নতুন সংগঠনের নামে আবার হিট-লিষ্ট, পুলিশ কিছু খুঁজে পাচ্ছে না
2015.08.12

বাংলাদেশে বিশিষ্ট ব্যক্তিদেরকে হত্যার হুমকি দেওয়া অব্যাহত রয়েছে। আবারও সরকারের মন্ত্রী, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, সাংস্কৃতিক কর্মী, গণজাগরণ মঞ্চের সংগঠক ও ব্লগারসহ ১৯ জনকে হত্যার হুমকি দেওয়া হয়েছে। ‘ইত্তেহাদুল মুজাহিদিন’ নামের এক কথিত সংগঠনের নামে সংবাদপত্রে বুধবার চিঠিটি পাঠানো হয়।
ওই চিঠি বা খামে সংগঠনটির কোনো পরিচয় বা ঠিকানা দেওয়া হয়নি। তবে খামের ওপর সিলেট পোস্ট অফিসের সিল ও ১০ আগস্টের তারিখ রয়েছে।
চিঠিটিতে থাকা ২০ জনের নামের তালিকার প্রথমেই থাকা সদ্য খুন হওয়া ব্লগার নীলাদ্রি চট্টোপাধ্যায় নামটি লাল কালি দিয়ে কাটা। গত শুক্রবার ঢাকার গোড়ানে এই গণজাগরণ মঞ্চের কর্মীকে (যিনি নিলয় নামে পরিচিত) তার বাসায় ঢুকে কুপিয়ে হত্যা করা হয়।
এরপর ধারাবাহিকভাবে ব্লগার আরিফ জেবতিক, সুশান্ত দাশ গুপ্ত, সিলেটের শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক জাফর ইকবাল, ভাস্কর ফেরদৌসী প্রিয়ভাষিণী, আব্দুর রহমান, শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ, সমাজকল্যাণমন্ত্রী সৈয়দ মহসিন আলী, উদীচী শিল্পীগোষ্ঠীর মকবুল হোসেন ও সাংসদ সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের নাম দেওয়া হয়েছে।
এরপরে রয়েছে ব্লগার আরিফুর রহমান, অমি রহমান পিয়াল, হুমায়ুন আজাদের ছেলে অনন্য আজাদ, গণজাগরণ মঞ্চের সংগঠক মাহমুদুল হক মুন্সি, মারুফ রসুল, বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক আরাফাত রহমান, ব্লগার নির্ঝর মজুমদার, ড. আতিক, আশফাক আনুপ ও নূর নবী দুলালের নাম। নতুন এই তালিকায় থাকা অনেকেই এর আগেও বিভিন্ন সময়ে হুমকি পেয়েছেন।
বুধবার দেওয়া চিঠিতে কয়েকলাইন কবিতাও লেখা আছে। এতে খোদার দুশমন ও নবীর অপমানকারীর প্রাণ কেড়ে নেবার হুমকি দেয়া হয়েছে।
যাদের হত্যার হুমকি দেওয়া হয়েছে, চিঠির শুরুতে তাদের আখ্যায়িত করা হয়েছে ‘ইসলাম ও মাদ্রাসা শিক্ষার দুশমন, নাস্তিক, সিলেটবিদ্বেষী, সিলেটের কলঙ্ক, স্যাটানিক ব্লগার হিন্দুস্তানি দালাল ও মুসলিম নাম সর্বস্ব মুনাফিক’ হিসেবে।
সম্প্রতি একের পর এক ব্লগার হত্যার পর এ ধরনের চিঠি পেয়ে শঙ্কার মধ্যে দিন কাটাচ্ছেন হুমকিপ্রাপ্তরা। তারা জীবনের নিরাপত্তা সহ হুমকিদাতাদের আটক করে বিচারের আওতায় আনার দাবি জানিয়েছেন। এছাড়া ব্লগার হত্যাকারীদের আটকের বিষয়ে সরকারের আন্তরিকতা নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন এসব ব্যক্তিরা।
এ বিষয়ে অমি রহমান পিয়াল বেনারকে বলেন, “দীর্ঘদিন থেকেই আমি মুক্তিযুদ্ধ এবং যুদ্ধাপরাধের বিচার নিয়ে লিখে আসছি। এ কারণে একটি গোষ্ঠীর হিট লিস্টেও ছিলাম। এ ধরনের হুমকি আমি আগেও পেয়েছি। তবে এখন যেভাবে ব্লগার হত্যা চলছে, তাতে এ ধরনের চিঠি আসা কিছুটা শঙ্কার। কারণ, যে পদ্ধতিতে ব্লগারদের মারা হচ্ছে, সেভাবে মরতে চাইনা।”
তিনি বলেন, “ব্লগার সম্পর্কে সরকারের পক্ষ থেকে কিছু বক্তব্য এসব হত্যাকারীদের উস্কে দিচ্ছে। সরকার ইচ্ছে করলেই এসব হুমকিদাতাদের চিহ্নিত করতে পারে। কিন্তু তার আগে দেখতে হবে ব্লগার ইস্যুতে সরকার কতটা আন্তরিক”।
তিনি আরো বলেন, অভিজিতসহ অন্যান্য কয়েকজন ব্লগার হত্যাকারীদের আটক করতে না পারলেও ওয়াশিকুর বাবু হত্যাকারীদের দুজনকে জনগণ আটক করে পুলিশে সোপর্দ করেছিল। তাদেরকে সঠিকভাবে জিজ্ঞাসাবাদ করলেই এই চক্রটি সম্পর্কে জানা যায়। কিন্তু তাদের দুজনের কাউকে এ পর্যন্ত রিমান্ডে নেওয়া হয়েছে বলেও আমরা জানতে পারিনি। এসব আসামিদের ধরতে প্রকাশ্যে না হোক, গোপনেও তো সরকারের তৎপর থাকা উচিত।
এ চিঠি পাওয়ার পর থানায় কোন সাধারণ ডায়েরি(জিডি) করেননি জানিয়ে তিনি বলেন, “কার বিরুদ্ধে জিডি করব?”
এ বিষয়ে ঢাকা মহানগর পুলিশের গণমাধ্যম কার্যালয়ের উপ কমিশনার মুনতাসিরুল ইসলাম বেনারকে বলেন, “আমরা ১৯জন ব্যক্তিকে হত্যার হুমকি দেওয়ার খবরটি শুনেছি। চিঠিটি সংগ্রহ করে এ বিষয়টি খতিয়ে দেখা হবে। আর এর আগেও এধরনের হুমকির ঘটনা ঘটেছে। আমাদের তদন্তে তার অনেকগুলোই ‘ভূয়া’ বলে প্রমাণিত হয়েছে। তবে যেগুলো সত্য, সেসব হুমকিদাতাদের ধরতে আমাদের অনলাইন কর্মকান্ডবাড়ানো হয়েছে। সেগুলোর বিষয়ে আমরা গুরুত্বের সঙ্গে নিয়ে তদন্ত করছি।”
একাধিক ব্লগার খুনের ঘটনা, আসামিদের কেউ আটক না হওয়া আর বিশিষ্ট ব্যক্তিদের ওপর অব্যাহত হত্যার হুমকি রাষ্ট্রের দূর্বলতার প্রমাণ বলে অভিমত দিয়েছেন অপরাধ বিজ্ঞানীরা।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরাধ বিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক জিয়া রহমান বেনারকে বলেন, “একটার পর একটা ব্লগার মারা যাচ্ছে, বিশিষ্ট ব্যক্তিদের তালিকা ধরে হত্যার হুমকি দেওয়া হচ্ছে। এসব আশাহত হওয়ার মত বিষয়। এসবের মধ্য দিয়ে রাষ্ট্রের দুর্বলতা ফুটে ওঠে। জনগণের নিরাপত্তা দেওয়া রাষ্ট্রের দায়িত্ব। এজন্য রাষ্ট্রকেই জবাবদিহি করতে হবে। ব্লগার হত্যার ক্ষেত্র তৈরি না করে হত্যাকারীদের আইনের আওতায় আনতে হবে।”
চলতি বছর নীলাদ্রিসহ চারজন ব্লগার ও অনলাইন অ্যাক্টিভিস্ট একই কায়দায় খুন হয়েছেন। এরা সবাই ধর্মীয় গোড়ামীর বিরুদ্ধে লেখালেখিতে যুক্ত ছিলেন, সক্রিয় ছিলেন গণজাগরণ মঞ্চের সঙ্গেও।
নিলয় হত্যার পর আনসার আল ইসলাম নামের একটি সংগঠনের পক্ষ থেকে গণমাধ্যম কার্যালয়ে ই-মেইল পাঠিয়ে দায় স্বীকার করা হয়েছিল। সেখানে আনসার আল ইসলামকে আল কায়েদার ভারতীয় উপমহাদেশের (একিউআইএস) বাংলাদেশ শাখা বলা হয়েছিল।
এরপর সোমবার রাতে বরিশাল গণজাগরণ মঞ্চের ছয় কর্মীর ছবি দিয়ে ‘আনসার বিডি’ নামের একটি ফেইসবুক পেইজ থেকে হত্যার হুমকি দেওয়া হয়। যদিও পুলিশ এর কোন সত্যতা পায়নি।
এর আগে তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য আ আ স স ম আরেফিন সিদ্দিকীসহ ২৫ জন বিশিষ্ট ব্যক্তিকে আনসারুল্লাহ বাংলা টিম-১৩ নামের সংগঠনের পক্ষ থেকে হত্যার হুমকি দেওয়া হয়।
তারও আগে ২০১৩ সালে হেফাজতে ইসলামের পক্ষ থেকে ৮৪ জনের একটি তালিকা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রনালয়ে জমা দেয়া হয়েছিল। সেই তালিকার মধ্যে থাকা ৪ জন ব্লগারকে ইতিমধ্যে গত ৬ মাসে কুপিয়ে একই কায়দায় হত্যা করা হয়েছে।