অভিজিৎ হত্যার প্রধান আসামি ক্রসফায়ারে নিহত,বিচারবহির্ভূত হত্যা বিতর্ক
2016.06.20
পুলিশের পুরস্কার ঘোষিত ছয় জঙ্গির একজন শরীফুল গত শনিবার পুলিশের সঙ্গে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ নিহত হওয়ার ঘটনায় দেশজুড়ে নানা বিতর্ক শুরু হয়েছে। এই আসামিকে হত্যা করা ঠিক হয়েছে, না বাঁচিয়ে রাখা উচিত ছিল-এ নিয়ে পুলিশের সঙ্গে মানবাধিকার কর্মী ও রাজনীতিকদের মতবিরোধ প্রকাশ্য রূপ নিয়েছে।
তবে গত বছরের ফেব্রুয়ারিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র-শিক্ষক কেন্দ্রে অভিজিৎ রায়কে যেখানে হত্যা করা হয়, সেখানকার ভিডিও ফুটেজে শরীফুলের উপস্থিতি দেখা গেছে।
পুলিশ বলছে, অভিজিৎ রায়কে হত্যাকাণ্ডে এই শরীফুলই নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। সে সাকিব ওরফে শরীফ ওরফে সালেহ ওরফে আরিফ ওরফে হাদি নামে পরিচিত। তবে পরিচয় পত্র অনুসারে তার নাম জানা যায় মুকুল রানা।
নিহত শরীফুলের দুলাভাই হেদায়েতুল ইসলাম বেনারকে জানান, “মুকুল কোনো দলের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছিলেন কি না ও ঢাকায় তিনি কী করতেন, তা তাঁরা জানেন না। বন্দুকযুদ্ধে নিহত শরীফুলের লাশ টেলিভিশনে দেখার পর তারা লাশ নিতে সাতক্ষীরা থেকে ঢাকায় এসেছেন"।
মুখোমুখি গুরুত্বপূর্ণ দুই ব্যক্তি
ক্রসফায়ারে হত্যার ঘটনা নিয়ে নানামুখী আলোচনার মধ্যে প্রকাশ্য বিতর্কে জড়িয়ে পড়েছেন জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান এবং পুলিশ প্রধান।
অধ্যাপক মিজানুর রহমান সাংবাদিকদের বলেন, “সরকারকে বিপদে ফেলার জন্য গ্রেপ্তার হওয়া জঙ্গিদের সরিয়ে দেওয়া হচ্ছে। এর ফলে তাদের কাছ থেকে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পাওয়ার যে সুযোগ ছিল তা চিরতরে রুদ্ধ হয়ে গেল।”
মিজানুর রহমানের এই বক্তব্যের প্রতিবাদ করেছেন পুলিশের মহাপরিদর্শক এ কে এম শহীদুল হক। চট্টগ্রামে সাংবাদিকদের তিনি বলেছেন, উনি না বুঝেই এমন মন্তব্য করেছেন।
শহীদুল হক বলেছেন, মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যানকে জিজ্ঞেস করলেই হুট করে কথা বলে দেন। উনি তথ্য না নিয়ে, না বুঝে, না শুনেই মন্তব্য করেন।
ঘটনা
পুলিশ বলছে, গত শনিবার রাত পৌনে তিনটার দিকে গোয়েন্দা বিভাগের (ডিবি) একটি দল মেরাদিয়া এলাকায় তল্লাশি অভিযান চালায়। এ সময় তারা সন্দেহজনকভাবে তিন মোটরসাইকেল আরোহীকে ধাওয়া করে। এ সময় হঠাৎ মোটরসাইকেল আরোহীরা পুলিশকে লক্ষ্য করে গুলি ছোড়ে। আত্মরক্ষার্থে পুলিশও পাল্টা গুলি চালায়।
গোলাগুলির একপর্যায়ে আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের সদস্য শরিফ গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান। এই ঘটনায় খিলগাঁও থানায় একটি হত্যা মামলা ও অস্ত্র মামলা দায়ের হয়েছে।
“প্রথমে পুলিশ নিহত যুবককে চিনতে পারেনি। পরে দেখা যায়, তার সঙ্গে পুরস্কার ঘোষিত জঙ্গি শরীফুলের মিল রয়েছে,” জানান ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) গোয়েন্দা বিভাগের (ডিবি) উপকমিশনার (দক্ষিণ) মাশরুকুর রহমান খালেদ।
গত ১৯ মে লেখক অভিজিৎ রায়, প্রকাশক ফয়সল আরেফিনসহ (দীপন) অন্তত ১০টি হত্যায় জড়িত সন্দেহে ছয়জনকে ধরিয়ে দিতে তাদের নাম ও ছবি গণমাধ্যমে প্রকাশ করে ডিএমপি। শরীফুলকে ধরিয়ে দেওয়ার জন্য পুলিশ পাঁচ লাখ টাকা পুরস্কার ঘোষণা করেছিল।
অভিজিতের বাবার প্রতিক্রিয়া
“শরীফুলকে নিয়ে আমার কোনো সন্দেহ নেই। গত এক বছর ধরে তদন্তের বিভিন্ন পর্যায়ে ও গণমাধ্যমের প্রতিবেদনে তার নাম শুনছি। তবে হয়তো শরীফুল বেঁচে থাকলে হত্যাকাণ্ডের পরিকল্পনাকারী কারা, সে সম্পর্কে আরও বিস্তারিত জানা যেত,” বেনারকে জানান অভিজিৎ রায়ের বাবা ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক অজয় রায়।
“এভাবে মৃত্যু না ঘটিয়ে বিচার সম্পন্ন করলে এবং তাদের কাছ থেকে যেসব স্বীকারোক্তি ও তথ্য এসেছিল সেগুলোর ওপর ভিত্তি করে সুষ্ঠু বিচার করতে পারলে তাতে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা পেত, বিচার বিভাগের প্রতি মানুষের আস্থা বাড়ত,” বেনারকে জানান সাবেক আইনমন্ত্রী শফিক আহমেদ।
এ প্রসঙ্গে পুলিশের বক্তব্য হচ্ছে, এসব জঙ্গি ধরে বাস্তবে খুব বেশি তথ্য মিলছে না। তাদের কারাগারে পাঠানো হলে পরে জামিনে বেরিয়ে আবার নাশকতায় যুক্ত হয়।
ক্রসফায়ারের রাজনীতি
ক্রসফায়ারের নামে বিচারবহির্ভূত হত্যা শুরু হয় ২০০৪ সালে। গত এক যুগের ইতিহাসে দেখা যায়, বিভিন্ন সময়ে সরকারগুলো ‘ক্রসফায়ার’ বা ‘বন্দুকযুদ্ধে’ বিভিন্ন সংকটের সমাধান খুঁজেছে।
বিএনপির নেতৃত্বাধীন তৎকালীন চারদলীয় জোট সরকারের শেষ তিন বছরে কথিত ক্রসফায়ারে ৭৪৬ জন সন্দেহভাজন অপরাধী নিহত হয়।
তখন বিএনপির নেতা-মন্ত্রীরা এর পক্ষে আর আওয়ামী লীগের নেতারা এর বিপক্ষে কথা বলতেন। এখন পরিস্থিতি উল্টে গেছে।
বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের বিচার বিভাগীয় তদন্ত দাবি করেছেন বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। গত রোববার নয়াপল্টনে দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলনে তিনি এই দাবি জানান।
মির্জা ফখরুল বলেন, “আমরা এই ধরনের বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের বিরোধিতা বরাবরই করে এসেছি, এখনো করছি এবং এ ধরনের হত্যাকাণ্ডগুলোর বিচার বিভাগীয় তদন্ত চাইছি। অবিলম্বে তা বন্ধ হওয়া উচিত।”
এদিকে ২০০৮ সালে নির্বাচনী ইশতেহারে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড বন্ধের কথা বলে ক্ষমতায় আসে আওয়ামী লীগ সরকার। কিন্তু ‘ক্রসফায়ার’, ‘বন্দুকযুদ্ধ’ তো বন্ধ হয়ইনি, সঙ্গে যোগ হয় ‘গুম-গুপ্তহত্যা।
আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে মহাজোট সরকার ২০০৯ সালে ক্ষমতায় আসার পর প্রথম চার বছরে একইভাবে ‘ক্রসফায়ারে’ ৩৩৮ জন সন্দেহভাজন নিহত হয়। ২০১৩ সালে কথিত বন্দুকযুদ্ধে মাত্র ৪৩ জন নিহত হয়।
২০১৪ সালে ১২৮ ও ২০১৫ সালে ১৪৬ জন কথিত বন্দুকযুদ্ধে নিহত হয়। আর চলতি বছরের ১৯ জুন পর্যন্ত ৫৯ জন নিহত হয়।
এসব বন্দুকযুদ্ধের ঘটনায় পুলিশের পক্ষ থেকে প্রায় একই রকম কথা বলা হয়ে থাকে।
এ ব্যাপারে মানবাধিকার কর্মী সুলতানা কামাল বেনারকে বলেন, “রাষ্ট্র নিজ হাতে আইন তুলে নিচ্ছে।এর ফলে রাষ্ট্র নিজেই যে বিচার ব্যবস্থার ওপর আস্থাহীন, সেই বার্তাটি মানুষের কাছে যাচ্ছে। এর ফলে মানুষও বিচার ব্যবস্থার ওপর আস্থা হারাচ্ছে, যা ভালো লক্ষণ নয়”।