শ্রম আইনের বিধিমালা গেজেট‏ আকারে প্রকাশ

ঢাকা থেকে জেসমিন পাপড়ি
2015.09.17
BD-worker বাংলাদেশে কর্মরত গার্মেন্টস শ্রমিক। সেপ্টেম্বর,২০১৫
বেনার নিউজ

সরকারি চাকুরজীবীদের মতো মূল বেতনের সমপরিমাণ দুটি বোনাসের বিধান রেখে শ্রম বিধিমালার গেজেট প্রকাশ করেছে সরকার। যার ফলে শ্রম আইন বাস্তবায়নে আর কোন বাধা থাকল না। তবে এতে শ্রমিক অধিকারের পূর্নাঙ্গ প্রতিফলন হয়নি বলে অভিযোগ শ্রমিক নেতাদের।

সংশোধিত শ্রম আইন পাসের ২৭ মাস পর গত বুধবার বহুল আলোচিত এই বিধিমালার গেজেট প্রকাশ করা হয়।

তাজরীন ফ্যাশনসে অগ্নিকাণ্ডে শতাধিক মৃত্যুর পর সাভারে রানা প্লাজা ধসে সহস্রাধিক শ্রমিকের প্রাণহানিতে আন্তর্জাতিক মহলের ব্যাপক সমালোচনার মুখে ২০১৩ সালের ১৫ জুলাই শ্রম আইন সংশোধন করে সরকার।

এর আগে ২০০৬ সালে শ্রম আইন প্রণয়ন করা হলেও তার বাস্তবায়নে গত সাত বছরে কোনো বিধিমালা না হওয়ায় বিভিন্ন জটিলতা তৈরি হচ্ছিল। সংশোধিত শ্রম আইন প্রণয়নের পর বিধিমালার দাবি আরো জোরদার হয়।

এ বিষয়ে শ্রমসচিব মিকাইল শিপার বলেন,  “আশা করি শ্রম আইন বাস্তবায়নে আর কোনো বাধা থাকবে না। সব ধরনের জটিলতার অবসান হবে।”


যা আছে বিধিতে

বাংলাদেশ শ্রম বিধিমালা-২০১৫ নামে ৩৪৩ পৃষ্ঠার গেজেটটিতে রপ্তানিমুখী শিল্পের আয়ের ০.০৩ শতাংশ শ্রমিক কল্যাণ তহবিলে জমাদান বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। ১৯টি অধ্যায়ে ৩৬৭টি বিধি সাতটি তফসিল সমৃদ্ধ বিধিমালায় আওতায় ৫০ জনের বেশি শ্রমিক আছে এমন কারখানার জন্য একটি ‘সেফটি কমিটি’ গঠনের কথা বলা হয়েছে। এই কমিটি শ্রমিকদের নিরাপত্তার সার্বিক বিষয়গুলো দেখভাল করবে। যাতে মালিক ও শ্রমিক প্রতিনিধিত্ব থাকবে।

নতুন বিধিমালায় পোশাক শ্রমিকদের উৎসব ভাতাও বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। এত দিন শ্রমিকরা উৎসব ভাতা পেলেও তা আইনে ছিল না। বিধিতে ভাতার বিষয়টি উল্লেখ থাকায় মালিকরা তা দিতে আইনত বাধ্য থাকবেন। কোনো মালিক না দিলে আইনি ব্যবস্থা নেওয়ার সুযোগ থাকবে। নতুন বিধির মাধ্যমে আউট সোর্সিং শ্রমিকদের আইনের আওতায় আনা হয়েছে। ফলে তাদের জন্য নিম্নতম মজুরি নির্ধারণ হবে। আর তাদের নিয়োগদাতারাও শ্রম আইন মানতে বাধ্য থাকবেন।

তাজরীন ফ্যাশনসে অগ্নিকাণ্ডে শতাধিকের পর সাভারে রানা প্লাজা ধসে সহস্রাধিক শ্রমিকের প্রাণহানিতে আন্তর্জাতিক মহলের অসন্তোষের মুখে ২০১৩ সালের ১৫ জুলাই শ্রম আইন সংশোধন করে সরকার।


জিএসপি ফিরে পাওয়ার অন্যতম শর্ত পূরণ

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এ বিধিমালা প্রণয়নের ফলে যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে বাংলাদেশি পণ্যের জিএসপি ফিরে পেতে এক ধাপ এগিয়ে গেল বাংলাদেশ। এই সুবিধা পুনর্বহালের জন্য যেসব শর্ত দেওয়া হয়েছিল, তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য শ্রম আইনের বিধিমালা। এটি জারি না করায় শ্রম আইনের বাস্তবায়ন ব্যহত হচ্ছিল। ফলে কারখানার কর্মপরিবেশের উন্নয়নে অনেক পদক্ষেপ নেওয়ার পরও যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের সমালোচনার মুখে পড়ে সরকার।

এদিকে শনিবার ঢাকা আসছেন যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের একটি প্রতিনিধিদল। জিএসপি পুনর্বহালের বিষয়ে এ সফরকে বিশেষ গুরুত্ব দিচ্ছে সরকার। একারণে বিধিটি তাড়াতাড়ি চূড়ান্ত করা হয়েছে বলে জানিয়েছে সরকারি সূত্র।

শ্রম প্রতিমন্ত্রী মুজিবুল হক চুন্নুও বেনারকে বলেন, “যুক্তরাষ্ট্র জিএসপি ফিরিয়ে দিতে ১৬টি শর্ত দিয়েছিল। শ্রম বিধির গেজেট প্রকাশের মাধ্যমে সবগুলো শর্তই পূরণ হয়েছে। আশা করি বাংলাদেশকে জিএসপি দিতে তাদের (যুক্তরাষ্ট্র) আর কোন আপত্তি থাকবে না।”

মূলত: আইন বাস্তবায়নের খুঁটিনাটি বিষয়গুলোর বিস্তারিত বিবরণ থাকে বিধিমালায়। কিন্তু শ্রম আইন সংশোধনের দুই বছরের বেশি সময় পেরিয়ে গেলেও তা বাস্তবায়নের জন্য সরকার বিধিমালা জারি করতে না পারার কারণে কারখানার সামগ্রিক উন্নয়নে বাংলাদেশে আইএলওর ‘বেটার ওয়ার্ক প্রোগ্রাম’ নামের বিশেষায়িত কর্মসূচি চালু হচ্ছিল না।

রানা প্লাজা ধসের পর শ্রমিক স্বার্থ সুরক্ষা এবং কারখানার মান উন্নয়নে নানা পদক্ষেপের পরেও বিধি প্রণয়নে সরকারের দীর্ঘসূত্রিতাকে বড় ‘ইস্যু’ করে তোলে বাংলাদেশের তৈরি পোশাকের বড় বাজার যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) দেশগুলো।


ইউরোপীয় ইউইনিয়ন ও যুক্তরাষ্ট্রের সন্তুষ্টি

তবে এবার শ্রম বিধিমালা প্রকাশ হওয়ায় সন্তোষ প্রকাশ করেছে ইউরোপীয় ‍ইউনিয়ন (ইইউ) ও যুক্তরাষ্ট্র।

গেজেট প্রকাশের পর এক অনুষ্ঠানে দেয়া বক্তব্যে সরকারকে ধন্যবাদ জানান ঢাকায় ইইউ’র মিশন প্রধান পিয়ের মায়োদন। তিনি বলেন,  “সঠিক পথে এগিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ ধাপ।”  আর যুক্তরাষ্ট্রের চার্জ দ্য অ্যাফেয়ার্স ডেভিড মেলে সরকারকে ধন্যবাদ জানিয়ে বলেন,  “এটি একটি মাইলফলক।”


রয়েই গেল শ্রমিক আপত্তি

শ্রমবিধি গেজেট প্রকাশের পর সরকার স্বস্তির ঢেকুর তুললেও রয়ে গেছে শ্রমিক পক্ষের আপত্তি। শ্রমিক নেতাদের অভিযোগ,  তাদের সুপারিশগুলো বাদ রেখেই প্রকাশিত হয়েছে এই বিধিমালা।

শ্রমিক কর্মচারী ঐক্য পরিষদের (স্কপ) সমন্বয়ক ওয়াজেদুল ইসলাম খান বেনারকে বলেন,  “ত্রিপক্ষীয় (সরকার, মালিক ও শ্রমিক) পরামর্শক কমিটির আলোচনায় খসড়া বিধিমালা নিয়ে আপত্তি তুলে কিছু সুপারিশ করে শ্রমিকপক্ষ। সেসব সুপারিশ যোগ করে পুনরায় বিধিমালাটি শ্রমিকপক্ষকে দেখানোর পরই গেজেট আকারে প্রকাশের কথা ছিল। কিন্তু সে প্রতিশ্রুতি মানা হয়নি। বিধিতে জায়গা পায়নি শ্রমিকপক্ষের সুপারিশ। মালিকপক্ষের চাপে মূলত: মালিক সহায়ক বিধিমালা তৈরি করেছে সরকার।”

তিনি বলেন, “দুই বছর পর নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার পরে ট্রেড ইউনিয়নগুলোকে পুনঃনবায়ন করতে বলা হয়েছে। এর অর্থ সরকার ইচ্ছে করলে চালু করা ট্রেড ইউনিয়নটি বন্ধ করতে পারে। বিধিতে কেবল স্থায়ী শ্রমিকদের ট্রেড ইউনিয়নের সদস্য হওয়ার কথা বলা হয়েছে। অথচ আমাদের সুপারিশ ছিল যেকোন ধরনের শ্রমিকই ট্রেড ইউনিয়নের সদস্যপদ পাবে। সেসব সুপারিশ গ্রহণ করা হয়নি।”

পোশাক শ্রমিক নেতা মোশরেফা মিশু বেনারকে বলেন,  “সরকারের মন্ত্রী, এমপিদের অনেকেই গার্মেন্টস মালিক। তাদের স্বার্থ দেখতেই সরকার শেষমেষ একটা মালিকবান্ধব শ্রম বিধি তৈরি করেছে। তবে যতদিন শ্রমিকদের অধিকায় আদায় না হবে, ততদিন আমাদের আন্দোলন চালিয়ে যাব।”

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।