গুলশানে জঙ্গি হামলায় নিহত ও আটক দুজনকে ঘিরে নানা প্রশ্ন
2016.07.05
স্মরণকালের নিষ্ঠুর ও নৃশংস হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় বেশ কিছু প্রশ্নের জবাব এখনও মেলেনি। হামলার পাঁচদিন পরও হামলাকারীর সংখ্যা, এর পেছনে জড়িত কারা, কতজন আটক হয়েছে এবং মৃত জঙ্গিদের নাম–পরিচয়সহ বেশকিছু সহজ বিষয়ে বিভ্রান্তি কাটছে না।
গত শুক্রবার হলি আর্টিজান বেকারিতে বন্দুকধারীরা হামলা চালিয়ে ১৭ বিদেশি, দুই বাংলাদেশি, একজন বাংলাদেশ ও যুক্তরাষ্ট্রের দ্বৈত নাগরিক এবং দুজন পুলিশ কর্মকর্তাকে হত্যা করে।
শুক্রবার রাতভর শান্তিপূর্ণ সমাধানের চেষ্টা চালিয়ে ব্যর্থ হলে শনিবার সকালে সেনাবাহিনীর নেতৃত্বে পরিচালিত কমান্ডো অভিযান চালিয়ে জিম্মি সঙ্কটের অবসান ঘটানো হয়। শনিবার দুপুরে আইএসপিআর-এর পক্ষ থেকে সংবাদ সম্মেলনের করে আনুষ্ঠানিকভাবে জানানো হয়, হামলাকারী ছয় সন্ত্রাসী নিহত হয়েছে এবং একজন সন্দেহভাজন ধরা পড়েছে।
কিন্তু বেনার নিউজের অনুসন্ধানে দেখা গেছে, নিহত ছয়জনের মধ্যে একজন জঙ্গি ছিলেন না। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পক্ষ থেকে ছয় জঙ্গি নিহত হওয়ার কথা বলা হলেও পরবর্তিতে দেখা যায়, নিহতদের একজন ওই রেস্তোরাঁরই রাঁধুনী সাইফুল ইসলাম।
পুলিশের সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্র এবং রেস্তোরাঁর মালিকপক্ষ এ বিষয়টি নিশ্চিত করলেও অজ্ঞাত কারনে বিষয়টি আনুষ্ঠানিকভাবে প্রকাশ করছে না।
সাইফুলকে বাদ দিলে ছয়জনের বদলে পাঁচ জঙ্গি মারা যাওয়ার তথ্য পাওয়া যায়। এর মধ্যে সরকারের পক্ষ থেকে পরিচয় জানানো হয়েছে দুই জঙ্গির। এরা হচ্ছে শফিকুল ইসলাম উজ্জ্বল এবং মো. খায়েরুজ্জামান ওরফে পায়েল। উজ্জ্বলের বাড়ি বগুড়ার ধুনট উপজেলার কৈয়াগাড়ী গ্রামে। অপরজনের বাড়ি একই জেলার শাহজাহানপুর উপজেলায়।
উজ্জল ছয় মাস আগে তাবলিগের চিল্লায় যাওয়ার নাম করে বাড়ি ছাড়ে। এরপর তাকে আর খুঁজে পায়নি পরিবার।
হামলাকারী জঙ্গিদের ছবি নিয়েও ধুম্রজাল চলেছে। অভিযান শেষে আইএসপিআর ছয়জন হামলাকারী মারা গেছে বলে উল্লেখ করলেও পুলিশ পাঁচটি লাশের ছবি গণমাধ্যমে পাঠায়।
অন্যদিকে হামলার দায় স্বীকার করে আইএসের নামে প্রকাশিত বার্তায় যে পাঁচজনের ছবি আসে ইন্টারনেটে, তার সঙ্গে পুলিশের সরবরাহ করা একটি ছবির মিল ছিল না।
আইএসের প্রকাশিত পাঁচজনের তালিকায় থাকা ওই ছবিটি রোহান ইবনে ইমতিয়াজের,যার বাবা ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের একজন কেন্দ্রীয় নেতা। এ ছাড়া পুলিশের তালিকার একটি ছবিকে সাইফুল ইসলাম হিসাবে চিহ্নিত করে তাঁর পরিবার, যিনি হলি আর্টিজানের একজন কর্মী ছিলেন।
তবে শেষ পর্যন্ত আইএস যে পাঁচ হামলাকারীর ছবি প্রকাশ করে সেটিই টিকে থাকছে।
সম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশে বিভিন্ন হামলার পর দায়িত্ব স্বীকার করে আইএসের নামে বার্তা এলেও দেশে আইএসের অস্তিত্ব অস্বীকার করে আসছিল সরকার। এবারের গুলশান হামলায় ছবি প্রকাশসহ আইএসের নামে প্রকাশিত বিভিন্ন তথ্য মিলে যাওয়ায় সরকারের সংশ্লিষ্টরা আগের মতো গলা উঁচু করে এ বিষয়ে বক্তব্য দিচ্ছেন না।
আটক জঙ্গি প্রসঙ্গ
আইএসপিআর একজন ধরা পড়ার কথা বললেও পরে পুলিশ এই সংখ্যা দুই বলে জানায়। কিন্তু কেউই আটক হওয়া ব্যক্তিদের পরিচয় প্রকাশ করেনি।
তবে জানা গেছে, জাকির হোসেন শাওন (২২) নামে একজন হাতকড়া পরা অবস্থায় ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি রয়েছেন, যাকে জঙ্গিরা হামলা চালানোর কয়েক ঘণ্টার মাথায় ওই এলাকা থেকে রক্তাক্ত অবস্থায় পুলিশ আটক করেছিল।
হলি আর্টিজানে বাবুর্চির সহকারী হিসেবে কাজ করা এই তরুণকে সোমবার পরিবার শনাক্ত করে এবং পুলিশের বিরুদ্ধে তাকে নির্যাতনের অভিযোগ করে।
গোয়েন্দা পুলিশের এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বেনারকে জানান, ওই বেকারি থেকে এই ১৩ জনকে উদ্ধার করা হয়েছিল। এদের মধ্যে তাহমিদ (২২) ও হাসানাত কারিম পুলিশ হেফাজতে আছে।
এদিকে আটক জঙ্গীর বিষয়ে জানতে চাইলে মঙ্গলবারের সংবাদ সম্মেলনেও নির্দিষ্ট করে কোনো তথ্য দেননি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। বরং আরো তদন্তের ফল আসা পর্যন্ত অপেক্ষা করতে বলেন সাংবাদিকদের।
উল্লেখ্য গত মঙ্গলবার গুলশান হামলার ঘটনায় নিহত পাঁচ জঙ্গিসহ অজ্ঞাতনামা কয়েকজনকে আসামি করে মামলা করে পুলিশ।
“মামলা হওয়ার পর আমরা তদন্তের দায়িত্ব পেয়েছি। এ নিয়ে কাজ চলছে। সবকিছু পরিষ্কার হতে কিছুদিন সময় লাগবে,” বেনারকে জানান মামলার তদন্তের দায়িত্বে থাকা পুলিশের কাউন্টার টেরোরিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিটের প্রধান মনিরুল ইসলাম।
প্রতিবেশী দেশের সহায়তা নেওয়া হবে
জঙ্গি দমনে এবার ‘প্রতিবেশী ও বন্ধুপ্রতীম দেশের’ সহযোগিতা নেবেন বলে জানিয়েছেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন কামাল।
গুলশানে জঙ্গি হামলার চারদিন পর মঙ্গলবার বিকেলে সচিবালয়ে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে এসব কথা বলেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী।
এক্ষেত্রে বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক সহযোগিতাকে স্বাগত জানাবে বলে জানান সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী মো. শাহরিয়ার আলম।
এ ধরনের সহযোগিতাকে ইতিবাচক ও সময়োপযোগী বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা।
কূটনীতিকদের আশ্বস্ত করেছে সরকার
সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদ দমনের অভিন্ন চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় বাংলাদেশকে সমর্থন করবে বলে আশা প্রকাশ করেছেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ এইচ মাহমুদ আলী।
গুলশানে জঙ্গি হামলার প্রেক্ষাপটে মঙ্গলবার সকালে রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন পদ্মায় কূটনীতিকদের ব্রিফিং করার সময় পররাষ্ট্রমন্ত্রী এসব কথা জানান। একইসঙ্গে দেশের নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিয়ে কূটনীতিকদের আশ্বস্ত করেন তিনি।