গণপরিবহনে নারীরা নিরাপদ নন
2015.08.31
দেশের অর্থনীতির চাকা ঘোরাতে শিক্ষা এবং কর্মক্ষেত্রে নারীর পদচারণা বেড়েছে কয়েকগুন। রাজধানী ঢাকাতেই স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় কিংবা কর্মক্ষেত্রে যেতে প্রতিদিন রাস্তায় নামেন কয়েক লাখ নারী। কিন্তু সেই তুলনায় বাড়েনি যাতায়াতের সুযোগ-সুবিধা। বরং পুরুষের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে যানবাহনে উঠতে গিয়ে প্রতিনিয়ত যৌন হয়রানিসহ নানা রকম অস্বস্তিকর পরিস্থিতির সম্মুখীন হচ্ছেন নারীরা।
রাজধানীর বিভিন্ন রুট ঘুরে দেখা যায়, গণপরিবহনে উঠতে গেলে ধাক্কাধাক্কিতে নারীরা নাজেহাল হচ্ছেন। ঘণ্টার পর ঘণ্টা দাঁড়িয়ে থাকলেও বাসে উঠতে পারেন না অনেকে। আবার পরিবহনগুলোতে নারী-শিশু-প্রতিবন্ধীদের জন্য নয়টি সিট বরাদ্দ রাখার কথা থাকলেও বেশিরভাগ ক্ষেত্রে তিন থেকে চার সিটের মধ্যেই তা সীমাবদ্ধ। এছাড়া ওই আসনগুলো বেশিরভাগ সময়ই থাকে পুরুষ যাত্রীদের দখলে। এ নিয়ে কথা বললেই শুরু হয় ঝগড়া।
ভোগান্তির শিকার যাত্রী এবং সংশ্লিষ্টরা বলছেন, তদারকির অভাব, যানবাহন সংকট আর বিকৃত মানসিকতার কারণেই নারীরা প্রতিদিন নানা হয়রানির শিকার হচ্ছেন। বাসের কর্মচারি থেকে শুরু করে পুরুষ যাত্রীদের ক্ষুদ্র লালসার মুখে পড়ছেন রাস্তায় নামা নারীরা। কেউ প্রতিবাদ করেন, কেউ করেন না। প্রতিবাদ করলে আবার তাদের তোপের মুখে পড়তে হয়।
গণপরিবহনের অভিজ্ঞতার কথা বর্ণনা করতে একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কর্মরত নারী এরিনা সিদ্দিকা বলেন, “বাসে উঠতে গেলে প্রথমে ‘মহিলা সিট নাই, মহিলা তুলিস না’ ইত্যাদি কথা শুনতে হয়। এরপরেও ‘দাঁড়িয়ে যাব’ বলে উঠে পড়লে, সহ্য করতে হয় পুরুষ যাত্রীদের নানা অসভ্যতা। এমনকি কখনো কখনো বাসের হেলপাররা মেয়েদেরকে টেনে তোলার নামে শরীরে হাত দেয়। এসবের প্রতিবাদ করলে বাসের অধিকাংশ যাত্রীরা মেয়েদেরকেই দোষেন, আসন না থাকার পরেও গাড়িতে ওঠার জন্য। এটা ঢাকা শহরের চলাচল করা নারীদের নিত্যদিনের বাস্তবতা।”
একটি বেসরকারী ব্যাংকের কর্মকর্তা রুমানা ইসলাম বেনারকে বলেন, “প্রতিদিন অফিস টাইমে যেকোন যানবাহনে উঠতে রীতিমতো যুদ্ধ করতে হয়। পুরুষরা যেকোনভাবে পার পেয়ে যান, আর নারীরা শিকার হন সীমাহীন ভোগান্তির। কিছু পুরুষ মনে করেন, বাসে চলাচল করা নারীদের শরীরে ইচ্ছে মতই স্পর্শ করা যায়। ইচ্ছে করেই তারা নারী যাত্রীদের গায়ের ওপরে ঢলে পড়েন কিংবা অপ্রয়োজনে গায়ে হাত দেন। প্রতিবাদ করলেই বলবে, ইচ্ছে করে ধাক্কা দেইনি। এতো অসুবিধা হলে বাস থেকে নেমে যান।”
নিরাপত্তা সমস্যার সমাধানে নানা প্রস্তাব
২০১৪ সালের অ্যাকশন-এইড বাংলাদেশের নিরাপদ নগর কর্মসূচি বিষয়ক এক জরিপের তথ্য অনুযায়ী, নারীরা গণপরিবহনসহ বিভিন্ন জায়গায় যৌন হয়রানির শিকার হন। ৪৮ শতাংশ নারীর বাসের চালক বা ভাড়া আদায়কারীর মুখে অবমাননাকর ভাষা শোনার অভিজ্ঞতা হয়েছে। যৌন হয়রানি বা সহিংসতা এড়াতে কৌশল হিসেবে ১৩ শতাংশ নারী গণপরিবহন ব্যবহার করা বন্ধ করেছেন। আর তিন শতাংশ নারী আত্মরক্ষায় অস্ত্র বা যন্ত্রপাতি সঙ্গে রাখার কথা জানান।
এদিকে বাসচালকদের দাবি নারীদের নিরাপত্তার কথা ভেবেই তারা অনেক সময় তাদেরকে বাসে তুলতে চান না। গাজীপুর থেকে যাত্রাবাড়ি চলাচলকারী সুপ্রভাত বাসের একজন হেলপার সিদ্দিকুর রহমান বলেন, “আমরা নারী যাত্রীদের নিরাপত্তার কথা ভেবেই আসন ফাঁকা না থাকলে উঠতে নিষেধ করি। দাঁড়িয়ে মহিলা যাত্রী নিলে পুরুষ যাত্রীরাও চিৎকার করে আমাদের গালিগালাজ করে।”
নারীদের এই নিত্য হয়রানির বিষয়ে বাংলাদেশ জাতীয় মহিলা আইনজীবী সমিতির নির্বাহী-পরিচালক এডভোকেট সালমা আলী বেনারকে বলেন, “রাজধানীতে নারীদের চলাচলের জন্য পর্যাপ্ত যান বাহনের অভাব যেমন রয়েছে তেমনি পুরুষদের বিকৃত মানসিকতার শিকার হচ্ছেন নারীরা। অর্থনীতিতে পুরুষের পাশাপাশি নারীর অবদান কোনভাবেই কম নয়। তাই নারীদের প্রতিদিনকার চলাচল নির্বিঘ্ন করতে হবে। গণপরিবহনে সংরক্ষিত নারী আসনের সংখ্যা বাড়ানোর পাশাপশি আরও বেশি বিশেষায়িত নারী বাস সার্ভিস চালু করতে হবে”।
তিনি আরো বলেন, এছাড়া যেখানেই যৌন হয়রানির ঘটনা হবে লজ্জা না পেয়ে সেখানেই নারীদের প্রতিবাদ করতে হবে। আইন-শৃঙ্খলাবাহিনীকে এ বিষয়টির প্রতি নজর দিতে হবে। প্রয়োজনে হেল্প লাইনের ব্যবস্থা করে সঙ্গে সঙ্গেই ঘটনাস্থলে পুলিশকে পৌঁছাতে হবে। নারীদের চলাচল নিরাপদ হলেই তারা দেশকে আরো এগিয়ে নিতে ভূমিকা রাখতে সক্ষম হবে।
১৬টি ‘মহিলা বাস সার্ভিস’
এদিকে নারীদের স্বাচ্ছন্দে চলাচলের জন্য ঢাকা শহরের বিভিন্ন সড়কপথে মোট ১৬টি ‘মহিলা বাস সার্ভিস’ চালু আছে বলে জানিয়েছে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন সংস্থার (বিআরটিসি) চেয়ারম্যান। ১৯৯০ সালে প্রথম ঢাকা শহরে দুটি রুটে এই সার্ভিস চালু হয়। কিন্তু বাণিজ্যিকভাবে অলাভজনক হওয়ায় মাত্র ৮ মাস পরেই তা বন্ধ হয়ে যায়। পরে ২০০১ সালের ২৫ অক্টোবর থেকে তা আবার চালু হয়।
কিন্তু চলমান ১৬টি বাসেও পর্যাপ্ত নারী যাত্রী পাওয়া যায় না বলে জানান বিআরটিসির চেয়ারম্যান মিজানুর রহমান। তিনি বেনারকে বলেন, “অফিস সময় অনুযায়ী সকালে এবং বিকেলে রাজধানীর বিভিন্ন রুটে ১৬টি বাস চলাচল করছে। এসব বাসের কিছু ৫২ সিটের, কিছু বাস ৭৪ সিটের। কিন্তু সে আসনগুলোও কখনো কখনো পূর্ণ হয় না। নারী যাত্রীদের বেশির ভাগেরই পুরুষ সঙ্গী থাকে। সেসব সঙ্গীদের ফেলে তারা মহিলা বাসে উঠতে চান না। যদি যাত্রী বেশি হয়, তবে মহিলা বাস সার্ভিস আরো বাড়ানো হবে।”
এ বিষয়ে পরিবহন বিশেষজ্ঞ ও ‘ওয়ার্ক ফর বেটার বাংলাদেশ'-এর ন্যাশনাল এডভোকেসি অফিসার মারুফ রহমান বলেন, “গণপরিবহণে সংরক্ষিত আসনগুলো কিন্তু শুধু মাত্র নারীদের জন্য নয়। ওই নয়টি আসন নারীর পাশাপাশি শিশু ও প্রতিবন্ধীদের জন্যও। নারীদের জন্য আলাদা করে আসন বরাদ্দ যেমন প্রয়োজন তেমনি গণপরিবহন উন্নত করাও দরকার। গণপরিবহনকে নারী বান্ধব না করা গেলে নগর তার মর্যাদা হারাবে।”