বিজিএমইএ-এর অবৈধ ভবন ভেঙে ফেলা এখন সময়ের ব্যাপারমাত্র
2016.06.02
গত প্রায় দেড় দশক ধরে আলোচিত বিজিএমইএ ভবন ভাঙতে আইনের সব প্রক্রিয়া শেষ হয়েছে। হাইকোর্টের দেওয়া রায় গতকাল বৃহস্পতিবার আপিল বিভাগ বহাল রাখায় ১৬ তলার ওই ইমারতটি ভেঙে ফেলা এখন সময়ের ব্যাপারমাত্র। পুনর্বিবেচনা আবেদনের সুযোগ থাকলেও আইনজ্ঞরা বলছেন, প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহার নেতৃত্বাধীন বেঞ্চ এই রায় ঘোষণা করেছেন। এরপর পুনর্বিবেচনা আবেদন তাঁর কাছেই করতে হবে। অতএব, ভবন রক্ষার সম্ভাবনা এক অর্থে নেই বলে অনুমান করা যায়।
রাজধানীর দৃষ্টিনন্দন হাতিরঝিল প্রকল্প এলাকায় পরিবেশের ক্ষতি করে বেআইনিভাবে প্রায় দেড় দশক আগে গড়ে তোলা হয় বিজিএমইএ ভবন।
পরিবেশবাদী বিভিন্ন সংগঠন বলে আসছিল, উন্মুক্ত স্থান ও প্রাকৃতিক জলাধার সংরক্ষণ আইন-২০০০ ভঙ্গ করে জলাধারের শ্রেণি বা প্রকৃতি পরিবর্তন করা হয়েছে। এ জন্য ওইসব সংগঠনও ভবনটি ভাঙার দাবি জানিয়ে আসছিল।
২০১০ সালের ২ অক্টোবর রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক) অনুমোদন ছাড়া এই ভবন নির্মাণ বিষয়ে একটি জাতীয় দৈনিকে প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। প্রতিবেদনটি আদালতের দৃষ্টিতে আনেন সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ডি এইচ এম মুনিরউদ্দিন। এরপর দীর্ঘ আইনি প্রক্রিয়া শেষে গতকাল ভবনটি ভেঙে ফেলার চূড়ান্ত রায় এসেছে। আপিলের পূর্ণাঙ্গ রায় হাতে পাওয়ার পর বিজিএমইএর বোর্ড সভায় আলোচনাসাপেক্ষে রিভিউয়ের বিষয়ে পদক্ষেপ নেওয়া হবে।
এর আগে জমির মালিকানা না থাকা ও জলাধার আইন লঙ্ঘন করে হাতিরঝিলে বিজিএমইএ ভবন নির্মাণের অভিযোগ প্রমাণ হওয়ায় হাইকোর্ট ২০১১ সালের ৩ এপ্রিল ভবনটি ভেঙে ফেলার রায় দেন। এতে জলাধার আগের অবস্থায় ফিরিয়ে আনতে বলা হয়।
“ভবনটি ভাঙতে আইনগত আর কোনো বাধা রইল না। এটা আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার বড় দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে,” বেনারকে জানান আইনজীবী মনজিল মোরসেদ, যিনি এ মামলায় হাই কোর্টে অ্যামিকাস কিউরি ছিলেন।
“যাঁরা অন্যায় করে থাকেন, তাঁদের জন্য এটা বড় ম্যাসেজ। যাঁরা অর্থবিত্ত ও প্রভাবের কারণে আইনের উর্ধ্বে থাকতে চান, তাঁরা এ ঘটনা থেকে শিক্ষা নেবেন বলে আশা করা যায়,” বেনারকে জানান স্থপতি ইকবাল হাবিব। ইকবাল হাবিব পরিবেশ আন্দোলনের একজন নেতা, যিনি অবৈধভাবে গড়ে ওঠা বিজিএমইএ ভবন ভাঙার আন্দোলনে সামনের সারিতে ছিলেন।
অন্যদিকে বিজিএমইএর আইনজীবী ব্যারিষ্টার রফিক-উল হক রায় ঘোষণার পর সাংবাদিকদের বলেন, “হাই কোর্ট বলেছিল ভবনটি ভেঙে দিতে। আপিল বিভাগ এটি কনফার্ম করেছে। তার মানে বিল্ডিংটা ভেঙে দিতে হবে।”
উল্লেখ্য, ২০১১ সালে হাই কোর্ট রায়ে বলেছিল, বিজিএমইএ ভবনটি সৌন্দর্যমণ্ডিত হাতিরঝিল প্রকল্পে একটি ক্যান্সারের মতো। এ ভবন অচিরেই বিনষ্ট না করা হলে এটি শুধু হাতিরঝিল প্রকল্পই নয়, সমস্ত ঢাকা শহরকে সংক্রামিত করবে।
তবে রপ্তানি আয়ের প্রধান খাত পোশাক শিল্পের ব্যবসায়ীদের এই ভবনটি ভাঙলে তা অর্থনীতির ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করা হচ্ছে।
“আমি মনে করি, এটা ভেঙে দিলে অর্থনীতিতে খারাপ প্রভাব পড়তে পারে। কারণ অর্থনীতি দাঁড়িয়ে আছে গার্মেন্টস শিল্পের ওপরে,” সাংবাদিকদের বলেন ব্যারিস্টার রফিক।
এর আগে হাই কোর্টের রায়ে বলা হয়, দেশের প্রধান রপ্তানি পণ্যের শিল্পোদ্যোক্তারা ‘আর্থিক পেশিশক্তির অধিকারী বলে’ তাঁদের ‘আইনের ঊর্ধ্বে রাখতে হবে’ এমন যুক্তি কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়।
ওই রায়ে বলা হয়, বিজিএমইএ যাদের কাছে ওই ভবনের ফ্ল্যাট বা অংশ বিক্রি করেছে, এক বছরের মধ্যে তাদের টাকা ফেরত দিতে হবে।
ক্রেতাদের সঙ্গে ওই চুক্তি বেআইনি উল্লেখ করে রায়ে আরও বলা হয়, ওই জায়গায় ভবন নির্মাণ বা কোনো অংশ কারও কাছে বিক্রির কোনো অধিকার বিজিএমইএর ছিল না। “তবে ক্রেতারা যেহেতু নিজেরাও জানত বা তাদের জানা উচিৎ ছিল যে, এ জমির উপর বিজিএমইএর কোনো মালিকানা নেই এবং ভবনটি বেআইনিভাবে নির্মাণ করা হয়েছে। সুতরাং তারা কোনো ইন্টারেস্ট পাওয়ার দাবিদার নয়,” রায়ে উল্লেখ করে হাইকোর্ট।
বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় থাকাকালে ১৯৯৮ সালে বিজিএমইএ তাদের প্রধান কার্যালয় ভবন নির্মাণের জন্য পাঁচতারা সোনারগাঁও হোটেলের পাশে এ জায়গাটি নির্ধারণ করে। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অনুমতি নিয়ে রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) কাছ থেকে ৫ কোটি ১৭ লাখ টাকায় জমিটি ক্রয় করে ব্যবসায়ি সংগঠনটি। ওই বছরের নভেম্বরে ভবনটি তৈরির কাজ শুরু হয়।
হাই কোর্টের রায়ে বলা হয়, রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরো ওই জমি বিজিএমইএকে ভবন তৈরির জন্য বেআইনিভাবে প্রদান করেছিল। অথচ ব্যুরো ২০০৬ সালের আগ পর্যন্ত ওই জমির মালিকই ছিল না। ওটা ছিল বাংলাদেশ রেলওয়ের জমি।
এর আগে ২০০৮ সালে সেনা–সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময়ে ঢাকার আরেকটি বহুতল ভবন ভেঙ্গে ফেলা হয়। দেশের শীর্ষস্থানীয় র্যাংগস গ্রুপ আইন লঙ্ঘন করে ২২ তলা ভবন নির্মাণ করেছিল। তত্ত্বাবধায়ক সরকার ওই ভবনটির কয়েকটি তলা রেখে ১৪টি তলা ভেঙে গুড়িয়ে দেয়। এরপর থেকে বিজিএমইএ ভবন ভাঙার দাবি জোরদার হয়।