২৭টি চুক্তি ও সমঝোতা স্মারকে সই করেছে বাংলাদেশ ও চীন

ঢাকা থেকে জেসমিন পাপড়ি
2016.10.14
Share on WhatsApp
Share on WhatsApp
161014-BD-china-1000.jpg চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং (বামে) শুক্রবার বিকেলে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাথে তাঁর কার্যালয়ে সাক্ষাৎ করেন। অক্টোবর ১৪, ২০১৬।
এএফপি

বাংলাদেশ ও চীন ২০১৭ সালকে ‘বিনিময় ও বন্ধুত্বের’ বছর হিসেবে অভিহিত করেছে। উভয় দেশ বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ককে ‘সহযোগিতার কৌশলগত অংশীদারত্বে’ নিয়ে যেতে রাজি হয়েছে।

শুক্রবার ঢাকায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের বৈঠকে এ বিষয়ে মতৈক্য হয়। এ সফরের মধ্য দিয়ে দুদেশের সম্পর্ক নতুন উচ্চতায় পৌঁছাল বলে মনে করছে দু’দেশই।

চীনা প্রেসিডেন্ট দুই দিনের রাষ্ট্রীয় সফরের প্রথম দিনে গতকাল বিকেলে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে তাঁর কার্যালয়ে বৈঠক করেন। তাঁদের বৈঠকের পর দুই দেশ ২৭টি চুক্তি ও সমঝোতা স্মারক সই করেছে। এর মধ্যে রয়েছে বিভিন্ন ক্ষেত্রে সহযোগিতা নিয়ে ১৫টি সমঝোতা স্মারক এবং ১২টি ঋণ ও রূপরেখা চুক্তি।

এ ছাড়া চীনের অর্থায়নে গতকাল ছয়টি প্রকল্পের ফলক উন্মোচন করা হয়েছে। প্রকল্পগুলো হলো কর্ণফুলী নদীর বহুমুখী টানেল, খুলনা ও চট্টগ্রামে ৩২০ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন দুটি বিদ্যুৎকেন্দ্র, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে কনফুসিয়াস ইনস্টিটিউট, ন্যাশনাল ডেটা সেন্টার এবং শাহজালাল সার কারখানা।

তবে চীনের প্রেসিডেন্টের এই সফরে বাংলাদেশকে দেওয়া আর্থিক সহায়তার পরিমাণ কত, তা তাৎক্ষণিক ভাবে জানানো হয়নি। সরকারের বিভিন্ন সূত্র বলছে, এটা প্রকাশ করতে কয়েকদিন সময় লাগবে।

আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষকেরা বাংলাদেশের উন্নয়নে চীনের এ সহযোগিতাকে কূটনৈতিক সাফল্য হিসেবে দেখছেন। তবে তাঁরা জোর দিয়েছেন প্রকল্প বাস্তবায়ন ও চীনের বাজারে রপ্তানির বাড়ানোর সক্ষমতা বৃদ্ধির দিকেও।

চীনের প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে আনুষ্ঠানিক আলোচনার পর গণমাধ্যমের সামনে দেওয়া বক্তৃতায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, “কৌশলগত অংশীদারত্বের মাধ্যমে দুই দেশের জনগণের আর্থ–সামাজিক অগ্রগতিতে আমরা কাজ করতে সম্মত হয়েছি।”

প্রধানমন্ত্রী আরও বলেন, “আমাদের লক্ষ্য ২০২১ সালের মধ্যে জ্ঞানভিত্তিক মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত হয়ে চূড়ান্তভাবে ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত দেশে পরিণত হওয়া।”

গত ৩০ বছরে এটাই কোনো চীনা রাষ্ট্রপ্রধানের বাংলাদেশ সফর। ওয়ান-বেল্ট, ওয়ান রোড নীতি ধরে এগিয়ে যাওয়া চীনের সহযোগিতা সম্প্রসারণের অংশ হিসেবেই জিনপিংয়ের এই সফর। সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় সম্মানে চীনের রাষ্ট্রপতিকে স্বাগত জানান প্রেসিডেন্ট আবদুল হামিদ।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা চীনের রাষ্ট্রপ্রধানের এ সফরকে সম্পর্কের নতুন যুগের সূচনা বলে আখ্যা দিয়েছেন। আর চীনও বাংলাদেশকে দক্ষিণ এশিয়া ও ভারত মহাসাগরীয় অঞ্চলের গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার মনেকরে বলে ঢাকায় পৌঁছেই এক বিবৃতিতে বলেন শি জিনপিং।

দেশটির কয়েকজন শীর্ষস্থানীয় মন্ত্রীসহ ১৩ সদস্যের উচ্চ পর্যায়ের একটি প্রতিনিধি দলের নেতৃত্ব দিচ্ছেন শি জিনপিং। তাঁর সঙ্গে দেশটির ৮৬ সদস্যের ব্যবসায়ী প্রতিনিধি দল ঢাকা এসেছে।

সফরের প্রথম দিনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে বৈঠক ও চুক্তি স্বাক্ষরের পাশাপাশি রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদের সঙ্গেও দ্বিপক্ষীয় বৈঠক করেন তিনি।

এদিন বিকেলে স্পিকার শিরীন শারমিন চৌধুরী ও বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়াও শি জিনপিংয়ের সঙ্গে তাঁর হোটেল সাক্ষাৎ করেন।

গুরুত্বপূর্ণ ২৭ চুক্তি সই

কর্ণফুলী টানেল নির্মাণ, উপকূলীয় দুর্যোগ ব্যবস্থাপনাসহ অবকাঠামো উন্নয়ন ও সহযোগিতার বিভিন্ন ক্ষেত্রে ২৭টি চুক্তি ও সমঝোতা স্মারকে সই করেছে বাংলাদেশ ও চীন।

চুক্তি ও সমঝোতা স্মারকগুলোর শিরোনাম ও ঋণচুক্তির অর্থের পরিমাণ তাৎক্ষণিকভাবে জানা যায়নি। তবে দুদেশের সরকারের কর্মকর্তাদের তথ্য অনুযায়ী বিভিন্ন খাতে বাংলাদেশকে প্রায় ২৪ বিলিয়ন বা ২ হাজার ৪০০ কোটি ডলারের ঋণ দিচ্ছে চীন, যার বেশিরভাগই অবকাঠামো খাতে।

শুক্রবার বাংলাদেশ-চায়না বিজনেস ফোরামের যৌথ বৈঠকের পর বাংলাদেশি ব্যবসায়ীদের সঙ্গে ১৩ দশমিক ৬ বিলিয়ন অর্থাৎ এক হাজার তিনশ ৬০ কোটি ডলারের চুক্তি সই করেছে চীনের ১৫টি কোম্পানি। বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ ও বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের জ্যেষ্ঠ সচিব হেদায়েত উল্লাহ আল মামুনের উপস্থিতিতে এসব চুক্তি হয় বলে জানান এফবিসিসিআই সভাপতি মাতলুব আহমাদ।

মাতলুব আহমেদ সাংবাদিকদের বলেন, “বাংলাদেশের ১৫টি ও চীনের ১৫টি কোম্পানির মধ্যে ১৯টি চুক্তি সই হয়েছে। চীনের ব্যবসায়ীরা এ দেশে বিনিয়োগ করলে লাভবান হবেন।”

যৌথ বিবৃতি

দুদেশের মধ্যে বিদ্যমান অর্থনৈতিক অংশীদারত্ব ও সহযোগিতার সম্পর্ককে কৌশলগত অংশীদারত্ব ও সহযোগিতায় নিয়ে যেতে সম্মত হয়েছে বাংলাদেশ ও চীন।

প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং এবং বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে দুই দেশের প্রতিনিধি দলের মধ্যে দ্বিপক্ষীয় বৈঠকের পর এক যৌথ বিবৃতিতে এই ঘোষণা দেওয়া হয়। আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক পর্যায়েও এই সহযোগিতা হবে বলে তাতে উল্লেখ করা হয়।

চীনের সঙ্গে সহযোগিতার একটি উচ্চতর ভিত্তি তৈরি হলো জানিয়ে যৌথ বিবৃতিতে শেখ হাসিনা বলেন, “বাণিজ্য ও বিনিয়োগ, অবকাঠামো, শিল্প, বিদ্যুৎ ও জ্বালানি, তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি এবং কৃষির মতো গুরুত্বপূর্ণ খাতগুলোতে সহযোগিতা জোরদারে বাংলাদেশ ও চীন ঐকমত্য পৌঁছেছে।”

চীনের প্রেসিডেন্ট বলেন, “চীন-বাংলাদেশ সম্পর্ক এখন একটি নতুন ঐতিহাসিক সূচনা বিন্দুতে এবং একটি সম্ভাবনাময় ভবিষ্যতের দিকে এগোচ্ছে।”

শি জিনপিং তাঁর বক্তৃতায় বলেন, ঢাকা-বেইজিং সম্পর্ক এখন নতুন ইতিহাসের সন্ধিক্ষণের পথে এবং তা সম্ভাবনাময় ভবিষ্যতের দিকে এগোচ্ছে।

সক্ষমতা বাড়াতে গুরুত্বারোপ

চীনের এ সহযোগিতাকে বাংলাদেশের উন্নয়নের জন্য বিরাট সুযোগ হিসেবে দেখছেন বিশ্লেষকেরা। এ সহযোগিতাকে সঠিকভাবে কাজে লাগাতে পারলে ভবিষ্যতে বিরাট অর্থনীতির দেশ চীন থেকে আরও সহযোগিতার সম্ভাবনাও রয়েছে বলে মনে করেন তাঁরা।

এ প্রসঙ্গে সেন্টার ফর ফরেইন অ্যাফেয়ার্স স্টাডিজের চেয়ারম্যান ও সাবেক রাষ্ট্রদূত আশফাক চৌধুরী বেনারকে বলেন, “চীনের সঙ্গে যে ঋণচুক্তি হলো, তা বাংলাদেশের জন্য একটা সম্ভাবনা। চীনের ৩.৩ ট্রিলিয়ন ডলার রিজার্ভ রয়েছে। এ টাকাগুলো তারা অবশ্যই কাজে লাগবে। বাংলাদেশকে সুযোগটা ছিনিয়ে আনতে হবে। এর জন্য সময়মতো বাস্তবায়ন নিশ্চিত করতে প্রকল্প পরিকল্পনা ও বাস্তবায়ন কার্যক্রমকে ঢেলে সাজানো উচিত।”

বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ইন্টারন্যাশনাল অ্যান্ড স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজের (বিআইআইএসএস) চেয়ারম্যান ও চীনে বাংলাদেশের সাবেক রাষ্ট্রদূত মুন্সি ফয়েজ বেনারকে বলেন, “এখন চীনের পণ্য উৎপাদন খরচ বেড়েছে। বাংলাদেশে শ্রম সস্তা হওয়ায় তারা এ দেশে বিনিয়োগ করতে আগ্রহী হবে। এই সুযোগটা নিতে পারলে দুদেশই লাভবান হতে পারে।”

চীনের প্রেসিডেন্ট মুক্তিযুদ্ধে শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে শনিবার সকালে সাভারে জাতীয় স্মৃতিসৌধে যাবেন। পরে শাহজালাল বিমানবন্দর থেকে তিনি ভারতের গোয়ার উদ্দেশে যাত্রা করবেন।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।