সপ্তাহব্যাপী পুলিশের প্রশ্নবিদ্ধ সাঁড়াশি অভিযানের সমাপ্তি
2016.06.17
সপ্তাহজুড়ে জঙ্গি বিরোধী বিশেষ অভিযান চালিয়ে পুলিশ কর্মকর্তারা দাবি করেছেন, সামগ্রিক বিচারে অভিযান সফল হয়েছে। আর মানবাধিকার কর্মী ও নিরাপত্তা বিশ্লেষকেরা বলছেন, এ অভিযান সাধারণ মানুষের মধ্যে ভয়–ভীতি তৈরী করলেও জঙ্গি নেটাওয়ার্কে তেমন আঘাত পড়েনি।
পুলিশ বলছে, অভিযানে মোট ১৯৪ জন সন্দেহভাজন জঙ্গি সদস্য গ্রেপ্তার হয়েছে। এর পাশাপাশি বিভিন্ন অভিযোগে গত মঙ্গলবার পর্যন্ত গ্রেপ্তার হয়েছে ১১ হাজার ৩১২ জন। জঙ্গি বিরোধী অভিযানে ঢালাও গ্রেপ্তারের অভিযোগ ওঠায় মঙ্গলবারের পরে আটকের তথ্য প্রকাশ করা থেকে বিরত থাকে পুলিশ।
তবে ধারনা করা হচ্ছে, সাতদিনে ১৫ হাজারের বেশি মানুষকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। পুলিশ অবশ্য গণ গ্রেপ্তারের অভিযোগ অস্বীকার করেছে। পুলিশ বলছে, সাধারণত এক সপ্তাহে ১০ হাজারের মতো মানুষ সারা দেশে গ্রেপ্তার হন। অভিযান চলাকালে গ্রেপ্তার হয়েছেন ১১ হাজার ৩১২ জন।
দেশে একের পর এক সন্ত্রাসী হামলায় বিভিন্ন শ্রেণি, পেশা ও ধর্মের প্রায় অর্ধশত মানুষ নিহত হওয়া এবং চট্টগ্রামে পুলিশ কর্মকর্তা বাবুল আক্তারের স্ত্রী মাহমুদা খানমকে হত্যার পরিপ্রেক্ষিতে গত ৯ জুন পুলিশের মহাপরিদর্শক এ কে এম শহীদুল হক এই অভিযানের ঘোষণা দেন।
তবে অভিযান চলাকালে বিভিন্ন জেলায় আসামি গ্রেপ্তারের নামে কিছু পুলিশের বিরুদ্ধে ‘বাণিজ্য’ করার অভিযোগ উঠেছে। প্রধান বিরোধী দল বিএনপি বলেছে, ঈদের আগে সাঁড়াশি অভিযানের নামে কিছু পুলিশ সদস্যকে ‘গ্রেপ্তার-বাণিজ্য’ করার সুযোগ দেওয়া হয়েছে।
বিশেষ অভিযানের নামে ব্যাপক ধরপাকড়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান অধ্যাপক মিজানুর রহমান, বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতা, মানবাধিকার কর্মীসহ অনেকেই। গত বুধবার স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে গিয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর আসাদুজ্জামান খানের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে মার্কিন রাষ্ট্রদূত মার্শা বার্নিকাট এতো বেশি মানুষ গ্রেপ্তারের কারণ জানতে চান।
“অভিযান শেষে আমরা দেখলাম জঙ্গি ধরার সংখ্যাটি নগণ্য। ধরেই নিলাম যে জঙ্গিরা সংখ্যায় কম। তারপরেও পুলিশ বিষয়টি বিশ্বাসযোগ্যভাবে উপস্থাপন করতে পারছে না,” বেনারকে জানান সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ও মানবাধিকারকর্মী সুলতানা কামাল।
তাঁর মতে, পুলিশের কর্মকর্তাদের কথা শুনে সবাই ধারণা করেছিল যে সাম্প্রতিক হত্যা ও হামলা পরিচালনাকারী জঙ্গিদের ধরার জন্যই এ বিশেষ অভিযান চালানো হচ্ছে। এখন দেখার বিষয় পুলিশ এরকম কতজনকে গ্রেপ্তার করতে পেরেছে।
আট সংগঠনের ১৯৪ জঙ্গি গ্রেপ্তার
পুলিশের হিসেব অনুযায়ী, বিশেষ এই অভিযানে গ্রেপ্তার হওয়া ১৯৪ জন সন্দেহভাজন জঙ্গি আটটি সংগঠনের নেতা–কর্মী। এ ছাড়া অভিযান চলাকালে কথিত বন্দুকযুদ্ধে জঙ্গি সন্দেহে পাঁচজন নিহত হয়েছে।
পুলিশ সদর দপ্তরের জনসংযোগ কর্মকর্তা এ কে এম কামরুল আহছান সাংবাদিকদের জানান, গ্রেপ্তারকৃতদের মধ্যে জামাআতুল মুজাহিদীন বাংলাদেশের (জেএমবি) ১৫১ জন, জাগ্রত মুসলিম জনতা বাংলাদেশে ৭ জন, হিযবুত তাহরিরের ২১ জন, আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের (এবিটি)৬ জন, আনসার আল ইসলামের ৩ জন, আল্লাহর দলের ৪ জন, হরকাতুল জিহাদের ১ জন ও আফগানিস্তান থেকে ফেরত একটি জঙ্গি সংগঠনের ১ জন সদস্য রয়েছে।
এদিকে জঙ্গি বিরোধী অভিযানে জঙ্গি সন্দেহে ১৩ জনকে গ্রেপ্তার করেছে ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি)। মামলার এজাহারের বক্তব্য অনুযায়ী, ১৩ আসামির মধ্যে ৮ জন হিযবুত তাহরীরের সদস্য। গত সাত দিনে ঢাকা মহানগর পুলিশ বিভিন্ন মামলায় ১ হাজার ৩৫ জনকে গ্রেপ্তার করে ঢাকার মুখ্য মহানগর হাকিম আদালতে পাঠায় পুলিশ।
অভিযান সম্পর্কে পুলিশের মহাপরিদর্শক এ কে এম শহীদুল হক গতকাল বিবিসিকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে বলেন, “অভিযানে জঙ্গিদের ওপর আঘাত পড়ছে। তারা চাপে আছে। কোনো ঘটনা ঘটানোর জন্য তাদের পরিকল্পনার জায়গাটা আমরা দুর্বল করে দিয়েছি।”
হাজার হাজার মানুষকে আটক করে অভিযানের মাধ্যমে পরিকল্পিত হত্যা বন্ধ করা সম্ভব কিনা জানাতে চাইলে শহীদুল হক বলেন, “বন্ধ করা সম্ভব কিনা এই মুহুর্তে বলতে পারব না। তবে এটা কমানো সম্ভব।”
“জঙ্গিবাদ নির্মূল হোক এটা আমরা সবাই চাই। কিন্তু ১৯৪ জনকে ধরতে গিয়ে যে ১১ হাজারের বেশি মানুষকে গ্রেপ্তার করা হলো তাদের সবাই আসামি বা অপরাধী কিনা, সেটা বড় প্রশ্ন,” বেনারকে জানান জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান ড. মিজানুর রহমান। ড. মিজান ঢাকা কেন্দ্রিয় কারাগার পরিদর্শন করে গত বুধবার ধারণক্ষমতার তিনগুণের বেশি আসামি জেলে থাকায় ক্ষোভ প্রকাশ করেন।
ঐক্য চাইলেন মওদুদ
দেশে সাম্প্রতিক হত্যাকাণ্ড ও জঙ্গিবাদ উত্থানের পেছনে আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্র আছে বলে মনে করেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য মওদুদ আহমদ। তবে তিনি বলেছেন, জঙ্গি দমনে সরকারের সততার অভাব আছে।জঙ্গিবাদ ও উগ্রবাদ দমনে জাতীয় ঐক্য গড়ে তোলার কথা বলেন তিনি।
গতকাল শুক্রবার দুপুরে জাতীয় প্রেসক্লাবে আলোচনা সভায় মওদুদ আহমদ বলেন, “দেশে জঙ্গিবাদের উত্থানে আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্র কাজ করছে। এটা অবিশ্বাস করার উপায় নেই। র্যাব, পুলিশ দিয়ে এই জঙ্গি ও সন্ত্রাসবাদ মোকাবিলা করা যাবে না”।
গুপ্তহত্যায় জড়িতদের মুখে ঐক্যের কথা: হানিফ
জঙ্গিবাদ প্রতিরোধে বিএনপি নেতা মওদুদ আহমদের জাতীয় ঐক্যের আহ্বানের জবাবে আওয়ামী লীগের মাহবুব-উল আলম হানিফ বলেছেন, যারা ‘গুপ্তহত্যায় জড়িত’ তারাই এখন বলছে ঐক্যের কথা। শুক্রবার জাতীয় প্রেস ক্লাবে বাংলাদেশ ইউনাইটেড ইসলামী পার্টির ইফতার পূর্ব আলাচনায় এ কথা বলেন হানিফ।
তিনি বলেন, “যারা ঐক্যের কথা বলছেন, তারাই তো এসব গুপ্তহত্যার সঙ্গে জড়িত। গুপ্তহত্যা কারা করছে সবাই তা জানে।
“জাতীয় ঐক্য আমরাও চাই। কিন্তু কাদের সঙ্গে? কী ঐক্য করব?” বলেন হানিফ।