উন্নয়নের চাকা ঘোরাচ্ছেন শ্রমজীবী নারীরা

ঢাকা থেকে শাহরিয়ার শরীফ
2015.08.12
BD-woman গার্মেন্টস সহ অর্থনীতির সকল ক্ষেত্রে নারীর অবদান বাড়ছে। আগষ্ট,২০১৫
বেনার নিউজ

এগারো বছর আগে কল্পনা আক্তারের বাবা যখন মারা যান, তখন পুরো পরিবার ডুবতে বসেছিল। পোশাকশিল্পে কাজ করে  কল্পনা আর তার বোনেরা মিলে ওই পরিবারটি টেনে তুলেছেন।

কল্পনIর মতো শ্রমজীবী নারীরা পরিবার ছাড়াও দেশের অর্থনীতি টেনে তুলতে উল্লেখযোগ্য অবদান রেখে চলছেন।  তারা উন্নয়নের চাকা ঘুরাচ্ছেন।

সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ-সিপিডি এক গবেষণাপত্রে উল্লেখ করেছে,  অর্থনীতিতে অতিদ্রুত বিশেষ করে চাকরি, ব্যবসায় নারীর সংখ্যা বাড়ছে। মোট শ্রমশক্তিতে নারীর অংশগ্রহণ ছিল ১৯৯৫-৯৬ সালে ১৫.৮ শতাংশ, ২০০২-০৩ সালে ২৬.১ শতাংশ, ২০০৫-০৬ সালে ২৯.২ শতাংশ এবং ২০১১-১২ সালে ৩৯.১ শতাংশ।

দেশের বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের প্রধান উৎস পোশাকশিল্প, হিমায়িত চিংড়ি, চামড়া, হস্তশিল্পজাত দ্রব্য, চা শিল্পসহ অন্যান্য পণ্য উৎপাদনের সঙ্গে সরাসরি নারী জড়িত। এসব শিল্পের প্রধান কাজগুলো করেন নারী।

সরকারি হিসাব হচ্ছে, গৃহস্থালি কর্মকাণ্ড ছাড়া বর্তমানে দেশে এক কোটি ৬২ লাখ নারী কর্মক্ষেত্রে রয়েছেন। গবেষকেরা বলছেন, কৃষি, শিল্প ও সেবাখাতে নারীদের অংশগ্রহণের বিষয়টি স্বীকৃত হলেও বিপুল সংখ্যক নারী বিনা পারিশ্রমিকে ঘরে শ্রম দেন।

বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি) ও মানুষের জন্য ফাউন্ডেশনের গবেষণায় উঠে এসেছে, বাংলাদেশে একজন নারী প্রতিদিন গড়ে ১২ দশমিক ১টি কাজ করেন, যা জাতীয় আয়ের হিসাবে অন্তর্ভুক্ত করা হয় না। অন্যদিকে পুরুষের ক্ষেত্রে এ ধরনের কাজের সংখ্যা মাত্র ২ দশমিক ৭।

‘জাতীয় অর্থনীতিতে নারীদের অবদান নিরূপণ: বাংলাদেশ প্রেক্ষিত’  শীর্ষক ওই গবেষণা প্রতিবেদন গত বছর অক্টোবরে প্রকাশ করা হয়। এতে বলা হয়, ১৫ বছর বা তদূর্ধ্ব একজন নারী গড়ে প্রতিদিন একই বয়সের পুরুষের তুলনায় প্রায় তিন গুণ সময় কাজ করেন ।

“ গৃহস্থালিতে নারীর যে কাজ সেটি জিডিপিতে অন্তর্ভুক্ত হয় না। আদতে নারীর এই শ্রমের প্রাক্কলিত বার্ষিক মূল্য (২০১৩-১৪ অথর্বছর)  জিডিপির ৭৬ দশমিক ৮ শতাংশ,”  গবেষণা প্রতিবেদনে উল্লেখ করেন সিপিডির পরিচালক (গবেষণা) ড. ফাহমিদা খাতুন, যিনি  গবেষণা কার্যক্রমটি পরিচালনা করেছেন।

“ গৃহস্থালি কাজে সারা দেশের নারীরা বছরে ১৬ হাজার ৬৪১ কোটি ঘণ্টা সময় ব্যয় করছেন, যার  আর্থিক মূল্যমান দুই লাখ ৪৯ হাজার ৬১৫ কোটি টাকা। জিডিপিতে এই আর্থিক মূল্য যোগ হলে নারীর হিস্যা বর্তমানের ২০ শতাংশ থেকে বেড়ে দাঁড়াবে ৪৮ শতাংশ, ”বেনারকে জানান বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতির সভাপতি আবুল বারকাত।



কোথায়, কীভাবে শ্রম দেন নারী

বাংলাদেশের শ্রমজীবী নারীদর সবচেয়ে বড় অংশের বসবাস গ্রামাঞ্চলে। এঁরা কৃষিশ্রমিক। লেবার ফোর্স সার্ভে ২০১০ সালের প্রতিবেদনে বলা হয়,  নারীদের ৬৪ দশমিক ৮৪ শতাংশ কৃষিশ্রমিক,  ২১ দশমিক ৮৯ শতাংশ বিভিন্ন ধরনের চাকরি করছেন,  শিল্পশ্রমিকের হার ১৩ দশমিক ৩২ শতাংশ।

“নারী এগিয়েছেন, এতে কোনো সন্দেহ নেই। নারী আগে শুধু ঘরের ভেতর পরিশ্রম করতেন। এখন তাঁরা বাইরে বেরিয়ে এসে কাজের জন্য মজুরিও পাচ্ছেন। এতে করে দেশের উন্নয়ন ও অর্থনীতিতে নানা সূচক যোগ হচ্ছে,” বেনারকে জানান মানবাধিকারকর্মী হামিদা হোসেন।


ঘুড়ে দাঁড়িয়েছে কল্পনা

প্রতিবেদনের শুরুতে যে নারী শ্রমিকের উদাহরণ টানা হয়েছিল, বেনারকে তিনি বলেছেন ক্ষমতায়ন তাঁর জীবনে কতটা প্রভাব রেখেছে।

“ ইনশাআল্লাহ আপনাদের দোয়া-আশীর্বাদে এখন ভালো আছি,”  ঢাকার কাছে সাভারের একটি গার্মেন্টসের কর্মী কল্পনা আক্তারের কুশল জানতে চাইলে শোনা গেলো এই উত্তর।

চার মেয়ে ও এক ছেলে শিশু বা কিশোর থাকা অবস্থায় এগারো বছর আগে মারা যান কল্পনার বাবা । প্রথমে কল্পনার দুই বোন ও পরে কল্পনা যোগ দেন গার্মেন্টসে। এতে তাদের ভাতের কষ্ট ঘোচে।

তার বড় দুই বোন এখন বিয়ে করে সংসারি হয়েছে। অর্থাভাবে তিনবোনেরই লেখাপড়া হয়নি।

কিন্তু কল্পনা ছোটো দুই ভাইবোনের পড়ালেখার দায়িত্ব নিয়েছে। বোনটি এসএসসি পরীক্ষার্থী, ভাই ষষ্ঠ শ্রেণিতে পড়ে।

“টাকা জমায়ে টিভি কিনছি, শোকেস করছি। ছোটো খাটো একটি জমি কিনতে  চাই। ভাই-বোন দুইটারে মানুষ করতে চাই। সব গুছায়া তারপর নিজের কথা ভাবমু,” বেনারকে জানান অবিবাহিতা কল্পনা।


পোশাকশিল্পের সঙ্গে নারী

দেশের অর্থনীতি অনেকটাই দাঁড়িয়ে আছে পোশাকশিল্প ও তার আনুষাঙ্গিক শিল্পগুলোর ওপর। পোশাকশিল্পের সঙ্গে জড়িত চার মিলিয়ন বা ৪০ লাখ কর্মীর মধ্যে ৮০ ভাগই নারী।

রিফিউজি অ্যান্ড মাইগ্রেটরি মুভমেন্টস রিসার্চ ইউনিট (রামরু) ‘পোশাকশিল্পের নারী শ্রমিকদের গ্রাম ও শহুরে অর্থনীতিতে অবদান’ শীর্ষক ২০১৩ সালের এক গবেষণায় দেখিয়েছে, পোশাকশিল্পের নারী কর্মীরা নিত্যপ্রয়োজনীয় খরচ শেষে লিপস্টিক, পাউডার, সালোয়ার-কামিজ বা শাড়ি, স্যান্ডেল, মোবাইল ফোন এমনকি বিউটি পারলারের পেছনে সাধ্যমতো খরচ করছেন। ফলে বাজার অর্থনীতিতে নতুন নতুন চাহিদার সৃষ্টি হচ্ছে।

অর্থনীতিবিদ ও সমাজবিজ্ঞানীরা মনে করছেন, এই উপার্জন নারীদের ক্ষমতায়িত করছে। আর নারীরা ক্ষমতায়িত হয়ে প্রভাব রাখছেন বিভিন্ন সামাজিক খাতের উন্নয়নে। বিভিন্ন সামাজিক সূচকে বাংলাদেশের এগিয়ে যাওয়ার কারণও এই উপার্জন করার সক্ষমতা।

অর্থনীতিবিদ ড. প্রতিমা পাল মজুমদার তাঁর এক গবেষণায় উল্লেখ করেছেন, “পোশাকশিল্পের নারী কর্মীরা বিয়ের মতো গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তটিও নিজেই নিচ্ছেন। ফলে বাল্যবিবাহ কমানো, কম সন্তান নেওয়ার মতো সামাজিক উন্নয়নের সূচকগুলোও এই নারীদের আয়ত্তে।”


কৃষিতে নারীর অংশগ্রহণ বেড়েছে

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্য হলো গত ১০ বছরে কৃষিতে নারীর অংশগ্রহণ বেড়েছে ১০৮ শতাংশ। আর পুরুষের অংশগ্রহণ কমেছে দুই শতাংশ।

“ বাড়ির পুরুষেরা কৃষিজমি ছেড়ে অন্য কাজে যুক্ত হচ্ছেন। কৃষিজমির দায়িত্ব নিচ্ছেন নারী। তাঁরা সফলতার সঙ্গে কাজটি করছেন বলেই কোথাও কোনো ঘাটতি নেই,” বেনারকে জানান জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের শিক্ষক শরমিন্দ নীলোর্মি ।

নীলোর্মি বলেন, কৃষিখাত বলতে বিবিএস বাড়ির উঠোনে সবজি বাগান করানো বোঝায়নি। কৃষিশ্রমিক হিসেবে নারী ফসল উৎপাদন থেকে প্রক্রিয়াজাত করা ও বাজারে পাঠানো পর্যন্ত সব কাজকেই বুঝিয়েছে। এ ছাড়া  পশুপালন, হাঁস-মুরগী পালন, মাছ চাষকেও এ কাজের অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।


অভিবাসী শ্রমিকের ১৩ শতাংশ নারী

১৯৯১ সালের এক হিসাবে দেখা যায়, তখন বছরে দুই হাজার নারী কর্মী বিদেশে গেছেন। এখন এই সংখ্যা ২০ থেকে ৩০ হাজার। বর্তমানে দুই লাখের বেশি নারী কর্মী দেশের বাইরে কাজ করছেন।

সরকারের হিসাব অনুযায়ী, মোট অভিবাসী শ্রমিকের ১৩ শতাংশেরও বেশি এখন নারী। কিন্তু এই নারীরা প্রবাসী-আয় হিসেবে কত টাকা পাঠাচ্ছেন, রাষ্ট্র সে হিসাবটি রাখার উদ্যোগ নেয়নি।


৩৫ শতাংশই নারী উদ্যোক্তা

ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প ফাউন্ডেশনের তথ্যমতে, দেশের মোট ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তাদের ৩৫ শতাংশই নারী উদ্যোক্তা। নারীরা ব্যবসার ক্ষেত্রেও এগিয়ে যাচ্ছেন।

ক্ষুদ্রঋণ নিয়ন্ত্রক সংস্থার সর্বশেষ হিসাব অনুযায়ী, ২০১০ সালের জুনে এ দেশে ক্ষুদ্র্রঋণের গ্রাহকের সংখ্যা ছিল দুই কোটি ৫২ লাখ ৮০ হাজার। এর মধ্যে ৯০ শতাংশই নারী গ্রাহক।

ড. মুহাম্মদ ইউনূস নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন যে ক্ষুদ্রঋণের কারণে, তার পেছনেও মুখ্য ভূমিকা নারীর।


বাংলাদেশের নারী সম্পর্কে অমর্ত্য সেন

নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেন প্রায়ই তাঁর বক্তৃতায় বাংলাদেশের  শ্রমজীবী নারীদের প্রশংসা করেন।

অমর্ত্য সেন ২০১২ সালে জাতিসংঘের মানব উন্নয়ন সূচকের প্রকাশ অনুষ্ঠানে বলেছিলেন,  ভারতের বিপরীতে বাংলাদেশকে যদি দাঁড় করাই,  দেখা যাবে প্রতিটি ক্ষেত্রেই বাংলাদেশকে শুরু করতে হয়েছে পেছন থেকে এবং প্রতিটি ক্ষেত্রেই বাংলাদেশ এগিয়ে গেছে। এই দ্রুত উন্নতির পেছনে আছে নারীর ক্ষমতায়ন।

মুম্বাইয়ে সম্প্রতি এক স্মারক বক্তব্যে  অমর্ত্য সেন বলেন, মানব উন্নয়ন সূচকের সব ক্ষেত্রেই মূলত  নারীরাই বাংলাদেশকে এগিয়ে নিতে সহায়তা করেছেন।


অবদানের স্বীকৃতি কম

রাজনীতি, অর্থনীতিসহ সমাজের সর্বক্ষেত্রে নারী উন্নয়ন ও ক্ষমতায়নে  দেশীয় ও আন্তর্জাতিক অঙ্গনে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে বাংলাদেশ ।  
দেশের প্রধানমন্ত্রী, জাতীয় সংসদের স্পিকার, বিরোধীদলীয় নেতা,  সিটি করপোরেশনের মেয়র, পাবলিক ও প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচার্য, পুলিশ ও সেনাসদস্য, সচিব, বৈমানিক, বিচারক, উদ্যোক্তা, ক্রিকেটার তো বটেই; বাংলাদেশের নারীর বিজয় পতাকা উড়েছে এভারেস্ট চূড়ায়ও।

“ তৃণমূল থেকে হিমালয়ের চূড়া অর্জন—সব জায়গাতেই নারীরা আছেন। তবে নারীর অর্জন বা অবদানের স্বীকৃতি তুলনামূলক কম,” বেনারকে জানান সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা রাশেদা কে চৌধূরী।

তাঁর মতে, “অথচ একজন নারী যদি অষ্টম শ্রেণী পাস করেন, সেই নারীর সন্তান অপুষ্টিতে ভোগে না, নিরক্ষর থাকে না। কিন্তু একজন পুরুষ অষ্টম শ্রেণী পড়েও এই অগ্রগতিগুলোতে কোনো ভূমিকা রাখেন না। তাই নারীর অবদানকে স্বীকৃতি দিতেই হবে।”

বাংলাদেশ  নিম্ন-মধ্যম আয়ের দেশ হওয়ার  কৃতিত্ব কৃষক ও শ্রমিকের-একথা জানিয়ে শ্রমপ্রতিমন্ত্রী মুজিবুল হক বেনারকে বলেন,  “দেশের অর্থনীতিতে সবচেয়ে বেশি অবদান রাখছেন প্রবাসী শ্রমিক ও গার্মেন্টসকর্মীরা।”  
“এ কথা চোখ বন্ধ করে বলা যায়, দেশের অথর্নৈতিক ও সামাজিক অগ্রযাত্রায় এখন নারী-পুরুষ সমানভাবে অবদান রাখছেন,” মনে করেন শ্রম প্রতিমন্ত্রী ।







মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।