীকৃতি নেই বললেই চলে,” বেনারকে জানান কর্মজীবী নারীর সভাপতি শিরীন আখতার।
তারমধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে, জমি প্রস্তুত করা, সার ফেলা, বীজ বপন, আগাছা বাছাই, সেচ। ফসল কাটার পর ফসল উত্তরণ প্রক্রিয়ায় মাড়াই, বাছাই, শুকানো ও আহারযোগ্য করে তোলার কাজের বেশির ভাগ দায়িত্বই পালন করেন নারী। এ ছাড়া কৃষির অবিচ্ছেদ্য অংশ গবাদিপশু পালন ও কৃষি সরঞ্জামাদি তৈরি তথা ডালি, ঝাড়ু, কুলা, চালুনি ইত্যাদি তৈরিতে নারী বিশেষ ভূমিকা পালন করেন।
বিবিএস এর রিপোর্ট অনুযায়ী, কৃষিকাজের সঙ্গে যুক্ত আছে ৬৮.১ শতাংশ নারী। তারা কৃষি উৎপাদন প্রক্রিয়ার তিনটি পর্যায় যথা-প্রাক বপন প্রক্রিয়া, বীজ বপন ও ফসল উৎপাদন প্রক্রিয়া এবং ফসল-উত্তর প্রক্রিয়ায় সম্পৃক্ত থাকেন।
পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ৮১ শতাংশ নারী গৃহসহ কৃষিকাজে সরাসরি অবদান রাখছেন। কিন্তু তাদের শ্রমকে শ্রমশক্তি হিসেবে গণ্য করা হয় না। কারণ তাদের এ কাজের জন্য কোনো পারিশ্রমিক দেওয়া হয় না।
কৃষিতে সক্রিয় ভূমিকা রাখার ক্ষেত্রে দরিদ্র ভূমিহীন এবং উপজাতি নারীদের বেশি সম্পৃক্ত হতে দেখা যায়। উপজাতি নারীরা ফসল লাগানো, পরিচর্যা এবং ফসল কাটার মৌসুমে দল বেঁধে মাঠে কাজ করেন।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো’র (বিবিএস) সর্বশেষ শ্রম জরিপ অনুযায়ী, ২০১০ সালে দেশে কৃষিকাজে নিয়োজিত ২ কোটি ৫৬ লাখ শ্রমিকের মধ্যে প্রায় ১ কোটি ৫ লাখ ছিলেন নারী।
তার এক দশক আগে ২০০০ সালে এই সংখ্যা ছিল মাত্র ৩৮ লাখ। অর্থাৎ এক দশকের ব্যবধানে কৃষিকাজে যুক্ত হয়েছেন ৬৭ লাখ নারী।
জরিপ অনুযায়ী, ১০ বছরের ব্যবধানে কৃষিতে নারী শ্রমিকের অংশগ্রহণ বেড়েছে প্রায় ১৭ শতাংশ, পক্ষান্তরে পুরুষের অংশগ্রহণ কমেছে সাড়ে ৩ শতাংশ। কৃষিকাজে পুরুষের সমান অংশগ্রহণ করেও নারীর পরিচয় থাকছে কেবল গৃহিণী হিসেবে।
মজুরি বৈষম্য
“ আমাদের এলাকায় মজুরি বৈষম্য ব্যাপক। কৃষি বা নির্মানশিল্পে একজন পুরুষ শ্রমিক ২০০ টাকা বেতন পেলে নারী শ্রমিক পায় ১২৫ টাকা। রেওয়াজ হিসেবে এটা চলে আসছে,” টেলিফোনে বেনারকে জানান পঞ্চগড় জেলা শহরের আমলাহার ডিগ্রি কলেজের সহযোগী অধ্যাপক সালাহউদ্দিন আহমেদ, যিনি কমলালেবুর চাষ করে সফল উদ্যোক্তা হিসেবে এলাকায় পরিচিতি লাভ করেছেন।
সালাহউদ্দিন বলেন, নারী শমিক যে কম কাজ করে এমনটা নয়। কিন্তু তাদের কম মজুরি দেওয়াটাই স্বাভাবিক বলে ধরে নেওয়া হয়।
কৃষিতে নারী শ্রমিকদের অধিকার প্রতিষ্ঠায় কর্মজীবী নারী সংগঠনের নেতারা দীর্ঘদিন ধরে কৃষি শ্রম আইন ও একটি কৃষি কমিশন প্রতিষ্ঠার জন্য সরকারের প্রতি দাবি জানিয়ে আসছেন।
“আমরা পুরুষ শ্রমিকের মতই সমান কাজ করি। কিন্তু মজুরি নিতে বা চাইতে গেলে নারীদের ২০–৩০ টাকা কম দেওয়া হয়। আগে এই প্রবণতা অনেক বেশি ছিল। এখন তা বেশ কমেছে,” বেনারকে জানান বাগেরহাট সদরের বেমরতা গ্রামের নারী শ্রমজীবী ময়না খাতুন (৩৮)।
এদিকে, কর্মজীবী নারীর দাবিগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে, কৃষি খাতকে গতিশীল করতে হলে সঠিক বিবেচনার ভিত্তিতে কৃষাণি নারীদেরও ‘কৃষক কার্ড’ দেওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে। দিতে হবে তাদেরও সরকারি কৃষি প্রণোদনা।
“এটা অনস্বীকার্য যে, কৃষিতে নারীর অংশগ্রহণের ফলে একদিকে যেমন দেশের খাদ্যনিরাপত্তা বাড়ছে অন্যদিকে মাথাপিছু আয়ও বৃদ্ধি পাচ্ছে। তাদের অবদান ও স্বীকৃতির বিষয়টি কীভাবে আরও নিশ্চিত করা যায়, সেই চেষ্টা শুরু হয়েছে,” জানান কৃষিসচিব শ্যামল কান্তি ঘোষ।