গৃহশ্রমিকের সুরক্ষায় নীতিমালা, শ্রম হিসেবে স্বীকৃতি পেল গৃহকর্ম

ঢাকা থেকে শাহরিয়ার শরীফ
2015.12.21
BD-worker সচিবালয়ে সোমবার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে মন্ত্রিসভার নিয়মিত বৈঠকে গৃহকর্মীদের নীতিমালা অনুমোদন দেওয়া হয়।
বেনার নিউজ

দেশের প্রায় ২০ লাখ বা দুই মিলিয়ন গৃহশ্রমিকের সুরক্ষায় নতুন নীতিমালা চূড়ান্ত করেছে সরকার, যার লক্ষ্য গৃহকর্মকে শ্রম হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ার পাশাপাশি শ্রম আইন অনুযায়ী গৃহকর্মীদের বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করা।

দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে বাংলাদেশ প্রথম গৃহশ্রমিকদের বিষয়ে পূর্ণাঙ্গ নীতিমালা তৈরি করল।

“আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা কর্তৃক গৃহীত গৃহকর্ম সম্পর্কিত কনভেনশন ১৮৯ অনুসমর্থনের লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় প্রস্তুতির অংশ হিসেবে বাংলাদেশ এই নীতিমালা অনুমোদন করেছে,” বেনারকে জানান জানান মন্ত্রিপরিষদ সচিব মোহাম্মদ শফিউল আলম ।

দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে শ্রীলঙ্কা ও নেপালে গৃহশ্রমিকেরা ট্রেড ইউনিয়ন করতে পারলেও তাদের জন্য পৃথক ও পূর্ণাঙ্গ নীতিমালা নেই। ভারতের ১১ টি রাজ্যে ন্যূনতম মজুরি নির্ধারণ করা হয়েছে, সেখানে প্রসুতিকালীন সুযোগ–সুবিধা দেওয়া আছে। কিন্তু সব রাজ্যের জন্য মজুরি ও অন্যান্য সুযোগ নিশ্চিত হয়নি এখন পর্যন্ত।


নীতিমালার পর আইন করা হবে

বাংলাদেশে গতকাল সোমবার মন্ত্রিসভা গৃহকর্মীদের জন্য এ-সংক্রান্ত নীতিমালা অনুমোদন দিয়েছে। সচিবালয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে মন্ত্রিসভার নিয়মিত বৈঠকে এর অনুমোদন দেওয়া হয়।

“এই নীতিমালার আলোকে পরে আইন করা হবে,” বৈঠকের পর বেনারকে জানান শ্রম প্রতিমন্ত্রী মুজিবুল হক চুন্নু।

নীতিমালা অনুযায়ী দেশের গৃহকর্মীরা সবেতনে ১৬ সপ্তাহের মাতৃত্বকালীন ছুটি পাবেন, যা গৃহকর্তাকে দিতে হবে। গৃহশ্রমিকদের সহায়তার জন্য হেল্পলাইন চালু করবে সরকার। এ ছাড়া কোনো গৃহকর্মী যৌন হয়রানি, যৌন নির্যাতন, শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের অভিযোগে মামলা করলে সরকারকে সেই মামলা পরিচালনার খরচ দিতে হবে।

নীতিমালাটি বাস্তবায়নে শ্রম মন্ত্রণালয়ের অধীন একটি তদারকি সেল থাকবে। কোনো গৃহকর্মী বঞ্চনা বা নির্যাতনের শিকার হলে মনিটরিং সেল, মানবাধিকার ও শ্রমিক সংগঠনের কাছে টেলিফোনে, মৌখিক বা লিখিতভাবে অভিযোগ করতে পারবে।

নীতিমালায় বলা হয়েছে, গৃহকর্মীকে চাকরি থেকে অপসারণ করতে হলে এক মাস আগে তা জানাতে হবে। গৃহকর্মীও যদি চাকরি ছাড়তে চান তবে নিয়োগকারীকে তা এক মাস আগে জানাতে হবে। তাৎক্ষণিকভাবে গৃহকর্মীকে চাকরি থেকে বাদ দিলে এক মাসের মজুরি দেওয়ার বিধান করা হয়েছে।

পূর্ণকালীন গৃহকর্মী নিয়োগ দিয়ে তার ছবিসহ বিষয়টি সংশ্লিষ্ট থানাকে অবহিত করতে বলা হয়েছে। নীতিমালায় আরও বলা হয়েছে, গৃহকর্মী অপরাধ করলে প্রচলিত আইনে ব্যবস্থা গ্রহণ করা যাবে, তবে নিয়োগকারী নিজে তাকে শারীরিক বা মানসিক শাস্তি দিতে পারবেন না।

গৃহকর্মীর বয়স হবে ন্যূনতম ১৪ বছর। তবে তাকে হালকা কাজ করতে দিতে হবে। এ ছাড়া ১২ বছর বয়সের কাউকে গৃহকর্মী হিসেবে রাখতে হলে তার আইনানুগ অভিভাবকের সঙ্গে তৃতীয় কোনো পক্ষের উপস্থিতিতে নিয়োগকারীকে আলোচনা করতে হবে। সে ক্ষেত্রে ওই শিশুর স্বাস্থ্য যাতে বিপজ্জনক না হয় এবং শিক্ষা গ্রহণে যাতে বিঘ্ন না ঘটে তা বিবেচনায় নিতে হবে।


বিভিন্ন অধিকার লাভ করবে গৃহকর্মিরা

“গৃহশ্রমিকদের জন্য এত দিন কিছুই ছিল না। এই নীতিমালা তাদের অধিকার প্রতিষ্ঠায় মাইলফলক, যার ভিত্তিতে আইনের দাবি জোরদার হবে,” বেনারকে জানান বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব লেবার স্টাডিজের (বিলস) অ্যাডভোকেসি কর্মকর্তা নজরুল ইসলাম।

তিনি বলেন, এটা নীতিমালা হলেও অন্য সাধারণ নীতিমালা থেকে আলাদা। কারণ এই নীতিমালা প্রয়োগযোগ্য, যা আইনে পরিণত হলে এর ভিত্তি আরও বেশি মজবুত হবে।

ওই নীতিমালায় বলা হয়েছে, প্রাপ্তবয়স্ক গৃহকর্মীকে নিয়োগ করতে হলে আলোচনা, সমঝোতা ও ঐকমত্যের পর তৃতীয় পক্ষের উপস্থিতিতে আলোচনা বাঞ্ছনীয়। গৃহকর্মীদের শ্রমঘণ্টা এবং বেতন আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে ঠিক করতে হবে। নীতিমালায় গৃহকর্মীদের বিশ্রামের পাশাপাশি বিনোদনের সময় দেওয়ারও নির্দেশনা রয়েছে।

গৃহশ্রমিক নিয়োগের চুক্তিতে আটটি বিষয় উল্লেখ করতে হবে, যেগুলোর মধ্যে রয়েছে নিয়োগের ধরন, তারিখ, মজুরি, বিশ্রামের সময় ও ছুটি, কাজের ধরন, গৃহকর্মীর থাকা-খাওয়া, পোশাকপরিচ্ছদ ও শারীরিক পরিচ্ছন্নতা এবং গৃহকর্মীর বাধ্যবাধকতা।

শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, সারা দেশে কতজন গৃহকর্মী রয়েছে, সেই তথ্য মন্ত্রণালয়ের কাছে নেই। তবে অনুমান করা হয়, গৃহশ্রমিকদের নিয়ে কাজ করা বেসরকারি সংগঠনগুলোর হিসেবে, দেশে গৃহকর্মীর সংখ্যা এখন ২০ লাখের বেশি। ২০১০ সালে সরকারের লেবার ফোর্স সার্ভে অনুযায়ী দেশে গৃহশ্রমিকের সংখ্যা ছিল প্রায় ১৪ লাখ।

এদিকে গৃহকর্মীদের সঙ্গে অশালীন আচরণ, দৈহিক বা মানসিক নির্যাতন করা যাবে না উল্লেখ করে নীতিমালায় বলা হয়েছে, গৃহকর্মীর ওপর কোনো হয়রানি ও নির্যাতন হলে বিচারের দায়িত্ব সরকারের।

কোনো গৃহকর্মী নিয়োগকারী, তার পরিবারের সদস্য বা অতিথিদের দ্বারা শারীরিক, মানসিক বা যৌন হয়রানির শিকার হলে আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

নীতিমালা অনুযায়ী, গৃহকর্মী নির্যাতন বা হয়রানির ঘটনায় সংশ্লিষ্ট থানা যেন দ্রুত ও কার্যকরী ব্যবস্থা নিতে পারে সে জন্য স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে দাপ্তরিক নির্দেশনা জারি করতে হবে।

নীতিমালায় আরও বলা হয়েছে, পূর্ণকালীন গৃহকর্মীর মজুরি যাতে তার পরিবারসহ সামাজিক মর্যাদার সঙ্গে জীবনযাপনের উপযোগী হয় নিয়োগকারীকে তা নিশ্চিত করতে হবে। তবে গৃহকর্মীর ভরণ-পোষণ, পোশাকপরিচ্ছদ দেওয়া হলে তা মজুরির অতিরিক্ত বলে গণ্য হবে।

নীতিমালায় বলা আছে, প্রত্যেক গৃহকর্মীর কর্মঘণ্টা এমনভাবে বিন্যস্ত করতে হবে যাতে তিনি পর্যাপ্ত ঘুম, বিশ্রাম, চিত্তবিনোদন ও প্রয়োজনীয় ছুটির সুযোগ পান। অসুস্থ অবস্থায় কোনো গৃহকর্মীকে দিয়ে কাজ করানো যাবে না এবং নিয়োগকারীকেই নিজের অর্থে তার চিকিৎসা করাতে হবে।

এ ছাড়া গৃহকর্মীকে তার নিজের ধর্ম পালনের সুযোগ দিতে হবে। কর্মরত অবস্থায় কেউ দুর্ঘটনার শিকার হলে চিকিৎসাসহ দুর্ঘটনা ও ক্ষতির ধরন অনুযায়ী নিয়োগকারীকে ক্ষতিপূরণ দিতে হবে।


আইনী নিরাপত্তার দিক

গৃহকর্মী যদি কর্মরত পরিবারের শিশু, অসুস্থ ও বৃদ্ধ ব্যক্তিসহ কোনো সদস্যের সঙ্গে শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন বা পীড়াদায়ক আচরণ করেন তবে নিয়োগকারী তার নিয়োগ বাতিল করে তার বিরুদ্ধে আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নিতে পারবেন।

কাউকে না জানিয়ে গৃহকর্মী চলে গেলে নিয়োগকারী সংশ্লিষ্ট থানার জিডি করতে পারবেন। তবে অর্থ বা মালামাল নিয়ে গৃহকর্মী চলে গেলে সে ক্ষেত্রে আইনের আশ্রয় নিতে পারবেন নিয়োগকারী।

এ ছাড়া সিটি করপোরেশন এলাকায় আঞ্চলিক বা প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা এবং জেলা-উপজেলায় যথাক্রমে জেলা প্রশাসক ও উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাকে সভাপতি করে মনিটরিং সেল গঠন করা হবে বলেও নীতিমালায় উল্লেখ রয়েছে।

বাংলাদেশ শ্রমিক কল্যাণ ফাউন্ডেশন আইন ২০০৬ অনুযায়ী প্রতিষ্ঠিত শ্রমিক কল্যাণ ফাউন্ডেশন তহবিল থেকে গৃহকর্মীদের যৌক্তিক সুবিধা প্রাপ্তি নিশ্চিত করতে সরকার উদ্যোগ নেবে বলেও ওই নীতিমালায় উল্লেখ করা হয়।

নীতিমালাটি মন্ত্রিসভায় অনুমোদিত হওয়ায় সরকারকে অভিনন্দন জানিয়েছে গৃহশ্রমিক অধিকার প্রতিষ্ঠা নেটওয়ার্ক।

“গৃহশ্রমিকদের অধিকার প্রতিষ্ঠায় নীতিটি যুগান্তকারী পদক্ষেপ। এর বাস্তবায়নের মধ্য দিয়ে দেশে কর্মরত চরম অবহেলিত ও অধিকারবঞ্চিত বিপুলসংখ্যক গৃহশ্রমিকের আইনগত সুরক্ষা নিশ্চিত করা সম্ভব হবে,” গতকাল সোমবার এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে নেটওয়ার্কের পক্ষ থেকে এই প্রতিক্রিয়া

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।