পাকিস্তানে ছাপা ভারতীয় জাল রুপি বাংলাদেশ হয়ে ভারতে যাচ্ছে
2016.06.13
পাকিস্তানের করাচি থেকে মধ্যপ্রাচ্যের শারজাহ হয়ে এয়ার এরাবিয়ার একটি উড়োজাহাজে গত শুক্রবার সকাল নয়টার দিকে ঢাকায় হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে নামে ফেনীর বাসিন্দা আবুল বাশার(৪০)। মধ্যপ্রাচ্য ফেরত অন্যান্য শ্রমিকদের মতোই খুব সাদামাটা বেশ-ভূষা তার। একটি মাত্র লাগেজ ছিল তার সঙ্গে । সন্দেহের কারণই নেই। কিন্তু ঢাকার শুল্ক গোয়েন্দাদের কাছে খবর ছিল আবুল বাশার জাল ভারতীয় মুদ্রা পাচার করছেন।
সে অনুযায়ী বিমানবন্দরের টার্মিনালের ভেতরেই তাকে আটক করেন শুল্ক কর্মকর্তারা। কিন্তু বাশার কোনো কিছুই স্বীকার করছেন না। অগত্যা কর্মকর্তারা তার লাগেজ খুলে বের করলেন একটি তোশক, বালিশ ও কিছু কাচের বাসন-কোসন। কিন্তু মুদ্রা নেই।
এরপর তোশক নেড়ে-চেড়ে মনে হলো ভেতরে কাগজের কিছু রয়েছে। চাকু দিয়ে তোশক কাটতেই বেরিয়ে এল থরে থরে সাজানো ভারতীয় রুপির বান্ডিল। তোশকের সঙ্গে থাকা বালিশের মধ্যেও লুকিয়ে রাখা হয়েছিল রুপি। তোশক-বালিশ থেকে মোট এক কোটি ৩০ লাখ রুপি বের হয়।
শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মইনুল খান বেনারকে বলেন, “বাশারের লাগেজ থেকে উদ্ধার করা এক কোটি ৩০ লাখ রুপির মধ্যে একই নম্বরের এক হাজার ও ৫০০ রুপির একাধিক নোট রয়েছে। এ ছাড়া এগুলো যে জাল তা বোঝার কোনো উপায়ই নেই।”
শুল্ক গোয়েন্দা কর্মকর্তারা জানান, আটকের পর জিজ্ঞাসাবাদে বাশার জানান বিমানবন্দরের পার্কিংয়ে একজনের কাছে এই রুপির লাগেজটি পৌঁছানোর কথা ছিল। সে অনুযায়ী কর্মকর্তারা একটি গাড়িসহ পার্কিং এলাকা থেকে আব্দুস সোবহান নামে আরেকজনকে আটক করে। এখন দুজনকেই জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে।
কর্মকর্তারা বলছেন, পাকিস্তান থেকে ছেপে আসা জাল ভারতীয় রুপি (ফেইক ইন্ডিয়ান কারেন্সি নোট বা এফআইসিএন) বাংলাদেশের ওপর দিয়ে ভারতে যাচ্ছে অনেকদিন ধরেই। এই মুদ্রা পাচারকারী চক্রগুলোর হোতারা একাধিকবার ধরা পড়েও ছাড়া পেয়ে গেছেন। গ্রেপ্তার এসব ব্যক্তি বিভিন্ন সময় বাংলাদেশে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে বলেছেন, সেদেশের একটি সামরিক গোয়েন্দা সংস্থার তত্ত্বাবধানে এসব মুদ্রা ছাপা ও বিপণন করা হয়।
ঢাকা মহানগর পুলিশের নবগঠিত কাউন্টার টেররিজম ও ট্রান্স ন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিটের অতিরিক্ত কমিশনার মনিরুল ইসলাম বেনারকে বলেন, “বিভিন্ন সময় গ্রেপ্তার হওয়া আসামিদের জিজ্ঞাসাবাদ করে জানা যায় পাকিস্তানে একটি গোয়েন্দা সংস্থার তত্ত্বাবধানে তৈরি হয় মুদ্রাগুলো। এরপর এগুলো বাংলাদেশের ওপর দিয়ে ভারতে পাচারের জন্য বাংলাদেশি, ভারতীয় ও পাকিস্তানিদের নিয়োগ করা হয়। যারা ধরা পড়ছে তারা কেবল বাহকমাত্র।” তিনি বলেন, জাল মুদ্রা নিয়ে সংশ্লিষ্ট দেশের গোয়েন্দারা তৎপর রয়েছেন। গোয়েন্দাদের মধ্যে আন্তযোগাযোগ ও অবাধ তথ্য বিনিময় হচ্ছে। সবাই এটা ঠেকানোর চেষ্টা করে যাচ্ছে।
“প্রতিবেশী দেশ ভারতের অন্যতম উদ্বেগ হলো পাকিস্তান থেকে ভারতীয় জাল মুদ্রা পাচার। গত ২০১৪ ও ২০১৫ সালে ১৭ কোটি ভারতীয় মুদ্রা উদ্ধার হয়েছে। এসব মুদ্রা পাকিস্তানে তৈরি হয়। খালি চোখে বোঝার উপায় নেই এগুলো জাল,” জানান শুল্ক গোয়েন্দা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মইনুল খান। তিনি বলেন, এমনকি মুদ্রা শনাক্তের উন্নতমানের যন্ত্রও এগুলোকে জাল বলে শনাক্ত করতে পারে না। স্টেট ব্যাংক অব ইন্ডিয়ার স্থানীয় শাখাও এগুলোকে জাল বলতে পারে না।
এক প্রশ্নের জবাবে মইনুল খান জানান, “কাস্টমস গোয়েন্দারা নোটগুলো ইনভেন্ট্রি করার সময় দেখতে পান একই নম্বরের একাধিক বান্ডিল। প্রতিটি নোটের ইউনিক নম্বর থাকার কথা। কিন্তু একই নম্বরের একাধিক বান্ডিল নোট দেখে সেগুলোকে জাল হিসেবে শনাক্ত করা হয়।”
জাল ভারতীয় রুপি পাচারের সঙ্গে জড়িত বাংলাদেশি, পাকিস্তানি ও ভারতীয় একাধিক নাগরিক বিভিন্ন সময় গ্রেপ্তার হয়েছে। জিজ্ঞাসাবাদে পাওয়া তথ্যের ভিত্তিতে ডিবি ও র্যাবের কর্মকর্তা জানিয়েছেন, মুদ্রা পাচারে লাভের অর্থ পাকিস্তান ও ভারতে জঙ্গিবাদ সম্প্রসারণে ব্যবহার হচ্ছে। বাংলাদেশের জঙ্গিদের সঙ্গেও এই চক্রের সদস্যদের যোগসাজশ ছিল। এদের কেউ কেউ মুদ্রার সঙ্গে অস্ত্রেরও ব্যবসা করে থাকেন।
বাংলাদেশের গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর তথ্যমতে, বাংলাদেশে পাকিস্তান ভিত্তিক জাল মুদ্রা পাচার চক্রের অন্যতম তিন প্রধান হলেন; সোলায়মান মজুমদার, মো. মাহাতাব ও ইমরান হোসেন। এদের নিচে কিছু ছোট ছোট চক্র কাজ করছে। কখনো কখনো একেবারে আনকোরাদের হাতেও জাল রুপির প্যাকেট তুলে দেওয়া হয়।
পাকিস্তানের রাষ্ট্রীয় গোয়েন্দা সংস্থার তত্ত্বাবধানে তৈরি এ রুপির প্যাকেট ঢাকা থেকে বিভিন্ন চক্রের মাধ্যমে সীমানা পেরিয়ে ভারতে চলে যায়। বাংলাদেশে জাল রুপি আসার পরে এক লাখ জাল রুপির বান্ডিল বিক্রি হয় ২৫ হাজার রুপিতে। পরের হাতে দাম হয়ে যায় ৩০ হাজার। তারপরের ধাপে বিক্রি হয় ৩৫ হাজার রুপি।
পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদে বিভিন্ন সময় গ্রেপ্তার হওয়া এ চক্রের বাংলাদেশি ও পাকিস্তানি নাগরিকেরা জানিয়েছেন, এসব জাল রুপি করাচিতে ছাপানো হয়। আকাশপথে বিশেষ লাগেজে, পাকিস্তান থেকে আসা কাপড়ের চালানে বা জলপথে জাহাজে এসব রুপির চালান বাংলাদেশে আসার তথ্য রয়েছে। কর্মকর্তাদের চোখ ফাঁকি দিতে দুবাই বা আবুধাবি হয়ে ঘোরা পথেও মুদ্রা আনা হয়।
ডিবি সূত্র জানায়, মুদ্রা বহনকারীদের বিশেষভাবে মুদ্রাগুলো মোড়কে বেঁধে দেওয়া হতো। পাকিস্তানের বিমানবন্দরে বিশেষ নির্দেশনায় এসব মুদ্রার চালান কখনোই আটকানো হয় না। উড়োজাহাজের প্রতি চালানে দেড় থেকে আড়াই কোটি রুপি আসে।
শুল্ক গোয়েন্দা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মইনুল খান বলেন, “শুক্রবার গ্রেপ্তার হওয়া বাশার মাত্র পাঁচদিন আগে পাকিস্তানে গিয়েছিলেন শুধু মুদ্রা আনার জন্য। তখন থেকেই বাশারের গতিবিধির ওপর নজর রাখা হচ্ছিল।”