মাদারীপুরে কলেজ শিক্ষককে কুপিয়ে হত্যা করতে গিয়ে জনতার হাতে ধরা পড়ল এক জঙ্গি
2016.06.16
মোটরসাইকেলযোগে একের পর এক পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড ঘটিয়ে পার পেয়ে যাচ্ছিল জঙ্গিরা।রহস্যজনক এসব হত্যাকাণ্ডে দেশজুড়ে মানুষ যখন আতঙ্কিত,ঠিক সেই সময় সাধারণ মানুষ হাতেনাতে আসামি ধরে ফেলার সাহস দেখিয়েছেন।
গত বুধবার মাদারীপুরে কলেজশিক্ষক রিপন চক্রবর্তীকে কুপিয়ে হত্যার চেষ্টা করে পালিয়ে যাওয়ার সময় কলেজ ছাত্র গোলাম ফাইজুল্লাহ ফাহিমকে ধরে ফেলে স্থানীয় জনতা।
এরপর গণপিটুনি দিয়ে তাকে পুলিশে সোপর্দ করা হয়। পুলিশ তাকে নিয়ে বিভিন্ন জায়গায় অভিযান চালাচ্ছে। জঙ্গি ফাহিমের দুই সহযোগীকেও ধরার চেষ্টা করছে পুলিশ।
“একজন জঙ্গিকে সাধারণ মানুষের আটক করার ঘটনা একটা বড় অগ্রগতি। এভাবে সারাদেশের মানুষ যদি এগিয়ে আসে তাহলে কয়েকশ বা কয়েক হাজার জঙ্গি পালানোর পথ খুঁজে পাবে না,” বেনারকে জানান বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি এবং বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রী রাশেদ খান মেনন।
তিনি বলেন, সাধারণ মানুষের শক্তিই বড় শক্তি। এই শক্তিকে কাজে লাগাতে হবে, মানুষের মধ্যে সচেতনতা সৃষ্টি করতে হবে।
স্থানীয় বিভিন্ন সূত্র ও পুলিশ জানায়, ওই শিক্ষককে কুপিয়ে ফেলে রেখে তিনজন ইজিবাইকে চড়ে পালিয়ে যাচ্ছিল। এ সময় স্থানীয় মানুষ মোটরসাইকেল নিয়ে ধাওয়া করে মাদারীপুর জেলা প্রশাসকের বাসভবনের সামনে দুর্বৃত্তদের আটকে ফেলে। এরপর তাকে গণপিটুনি দিয়ে পুলিশের হাতে তুলে দেয় সাধারন জনতা।
গত প্রায় দেড় বছর ধরে একের পর এক বিভিন্ন শ্রেণি, পেশা ও ধর্মের মানুষ নৃশংস হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছেন। দুর্বৃত্তদের কেউই সেভাবে ধরা পড়ছিল না। একমাত্র ঢাকার তেজগাঁও এলাকায় ব্লগারকে হত্যাচেষ্টার সময় তৃতীয় লিঙ্গের কয়েকজন মিলে এক দুর্বৃত্তকে ধরে ফেলে। এরপর একে একে হত্যাকাণ্ড চললেও অধরা থেকে যাচ্ছিল দুর্বৃত্তরা।
গত বুধবার সাধারণ মানুষ দুর্বৃত্তদের আটক করতে নেতৃত্ব দিলেও নিরাপত্তার স্বার্থে তাঁদের নাম প্রকাশ করা হয়নি।
এদিকে আহত শিক্ষক রিপনকে গুরুতর অবস্থায় বরিশাল শের-ই–বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। তাঁর অবস্থা ‘শঙ্কামুক্ত’ বলে স্থানীয় সাংবাদিকদের জানিয়েছেন সেখানকার সহকারী রেজিস্ট্রার শহীদুল ইসলাম।
চিকিৎসকেরা জানিয়েছেন, শিক্ষক রিপনের মাথা, কপাল ও বাম হাতে একটি করে আঘাতের ক্ষত রয়েছে।
রিপন চক্রবর্তীর স্ত্রী মনিমালা রায় টেলিফোনে বেনারকে বলেন, “রিপন ঘটনা সম্পর্কে তাঁদের সঙ্গে কথা বলেছেন। কেন এবং কারা কুপিয়ে তাঁকে জখম করেছে সেব্যাপারে কিছুই বলতে পারেননি। ওই এলাকায় তাঁর শত্রুও ছিল না।”
কে এই ফাহিম?
গোলাম সাইফুল্লাহ ফাহিমের গ্রামের বাড়ি চাঁপাইনবাবগঞ্জ পৌর এলাকার দারিয়াপুরে। বাবা গোলাম ফারুক ঢাকায় পোশাক কারখানায় চাকরি করেন। সে ঢাকার উত্তরা হাই স্কুল এন্ড কলেজে উচ্চমাধ্যমিকের শিক্ষার্থী। গত ১২ জুন ফাহিমের উচ্চমাধ্যমিকে রসায়ন বিষয়ের পরীক্ষা ছিল। পরীক্ষার আগের দিন সে বাড়ি ছাড়ে। এ ব্যাপারে দক্ষিণ থানায় পরিবারের পক্ষ থেকে সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করা হয়েছে।
শিক্ষকদের কাছে ভালো ছাত্র হিসেবে পরিচিতি ছিল গোলাম ফয়জুল্লাহ ফাহিম। একাদশ শ্রেণীতে পড়ার সময় তার আচরণে পরিবর্তন আসতে শুরু করে। একপর্যায়ে সে উগ্র ধর্মীয় আদর্শ গ্রহণ করে।
“পুলিশ আটক ফাইজুল্লাহর কাছ থেকে বেশ কিছু তথ্য পেয়েছে। সেগুলো খতিয়ে দেখা হচ্ছে। তার মাধ্যমে অন্য জঙ্গিদের সম্পর্কে খোঁজখবর নেওয়া হচ্ছে,” বেনারকে জানান মাদারীপুরের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার উত্তম কুমার পাল।
এ ঘটনায় পুলিশের পাশাপাশি বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থা ও র্যাব কাজ করছে। ইত্যোমধ্যেই ফয়জুল্লাহর ঢাকার বাসার সিসি ক্যামেরার ফুটেজ সংগ্রহ করা হয়েছে। ফয়জুল্লার ব্যবহার করা কম্পিউটারটিও জব্দ করেছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী।
মানববন্ধন ও বিক্ষোভ
মাদারীপুর সরকারি নাজিম উদ্দিন কলেজের গণিত বিভাগের প্রভাষক রিপন চক্রবর্তীর ওপর হামলার প্রতিবাদে বৃহস্পতিবার শহরে মানববন্ধন কর্মসূচি পালন করা হয়েছে। কলেজের শিক্ষক, শিক্ষার্থী, পূজা উদ্যাপন পরিষদ ও হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিষ্টান ঐক্য পরিষদের নেতা–কর্মীরা মাদারীপুর-শরীয়তপুর আঞ্চলিক মহাসড়ক ও জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের সামনে এ কর্মসূচি পালন করেন।
মানববন্ধনে জানানো হয়, শিক্ষকের ওপর হামলার ঘটনায় এলাকার হিন্দু সম্প্রদায় ও নাজিম উদ্দিন কলেজের শিক্ষকেরা আতঙ্কিত।
“এভাবে দিনের বেলায় বাড়িতে ঢুকে হামলার ঘটনা আমাদের আতঙ্কিত করেছে,” সমাবেশে জানান বাংলাদেশ পূজা উদ্যাপন পরিষদের মাদারীপুর জেলা আহ্বায়ক প্রাণতোশ মণ্ডল।
তিনি বলেন, হিন্দুদের ওপর একের পর এক জঙ্গি হামলার পরও প্রশাসন নির্বিকার।
এ ছাড়া শিক্ষকের ওপর হামলার প্রতিবাদে সরকারি নাজিম উদ্দিন কলেজে বৃহস্পতিবার সব ক্লাস বন্ধ ছিল। উদ্বিগ্ন শিক্ষকেরা কলেজে জরুরি সভা করে পুলিশ সুপারের কাছে নিরাপত্তা বাড়ানোর পাশাপাশি অপরাধীদের দ্রুত গ্রেপ্তার ও শাস্তি দাবি করেন।
রামকৃষ্ণ মিশনে হুমকি!
এদিকে রাজধানীর রামকৃষ্ণ মিশনে ধর্ম প্রচার নিষেধ করে চিঠির মাধ্যমে হত্যার হুমকি দেওয়া হয়েছে। গত বুধবার সন্ধ্যায় এই চিঠি রামকৃষ্ণ মিশনে আসে। এ ঘটনায় রামকৃষ্ণ মিশন কর্তৃপক্ষ ওয়ারী থানায় সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেছে।এরপর রামকৃষ্ণ মিশনের নিরাপত্তা জোরদার করা হয়েছে।