৪৭৭ কোটি টাকা বকেয়া পরিশোধ করতে না পারায় বন্ধ হল সিটিসেল

ঢাকা থেকে জেসমিন পাপড়ি
2016.10.21
161021-City-Cell1000.jpg বকেয়া পরিশোধ ও ক্ষতিপূরণের দাবিতে কার্যালয়ের সামনে মানববন্ধন করেন সিটিসেলের কর্মীরা। আগস্ট ১৭, ২০১৬।
স্টার মেইল

বকেয়া পরিশোধ করতে না পারায় বন্ধ হয়ে গেছে বাংলাদেশের প্রথম মোবাইল ফোন অপারেটর সিটিসেল। ওই প্রতিষ্ঠানটির কাছে সরকারের পাওনা প্রায় ৪৭৭ কোটি টাকা।

আদালতের নির্দেশনার পরেও বিরাট অঙ্কের এ ঋণ পরিশোধ করতে না পারায় বৃহস্পতিবার প্রতিষ্ঠানটি বন্ধ করে দিয়েছে বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ সংস্থা–বিটিআরসি।

টুজি লাইসেন্সের তরঙ্গ বরাদ্দ ও নবায়ন ফি, বার্ষিক তরঙ্গ ফি, সামাজিক সুরক্ষা তহবিল, রাজস্ব ভাগাভাগি, বার্ষিক লাইসেন্স ফি, মূল্য সংযোজন কর (মূসক) ও বিলম্ব ফি বাবদ সিটিসেলের কাছে এই বিরাট পরিমান অর্থ বিটিআরসির পাওনা হয়।

অপারেটরটি বন্ধ হলেও কোনো ক্ষতিপূরণ পাচ্ছেন না সিটিসেলের গ্রাহকরা। এমনকি দীর্ঘদিন ধরে বেতন ভাতা না পাওয়া কর্মকর্তা-কর্মচারিরাও তাদের বকেয়া নিয়ে অন্ধকারে রয়েছেন।

যদিও এর দায় সিটিসেলকেই নিতে হবে বলে সরকারের পক্ষ থেকে শুক্রবার স্পষ্ট জানিয়ে দেওয়া হয়েছে।

ক্রমেই বাড়তে থাকা পাওনার পাহাড় পরিশোধ না করায় গত জুলাই মাসে বিটিআরসি সিটিসেলের কার্যক্রম বন্ধ করার ঘোষণা দিয়েছিল। এ বিষয়ে আগস্ট মাসে তাদের নোটিস দেওয়া হয়।

পরে সিটিসেল বিষয়টি নিয়ে আদালতে গেলে গত ২৯ আগস্ট বিটিআরসির মোট পাওনা (১৭ আগস্ট পর্যন্ত) ৪৭৭ কোটি টাকার দুই তৃতীয়াংশ এক মাসের মধ্যে, বাকিটা পরবর্তী এক মাসে পরিশোধ করার আদেশ দেন আপিল বিভাগ।

সেটিও দিতে ব্যর্থ হওয়ায় বৃহস্পতিবার বিকেলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সহায়তা নিয়ে সিটিসেলের প্রধান কার্যালয়ে ঢুকে এর কার্যক্রম বন্ধ করে বিটিআরসি।

এর ঘণ্টাখানেকের মধ্যেই জরুরি সংবাদ সম্মেলনে টেলিযোগাযোগ প্রতিমন্ত্রী তারানা হালিম জানান, “সরকারের পাওনা পরিশোধ না করায় সিটিসেলের তরঙ্গ বরাদ্দ স্থগিত করা হয়েছে। পাওনা পরিশোধ করলেও সেখান থেকে ফেরার আর কোন সুযোগ নেই।”

বারবার সুযোগ দেওয়ার পরেও সিটিসেল দেনা পরিশোধে ব্যর্থ হয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, “ব্যাংকের কাছেও কোটি কোটি টাকা দেনা তাদের। এমনকি গণমাধ্যমগুলোতেও বিজ্ঞাপনের দেনাও পরিশোধ করেনি এই কোম্পানি।”

এ প্রসঙ্গে বিটিআরসি’র আইনজীবী রেজা-ই রাকিব বেনারকে বলেন, “টেলিযোগাযোগ আইনের ৫৫(৩) ধারার ক্ষমতাবলে সিটিসেলের তরঙ্গ স্থগিত হয়েছে। কর্তৃপক্ষ যে কোনো সময় লাইসেন্সও বাতিলের সিদ্ধান্ত নিতে পারে।”

১৯৮৯ সালে বাংলাদেশ টেলিকম কোম্পানি নামে লাইসেন্স নিয়ে ১৯৯১ সালে নাম বদলে প্যাসিফিক টেলিকম নামে রূপান্তরিত হয়ে সিটিসেল ব্রান্ড নামে বাজারে আসে দেশের প্রথম এই মোবাইল অপারেটর। ১৯৯২ সাল থেকে বাণিজ্যিক কার্যক্রম শুরু করা কোম্পানিটির মালিক সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও বিএনপি নেতা মোরশেদ খান।

উচ্চমূল্যে হ্যান্ডসেট বিক্রি করে ও অস্বাভাবিক কলরেট আদায় করে একটানা কয়েক বছর একচেটিয়া ব্যবসা করে সিটিসেল। বাজারে নতুন অপারেটর আসলে পিছিয়ে পড়তে থাকে তারা। ২০০১ সালে প্রায় ৫০ লাখ গ্রাহক থাকলেও তা সর্বশেষ দেড় লাখে নেমে আসে।

তবে এই গ্রাহকেরাও কোম্পানিটি বন্ধ হওয়ার কোন ক্ষতিপূরণ পাচ্ছে না জানিয়ে বৃহস্পতিবার বিটিআরসি চেয়ারম‌্যান শাহজাহান মাহমুদ সাংবাদিকদের বলেন, “কোম্পানিই না থাকলে ক্ষতিপূরণ কীভাবে আদায় হবে?”

জানা যায়, বৃহস্পতিবারেই সিটিসেলের পক্ষ থেকে ১৩০ কোটি টাকা বিটিআরসিকে পরিশোধ করা হয়। এ প্রসঙ্গে তারানা হালিম বলেন, “প্রথম পর্যায়ে তাদের ৩১৮ কোটি ৪২ লাখ টাকা পরিশোধের কথা ছিল। নতুন বিনিয়োগ আসছে বলে ১১ বার সময় নিয়েও তারা ব্যর্থ হয়। তাদের ওপর আর আস্থা রাখা যায় না।”

তবে বকেয়া আদায়ে আইন অনুযায়ী পরে ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলে জানান প্রতিমন্ত্রী তারানা।

বাংলাদেশে বর্তমানে পাঁচটি মোবাইল ফোন অপারেটের গ্রামীণফোন, বাংলালিংক, রবি, এয়ারটেল ও রাষ্ট্রায়ত্ত টেলিটক সক্রিয় রয়েছে। এসব অপারেটরের মোট গ্রাহক প্রায় ১৩ কোটি।

বকেয়া পরিশোধের দায় কোম্পানির

সিটিসেলে বর্তমানে সাড়ে চারশ স্থায়ী কর্মীসহ মোট ৬৫০ জন কর্মকর্তা-কর্মচারি রয়েছেন। প্রতিষ্ঠানটি বন্ধ হয়ে যাওয়ায় বকেয়া বেতন ও চাকরি হারানোয় ক্ষতিপূরণের দাবি জানিয়ে গত আগস্ট মাস থেকে নানা কর্মসূচি পালন করে আসছেন তারা।

এছাড়া গ্রাহকদের মধ্যেও রয়েছে হতাশা। গ্রাহকদের ভোগান্তি ও ক্ষতি বিবেচনায় না নিয়েই সিটিসেল বন্ধের সিদ্ধান্ত অযৌক্তিক বলে মনে করেন তারা।

সিটিসেলের গ্রাহক প্রায় সাত লক্ষ ১০ হাজার দাবি করে বাংলাদেশ মুঠোফোন গ্রাহক এসোসিয়েশন’র সভাপতি মহিউদ্দিন আহমেদ বেনারকে বলেন, “বিরাট সংখ্যক গ্রাহকদের কোন ধরনের ক্ষতিপূরণের ব্যবস্থা না করেই সিটিসেল বন্ধ করে দেওয়া অযৌক্তিক ও জনবিরোধী।”

তবে এসব দায় কোম্পানির দিকেই ঠেলে দিয়েছে সরকার।

শুক্রবার এক সংবাদ সম্মেলনে প্রতিমন্ত্রী তারানা হালিম বলেন, “এখন কর্মচারীদের বেতন-ভাতা পরিশোধের দায়িত্ব সিটিসেলকেই নিতে হবে।”

তিনি বলেন, “একটি কোম্পানি কোথা থেকে ঋণ নেবে, সেই ঋণ কীভাবে পরিশোধ হবে কিংবা কর্মচারীদের বেতন-ভাতা কীভাবে তারা পরিশোধ করবে- এসবই সেই কোম্পানির দায়িত্ব। বিটিআরসি শুধু নিয়ন্ত্রক মাত্র। নির্ধারিত ভূমিকার বাড়তি কিছু করতে পারবে না।”

প্রত্যেকের দেনা পরিশোধের জন্য সিটিসেলের প্রতি মানবিক আবেদন জানান তিনি।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।