সরকার বাংলাদেশে মৌলবাদীদের ‘সহযোগিতা’ করছে, লেখকের অভিযোগ
2016.03.01
ইসলামি জঙ্গিরা বাংলাদেশে যখন সেকুলার ও নাস্তিক লেখকদের হত্যা করে যাচ্ছে সরকার তখন অন্যভাবে দেখছে, আর একজন প্রকাশক তখন তাঁর সহকর্মিদের উপর হামলার পর দেশ ছেড়ে বিদেশে চলে গেলেন।
গেল এক বছর ধরে মৌলবাদী জঙ্গিদের চাপাতির আক্রমনের মুখে ৪ লেখক এক প্রকাশকের জীবন হানি ঘটলো, শুধু এই কারণে যে তাঁদের লেখালেখিতে ধর্মীয় উগ্রবাদের সমালোচনা করা হয়েছে। বাংলাদেশের মুক্তচিন্তার লেখক-প্রকাশকরা চুপ করে থাকতে রাজী নন, তাদের অনেকে দেশের বাইরে আশ্রয় নিচ্ছেন।
বাংলাদেশ থেকে গত ডিসেম্বরে দেশত্যাগী লেখক-প্রকাশক মাহবুব লীলেন জানালেন, “মৌলবাদীরা সরকারের কাছ থেকে সবুজ সংকেত পেয়েছে সরাসরি বা গোপনে, যদি তারা কাউকে খুন করে তাহলে কিছুই হবে না”।
তাদের একজন মাহবুব লীলেন গত ডিসেম্বরে স্বদেশ ছেড়ে ভিন দেশে রাজনৈতিক আশ্রয় নিতে বাধ্য হলেন যখন তাঁর প্রকাশনা কেন্দ্র গত অক্টোবরে চাপাতিধারী আততায়ীদের আক্রমনের শিকার হলো, মারাত্নক আহত হয়ে তাঁর ৩ সহকর্মি ও লেখক বন্ধুরা মৃত্যুর হাত থেকে অল্পের জন্য বেঁচে গেলেন।
৪১ বছরের লীলেন বেনার নিউজের সাথে স্কাইপে এক সাক্ষাতকারে জানালেন, তিনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে রাজনৈতিক আশ্রয় নিতে যাচ্ছেন কারণ দেশে তাকে জঙ্গিরা যে কোনো সময় আক্রমন করতে পারে অথবা পুলিশ গ্রেপ্তার করতে পারে।
২০০৩ সাল থেকে আনসারুল্লাহ বাংলা টিম কয়েক ডজন বুদ্ধিজীবী ও লেখক-ব্লগারদের হিট-লিস্ট প্রকাশ করে আসছে তাঁদেরকে ইসলাম বিরোধী আখ্যা দিয়ে। কর্তৃপক্ষ সেকুলার কর্মিদের আটকও করেছে ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাতের অভিযোগ তুলে।
লীলেন নিজেও একজন লেখক ও শুদ্ধস্বর প্রকাশনার একজন সহ-প্রতিষ্ঠাতা, যেখান থেকে সেকুলার ও মুক্তচিন্তার লেখকদের গ্রন্থ প্রকাশিত হয়ে আসছে ২০০৪ সাল থেকে।
গত ৩১ অক্টোবর তিনি প্রকাশনার কার্যালয়ে হাজির ছিলেন না। যেখানে তার ৩ সহকর্মি হামলার শিকার হন। একইদিন শহরের অন্য প্রান্তে জঙ্গিরা জাগৃতি প্রকাশনার স্বত্তাধিকারী ফয়সল আরেফিন দীপনকে চাপাতি দিয়ে কুপিয়ে নির্মমভাবে হত্যা করে।
এটা ছিলো ২০১৫ সালে চাপাতিযোগে ৫ম খুন এবং এই খুনের মধ্য দিয়ে লেখক-ব্লগারদের বাইরে প্রকাশকদের দিকেও হাত বাড়ায় তারা।
সেদিন কেউই গ্রেপ্তার হয় নাই। কিন্তু পুলিশ শুদ্ধস্বরের কার্যালয় ও শোরুম নিরাপত্তার কথা বলে সীল করে দেয়। লীলেন মনে করেন, সরকার রাজনৈতিক কারণে মৌলবাদিদের সহযোগিতা করছে।
তাঁর সহকর্মি আহমেদুর রশীদ টুটুল যিনি ৩১ অক্টোবর হামলায় মারাত্নকভাবে আহত হন, তিনিও দেশের বাইরে চলে গেছেন। তারা এখন পরিকল্পনা করছেন দেশের বাইরে থেকে মুক্তমনা লেখকদের বই চাহিদা-মোতাবেক-প্রিন্ট প্রযুক্তি ব্যবহার করে সেই সঙ্গে ই-বুক বের করে দেশে বিদেশে পাঠকদের হাতে তুলে দিতে।
লীলেন নিহত লেখক অভিজিতের বই বিনামূল্যে ইন্টারনেটে প্রকাশের উদ্যোগের সঙ্গেও জড়িত।
লীলেন অভিজিতের একজন ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলেন। নিহত হবার দিনও বইমেলায় লীলেন অভিজিতের সঙ্গে সময় কাটিয়েছেন, ভবিষ্যত প্রকল্প নিয়ে কথা বলেছেন ও সেদিন সমকামী বাংলাদেশি লেখকদের লেখা নিয়ে সংকলিত বই-এর মোড়ক উন্মোচনেও হাজির ছিলেন দুজনই।
গত ২৬ ফেব্রুয়ারি অভিজিৎ হত্যার একবছর পূর্তির আগেভাগে লীলেন বেনার নিউজের সঙ্গে কথা বলছিলেন।
বেনার নিউজঃ অভিজিৎ রায় হত্যাকান্ডের বছর পূর্তিতে আপনার ভাবনা-চিন্তা বা প্রতিক্রিয়া কি?
লীলেনঃ আপনি সব জায়গায় অনেক লোক পাবেন যারা খুব ভালো বিজ্ঞান বোঝে। আপনি খুঁজে পাবেন সব জায়গায় অনেকে ভালো লিখতেও পারে। কিন্তু আপনি খুব কম লোকই পাবেন যারা জীবনভর বিজ্ঞান মনস্ক। তাদের হয়তো লেখার ক্ষমতা বা বিজ্ঞানের জ্ঞান তেমন নাই।
অভিজিৎ ছিলেন এই তিন ধারার সমন্বয়। তিনি বিজ্ঞানের মানুষ ছিলেন, তাঁর ছিলো লেখালেখির উচ্চ ক্ষমতা এবং ছিলেন বিজ্ঞান মনস্ক মানুষ।
সেই সঙ্গে তিনি ছিলেন তরুন মুক্তচিন্তার লেখকদের সংগঠক ও শিক্ষক।
একবছর পর আমার পক্ষে এই বর্ষপূর্তির কথা চিন্তা করা খুব কঠিন। তিনি শুধু আমার বন্ধুই ছিলেন না, ছিলেন এমন একজন যাকে আমি যে কোনো কথা জিজ্ঞেশ করতে পারতাম। আমার নিজের লেখালেখির ব্যপারে আমি আস্থাশীল হতে পারতাম।
বেনার নিউজঃ অভিজিৎকে কেনো খুন করা হলো?
লীলেনঃ তারা অভিজিতের উপর হামলা চালিয়েছে তাঁর নির্দিষ্ট কোনো বইয়ের জন্য নয়। বরং তাকে আক্রমন করা হয়েছে মুক্ত-মনা’র জন্য। এই মুক্ত-মনা ব্লগ সাইটের মাধ্যমেই তিনি নাস্তিক লেখকদের এবং তরুন নাস্তিকদের সংগঠক হয়ে উঠেছিলেন।
বেনার নিউজঃ একবছরের মধ্যে ৫ জনকে খুন করা কিভাবে সম্ভব হলো?
লীলেনঃ ২০১৩ সাল থেকেই সরকার মৌলবাদীদের সাথে সহযোগিতা করতে শুরু করে। এটা সত্যি। তারা সেকুলার লেখকদের লেখা বন্ধের জন্য আইসিটি এক্ট বা (ইনফরশন এন্ড কমিউনিকেশন টেকনোলজি এক্ট) আইনের সংশোধন করে ও নতুন আইন করে। বাংলাদেশে যে কোনো হত্যা প্রচেষ্টার সাজা হয় ২ বছর মাত্র এবং তা জামিন যোগ্য। কিন্তু আইসিটি আইন জামিনযোগ্য নয়। সর্বনিম্ন সাজা ৭ বছর, সর্বোচ্চ সাজা ১৪ বছর, এবং এটা হতে পারে ফেসবুকে একটা স্ট্যাটাস লিখেই। কেউ যদি পুলিশকে জানায় যে এই লোক ফেসবুকে যে স্ট্যাটাস পোস্ট করেছে তা তার অনুভূতিতে আঘাত হেনেছে। তখন পুলিশ এসে আমাকে ধরে নিয়ে যেতে পারবে এবং ৭ বছরের সাজা দিতে পারবে।
২০১৩ সালে মৌলবাদীরা প্রথম বুঝতে পারে ব্লগারদের সক্ষমতা, তখন তারা ঢাকা অভিমুখে যাত্রা করে, দাবি জানায় ব্লগারদের মৃত্যুদন্ডের।
আর নির্বাচনের রাজনীতিতিতে লেখকরা কার্যকর ভোটার নয়। তারা অনেক কথা বলে কিন্তু ভোট কেন্দ্রে যায় না বা কারো পক্ষে প্রচারণা চালায় না। কিন্তু মৌলবাদীরা খুবই সংগঠিত গ্রুপ এবং তাদের ভোট ব্যাংক আছে। আর তাই সরকার সিদ্ধান্ত নিয়েছে তাদের সাথে হাত মেলানোই ভালো।
আর মৌলবাদীরা সরকারের কাছ থেকে সবুজ সংকেত পেয়েছে সরাসরি বা গোপনে, যদি তারা কাউকে খুন করে তাহলে কিছুই হবে না।
বেনার নিউজঃ ৩১ অক্টোবর আপনি কোথায় ছিলেন?
লীলেনঃ সেদিন ছিলো শনিবার ছুটির দিন। আমি বাড়িতেই ছিলাম। ওই সময় ২ জন লেখক শুদ্ধস্বর অফিসে সকাল থেকেই ছিলেন। রণদ্বীপ বসু ও তারেক রহিম তাদের বইয়ের কাজ করছিলেন। টুটুল সেখানে ১১টার দিকে যায়। আমার ধারনা টুটুলকে যারা অনুসরণ করছিলো তারা দেখে নাই আরো ২জন আগে থেকেই সেখানে ছিলো।
একই সময় অন্যদিকে, জাগৃতির প্রকাশক দীপনকে খুন করে। সে তাঁর অফিসে একাই কাজ করছিলো। আমরা ধারনা দুই জায়গায় দুটি দল একই সময় দিনের মাঝামাঝি আক্রমন ঘটায়। দীপন হত্যার শিকার হয় আর এঁরা বেঁচে যান।
আক্রমনের পর তারা বাইরে থেকে তালা বন্ধ করে দিয়ে যায়। রণদ্বীপন বসু বুঝতে পারলো আক্রান্ত হবার পর সে মারা যাবার পথে। তখন সে তার মোবাইল থেকে ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিয়ে বলে, ‘আমরা আক্রমনের শিকার হয়েছি শুদ্ধস্বর অফিসে, টুটুল আমি আর তারেক’। সঙ্গে সঙ্গে বন্ধুরা স্ট্যাটাস দেখতে পায় এবং ২০/৩০ মিনিটের মধ্যে তারা এসে আমাদের উদ্ধার করে, সেটা সম্ভব হয় ফেসবুকে স্ট্যাটাস দেবার কারণেই।
হামলার একদিন পর টুটুল আমাকে বার্তা পাঠায়, ‘যত শিঘ্র সম্ভব দেশের বাইরে যাবার চেষ্টা করো’। প্রত্যেকেই এখন বলছে মৌলবাদীরা এখন লেখকদের উপর আক্রমনের চাইতে প্রকাশনা বন্ধের লক্ষ্য ঠিক করেছে। কারণ, লেখকদের সংখ্যা অনেক।
বেনার নিউজঃ আপনার রাজনৈতিক আশ্রয় চাইবার ভিত্তি কি?
লীলেনঃ ভয় পেয়েছি দুদিক থেকে। যেকোনো সময় মৌলবাদীদের দ্বারা আমি আক্রান্ত হতে পারি আর পুলিশ আমাকে গ্রেপ্তার করতে পারে। এবছর তারা বইমেলায় একটা প্রকাশনার স্টল বন্ধ করেছে এবং তার প্রকাশক শামসুজ্জামান মানিককে গ্রেপ্তার করেছে। শামসুজ্জামান মানিক একজন সিনিয়র লেখক, বয়স প্রায় ৭০। তিনি একজন এক্টিভিস্ট ও প্রকাশক। তারা প্রিন্টিং প্রেসের ম্যানেজারকেও গ্রেপ্তার করেছে। এটা অন্য প্রিন্টিং হাউজের জন্যে একটা সতর্ক বার্তা। যাতে এই ধরনের বই কেউ প্রকাশ না করে। এখন পুলিশ লেখকদেরকেও ধরতে শুরু করেছে।
বেনার নিউজঃ বাংলাদেশ গত একবছরে কি হারিয়েছে বলে মনে করেন?
লীলেনঃ সেকুলার দেশ হিসেবে এবং মডারেট মুসলিম দেশ হিসেবে বাংলাদেশের যে পরিচয় বিশ্বব্যাপী ছিলো সেটা হারিয়েছে। আমার পক্ষে এ কথা বলা খুব কষ্টকর যে, আমিও সে আস্থা হারিয়েছি, কারণ লোকে যখন আমার সাথে কথা বলে তারা আমাকে বাংলাদেশিই মনে করে।
বেনার নিউজঃ দেশে ফিরে যাবেন কখনো সে ভাবনা কি আছে?
লীলেনঃ আমি যেতে চাই। আমি শুধু আমার কাজ ছেড়ে আসিনি, দুটি বাড়িও ছেড়ে এসেছি। সেইসঙ্গে আমার বন্ধুদের, হাজারো বন্ধু ও পরিবারের সদস্য সেখানে আছে। লোকেরা সাধারনত বলে ‘আমি আমার দেশকে পছন্দ করি’। কিন্তু আমি সব সময় বলি, ‘আমার দেশ আমাকে ভালবাসে’। আমার টাকা-পয়সা বা আর কিছু নেই, জরুরি পরিস্থিতিতে আমি সেখানে সাহায্য বিহীন থাকবো না।
আমি কথা বলি, লিখি এবং বাংলা নাটকের কাজ করি। আমি সেরকম কিছু পৃথিবীর কোথাও খুঁজে পাবনা। আমি যখন চিন্তা করি, স্বপ্ন দেখি তখন বাংলায় স্বপ্ন দেখি।
আমি নতুন করে জীবন শুরু করতে পারবো না, এবং অন্য কোনো জাতিগত নাগরিক হতে পারবো না। আমি হয়তো এখানে থাকার অনুমতি চাইবো এবং টিকে থাকার জন্য টাকা রোজগার করবো। কিন্তু আমিতো আমার জীবন এখানে ফিরে পাবো না। এখানকার জাতিগোষ্ঠির সাথে মিশেও যেতে পারবো না। আর তাই, যখনই সুযোগ পাবো অবশ্যই আগামিতে দেশে ফিরে যাবো।
বেনার নিউজঃ এখন আপনি এখানে কি করছেন?
লীলেনঃ আমি এখানে দুটি কাজ করার চেষ্টা করছি। লেখালেখি অব্যাহত রাখা, শুদ্ধস্বরের ই-বুক পাবলিকেশন চালু করা। এবং মুক্ত-মনার সাথে আমরা বইয়ের আর্কাইভ তৈরি করার চেষ্টা করছি। সেটা হলো “মুক্তান্বেষা”, বন্যা (রাফিদা বন্যা আহমেদ, অভিজিতের বিধবা স্ত্রী)ইতিমধ্যে একটি ঘোষণা দিয়েছেন যে, অভিজিতের সব ই-বুক সেখানে বিনা মূল্যে পাওয়া যাবে। যার অধিকাংশই মুক্ত-মনার সাইটে দেয়া আছে। ক্রমাগত অন্যান্য বইও দেয়া হবে। আমি মুক্ত-মনার আর্কাইভের সাথে কাজ করছি।
তারা যদি প্রকাশনা ও লেখার বই বন্ধ করতে পারে তখন সব কিছুই বন্ধ করতে পারবে। এটা শুধু একজনের জীবন নয়, আমরা প্রায় ৩ হাজার লেখকের দায়িত্ব নিয়েছি।
অভিজিতের ইমেজ যদি অবরুদ্ধ করতে পারে মৌলবাদীরা তখন ভাববে যে তারা জয়ী হয়েছে। অভিজিতের উদ্দীপনা নিয়ে এখন আমি কাজ করছি তরুনদের সাথে, ব্লগারদের সাথে। আমরা যদি থেমে যাই, আমরা পরাজিত হবো।