শ্রম আইন লঙ্ঘন হচ্ছে প্রতিনিয়ত, প্রতিকারের উদ্যোগ নেই

ঢাকা থেকে জেসমিন পাপড়ি
2016.01.21
BD-worker বাংলাদেশে শ্রম আইন লঙ্ঘনের ঘটনা ক্রমশ বেড়েই চলছে।
অনলাইন

বাংলাদেশে রানা প্লাজা কারখানায় দুর্ঘটনার পর আইন-আদালতসহ বর্হিবিশ্বের বিভিন্ন উদ্যোগ ও চাপের  পরও  বাংলাদেশে শ্রম আইন লঙ্ঘনের ঘটনা ক্রমশ বেড়েই চলছে। এর মধ্যে ২০১৪ এ দেশে সরকারি হিসেব মতে শ্রম আইন লঙ্ঘনের ঘটনা ঘটেছে ৪৪ হাজার তিন’শ ৪৭টি। এভাবে বাড়তে থাকলে বর্হিবিশ্বে সরকারের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হবে বলে মনে করেন বিশ্লেষকরা।

২০১৩ সালের ২৪ এপ্রিল ঢাকার অদূরে সাভারের রানা প্লাজা গার্মেন্ট কারখানা ধসে প্রায় এক হাজার ১৩৫ জন শ্রমিক নিহত হন। এ নিয়ে সারা বিশ্বে তৈরি পোশাক ক্রেতাদের মধ্যে তোলপাড় শুরু হয়। দুর্ঘটনার পর দেশের কারখানাগুলোতে সার্বিক নিরাপত্তা  ও উন্নত কর্ম পরিবেশ নিশ্চিতে গঠন করা হয় ইউরোপীয় ক্রেতাদের ‘অ্যাকর্ড অন ফায়ার অ্যান্ড বিল্ডিং সেফটি ইন বাংলাদেশ’ নামের একটি জোট। অপরদিকে আমেরিকার ক্রেতারা গঠন করে ‘বাংলাদেশ সেফটি অ্যালায়েন্স’ ।

রানা প্লাজা ধসের পর দুটি জোটের পক্ষ থেকে দেশের দুই হাজার কারাখানা পরিদর্শন করা হয়, বাকী কারখানাগুলো সরকারের নিজস্ব তত্ত্বাবধানে পরিদর্শন করা হয়। এরই প্রেক্ষিতে প্রথমবারের মতে পরিদর্শন প্রতিবেদন তৈরি করা হয়। ২১ জানুয়ারি বৃহস্পতিবার সে প্রতিবেদন প্রকাশ করেছেন কারাখানা পরিদর্শন অধিদপ্তর।


২০১৪ সালের প্রতিবেদনে যা আছে

শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের অধীন কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তরের ২০১৪ সালের প্রতিবেদনে দেখা যায়, দেশের কলকারখানাগুলোতে ২০১৪ সালে শ্রম আইন লঙ্ঘনের ঘটনা ঘটেছে ৪৪ হাজার ৩’শ ৪৭টি। এর মধ্যে ১০ ভাগের কিছু বেশি ঘটনা ঘটেছে তৈরি পোশাক শিল্প কারখানায়। ২৪ হাজার ১৯৭টি কলকারখানা পরিদর্শনের পর এ তথ্য উঠে আসে।

বৃহস্পতিবার দুপুরে সচিবালয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়, ৪৪ ভাগ আইন লঙ্ঘনের ঘটনা ঘটেছে কর্মক্ষেত্রে নিয়োগের শর্তাবলি সম্পর্কিত ক্ষেত্রে। আর ২৭ শতাংশ ঘটেছে সুরক্ষা ও স্বাস্থ্য সম্পর্কিত বিষয়ে।

ওই বছরটিতে বিভিন্ন কলকারখানায় মারা গেছেন ৮৮ জন শ্রমিক। যার মধ্যে ১৯ জন পোশাক কারখানার শ্রমিক। আর ১২ হাজার ৩৩৭ জন আহত হয়েছেন। এর মধ্যে ১১ হাজার ১৮১ জন পোশাক কারখানার শ্রমিক।


‘আইন মানে না মালিকরা’

২০১৩ সালে রানা প্লাজায় ভয়াবহ দুর্ঘটনার পর শ্রমিকদের কর্ম পরিবেশ উন্নয়নে শ্রম আইন সংশোধনসহ নানা উদ্যোগ দেয় সরকার। এছাড়া বিদেশী ক্রেতা প্রতিষ্ঠানও বিভিন্ন কারাখানা পরিদর্শন করে কর্ম পরিবেশসহ শ্রমিকদের বিভিন্ন অধিকার বাস্তবায়নে সরকারকে চাপ দেয়।

এরপরও কেন শ্রম আইন লঙ্ঘনের ঘটনা ঘটেছে, এ বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ ইন্সটিটিউট অফ লেবার স্টাডিজ- বিলসের সহকারী নির্বাহী পরিচালক সুলতান উদ্দিন আহমেদ বেনারকে বলেন,  ‘বর্তমানে যে শ্রম আইন আছে সে আইন মালিকরাই মানছে না। মালিকরা শুধু আইনের কথা বলছেন। কিন্তু আইন অনুসারে কাজ করছেন না। এমনকি শ্রমিকদের সংগঠিত হওয়ার সুযোগ নেই যে, তারা তাদের অধিকারের কথা বলবে। এছাড়াও এ আইনে শাস্তিও খুব কম। তাই আইন লঙ্ঘনের ঘটনা বাড়ছে।’

শ্রমিক অধিকার আদায়ের এ সংগঠকের মতে, ‘শ্রমিকদের কর্ম পরিবেশ উন্নয়ন না করে শুধু শুধু পরিবেশ উন্নয়ন হয়েছে এ ধরণের মিথ্যা কথা বললে তো ভাবমূর্তি ক্ষুন্ন হবে। তবে আগের চেয়ে পরিবেশের কিছুটা উন্নতি হয়েছে। কিন্তু চাকুরির নিরাপত্তা পুরোপুরি নিশ্চিত হয়নি। হয়নি কর্মঘণ্টার সুষম ব্যবহার।’


‘লঙ্ঘন ঠেকাতে আইন সংশোধন করতে হবে’

সুলতান উদ্দিন আহমেদ শ্রম আইন লঙ্ঘন ঠেকাতে আইন  সংশোধনের ওপর  জোর দেন। তিনি বলেন, আইন সংশোধন করে শাস্তির পরিমাণ বাড়াতে হবে। শ্রমিকদের সংগঠিত হওয়ার সুযোগ দিতে হবে। কথা বলার অধিকার দিতে হবে। তাহলে আইন লঙ্ঘন কিছুটা কমতে পারে।


‘নতুন উদ্যোগ’

কারাখানা পরিদর্শন করে এ ধরণের প্রতিবেদন প্রকাশ নতুন উদ্যোগ বলে মন্তব্য করেন কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তরের মহাপরিদর্শক সৈয়দ আহমেদ। বেনার নিউজকে তিনি বলেন, ‘রানাপ্লাজা ঘটনার পর এ বিষয়ে জোরোসোরে কাজ শুরু হয়। এখন পরিবেশের অনেক উন্নতি হয়েছে।  আগামী প্রতিবেদনে তুলনামূলক অগ্রগতি বা অবনতির চিত্র দেখাতে পারবো। তবে আশা থাকবে ভবিষ্যতে আরও অনেক উন্নতি হবে।’

প্রতিবেদন প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘মোট সংখ্যা বেশি মনে হলেও ২৪ হাজার ১৯৭টি কলকারখানায় হয়তো গড়ে দুটি করে ঘটনা ঘটেছে। তবে এগুলোর বিরুদ্ধে নোটিশ দেওয়া হচ্ছে। এরপর মামলা করা হবে।’


‘দ্বিতীয় রানা প্লাজা হওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই’

প্রতিবেদন প্রকাশ অনুষ্ঠানে শ্রম প্রতিমন্ত্রী মুজিবুল হক চুন্নু বলেন, “সরকার পোশাক খাতের নিরাপত্তায় বিশেষ গুরুত্ব দেওয়ায় নতুন করে রানা প্লাজা ধসের মতো কোনো দুর্ঘটনা ঘটবে না। এ খাতকে আমরা বিশেষ গুরুত্ব দিচ্ছি। গত দুই বছরে বিভিন্ন উদ্যোগের কারণে দ্বিতীয় রানা প্লাজা হওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই”।

এ প্রতিমন্ত্রী বলেন, রানা প্লাজা ধসের আগে কারখানা পরিদর্শন বিভাগ নিস্ক্রিয় ছিল। এই বিভাগে জনবল নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। পরিদর্শনের সময় ঝুঁকিপূর্ণ হওয়ার কারণে ৩৭টি তৈরি পোশাক কারখানা একেবারে বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। আর ৩৬টি কারখানাকে আংশিক বন্ধ করা হয়েছে।

এক বছর পর কলকারখানাগুলো ‘ডিজিটালি’ পরিদর্শন করা হবে বলেও জানান প্রতিমন্ত্রী মুজিবুল হক।

শ্রমিকদের সুযোগ সুবিধা উন্নয়নের বিষয়ে তিনি বলেন, শ্রম বিধিমালায় শ্রমিকদের মাতৃত্বকালীন ছুটি বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। নারায়ণগঞ্জ ও গাজীপুরে শ্রমিকদের চিকিৎসার জন্য ৩০০ শয্যার দুটি হাসপাতাল নির্মাণ করা হচ্ছে।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।