পশ্চিম বঙ্গে বিনিয়োগের আশায় লন্ডন সফরে যাচ্ছেন মমতা

কলকাতা থেকে মাসুমা পরভীন
2015.07.24
Ind-mamata কলকাতার এক জনসভায় বক্তব্য রাখছেন পশ্চিম বঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। ২১ জুলাই,২০১৫
এএফপি

বাকিংহাম প্যালেসে ইতিহাস রচনা করবেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। কিন্তু, রাজ্যে চাকরির মুখ চেয়ে বসে থাকা লক্ষ লক্ষ ছেলেমেয়ে সেই ঐতিহাসিক মুহূর্তে কোনও আশ্বাস পাবে কি?

কেন ঐতিহাসিক?  কারণ, ভারতের রাজ্যগুলির মুখ্যমন্ত্রীদের মধ্যে মমতাই প্রথম, যাঁকে বাকিংহাম প্যালেসে আনুষ্ঠানিক ভাবে আমন্ত্রণ জানানো হচ্ছে। আগামী ২৭ জুলাই তাঁর সম্মানে আয়োজিত সান্ধ্য চায়ের আসরে তাঁকে অভ্যর্থনা জানাবেন রানির দ্বিতীয় পুত্র, ডিউক অব ইয়র্ক প্রিন্স অ্যান্ড্রিউ। পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে এক ঘণ্টা একান্ত বৈঠকও করবেন তিনি।

চার দিনের সফরে ২৬ জুলাই লন্ডন যাবেন মমতা । তাঁর সফরসঙ্গীর সংখ্যা ৬৬। অর্থমন্ত্রী অমিত মিত্র ছাড়াও সেই তালিকায় আছেন সঞ্জীব গোয়েঙ্কা, হর্ষ নেওটিয়া, ওয়াই সি দেবেশ্বর, আদি গোদরেজ, ওয়াই কে মোদীর মতো বিশিষ্ট শিল্পপতিরা। আছেন কলকাতার মেয়র শোভন চট্টোপাধ্যায়, তৃণমূল কংগ্রেস সাংসদ ডেরেক ও’ব্রায়েন এবং সুগত বসু। থাকছেন কলকাতার পুলিশ কমিশনার সুরজিৎ কর পুরকায়স্থ সহ বেশ কিছু আমলাও।

মহাকরণ সূত্রে জানা গিয়েছে, ২০১৩ সালে ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী ডেভিড ক্যামেরন যখন কলকাতা সফরে এসেছিলেন, তখনই তিনি পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রীকে লন্ডন সফরের আমন্ত্রণ জানান। তার পর ইউ কে ইন্ডিয়া বিজনেস কাউন্সিলের প্রধান প্যাট্রিসিয়া হেউইটও মমতাকে একই আমন্ত্রণ জানান। তৃতীয় বার আমন্ত্রণ জানান ব্রিটেনের মিনিস্টার অব স্টেট ফর দ্য ফরেন অ্যান্ড কমনওয়েলথ অফিস, হুগো সুইয়ার। ব্রিটেনের আমন্ত্রণ রক্ষাতেই মুখ্যমন্ত্রীর লন্ডন সফর।

তবে, যাঁদের আমন্ত্রণে তিনি সফরে যাচ্ছেন, তাঁদের কারও সঙ্গেই তাঁর দেখা হবে কি না, সে বিষয়ে সংশয় তৈরি হয়েছে। সংবাদসূত্রে প্রকাশ, ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী ডেভিড ক্যামেরন ২৭ তারিখ থেকে ছুটিতে চলে যাচ্ছেন। থাকছেন না ব্রিটেনের ফরেন সেক্রেটারি ফিলিপ হ্যামন্ড ও বিজনেস সেক্রেটারি সাজিদ জাভিদ। এমনকী, মমতাকে শেষ আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন যিনি, সেই হুগো সুইয়ারও সম্ভবত পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করতে পারবেন না। তবে, ব্রিটেনের ভারতীয় বংশোদ্ভূত মন্ত্রী প্রীতি প্যাটেল সময় দেবেন মুখ্যমন্ত্রীকে। ব্রিটেনের পার্লামেন্টে শুক্রবার থেকেই গ্রীষ্মাবকাশ আরম্ভ হচ্ছে। মন্ত্রী এবং এমপি-দের বেশির ভাগই এই সময় লন্ডনে থাকেন না।

প্রশ্ন উঠেছে, মুখ্যমন্ত্রীর সফরসূচি স্থির করার আগে কেন এই দিকগুলি খতিয়ে দেখা হয়নি?  রাজ্য প্রশাসনের সদর দফতর নবান্নের এক পদস্থ আমলা জানালেন, সত্যিই ত্রুটি থেকে গিয়েছে। কিন্তু কেন, বিস্তারিত ভাবে বলতে নারাজ তিনি। বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলি কটাক্ষ করে বলছে,  সফরসঙ্গীর তালিকা স্থির করতেই যদি সব সময় চলে যায়, তা হলে আর এই দিকগুলো নিয়ে মুখ্যমন্ত্রী মাথা ঘামাবেন কখন? বিজেপি-র বিধায়ক শমীক ভট্টাচার্য বললেন,  ‘লন্ডন সফরে কলকাতার পুলিশ কমিশনার কী করবেন?  যাঁরা পশ্চিমবঙ্গে বিনিয়োগ করতে আগ্রহী হবেন না, তাঁদের গ্রেফতার করবেন নাকি তিনি?’

তিনি মুখ্যমন্ত্রী হলে কলকাতাকে লন্ডন করে তুলবেন বলে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। মুখ্যমন্ত্রিত্বের চার বছর পার করে সেই লন্ডনে কেন যাচ্ছেন তিনি?  তাঁর ঘনিষ্ঠ সূত্র বলছে, এক দিকে তিনি লন্ডনের নগর পরিকল্পনা খুঁটিয়ে দেখতে চান। বিশেষত, টেমস-এর তীরবর্তী অঞ্চলে কী ভাবে উন্নয়ন হচ্ছে, তা জানতে আগ্রহী তিনি। অন্য দিকে, লন্ডনের বিনিয়োগকারীদের সামনে পশ্চিমবঙ্গকে তুলে ধরতে চান। এই রাজ্যে তাঁদের বিনিয়োগ টেনে আনতে চান। তা ছাড়াও, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, তথ্যপ্রযুক্তি ও পেট্রোকেমিক্যাল শিল্প বিষয়েও আলোচনা হতে পারে বলে জানা গিয়েছে।

তাতে লাভ হবে কি কিছু?  প্রশ্ন উঠছে, সুদূর লন্ডনে গিয়ে পশ্চিমবঙ্গে বিনিয়োগের পক্ষে ঠিক কী বলতে পারেন মুখ্যমন্ত্রী?  সিঙ্গুরে টাটা মোটরস-এর কারখানা গড়তে না দেওয়ার অতীত থেকে তিনি কি বেরোতে পেরেছেন?

শিল্পপতি রতন টাটা নিজের হতাশা প্রকাশ করে জানিয়েছিলেন, ‘‘আমি বলেছিলাম, আমার মাথায় বন্দুক ধরলেও আমি সিঙ্গুর ছেড়ে যাব না। কিন্তু দিদি (মমতা যে নামে বেশি পরিচিত) যে ট্রিগার টিপে দিলেন।’’ তাঁর আমলেই পশ্চিমবঙ্গ ছেড়ে চলে গিয়েছে আরও একটি বড় প্রকল্প-- শালবনিতে জিন্দল গোষ্ঠীর ইস্পাত কারখানা। গত চার বছরে এই রাজ্যে বিনিয়োগ করতে সম্মত হননি বড় মাপের কোনও শিল্পপতি। এই অবস্থায় লন্ডনের শিল্পপতিদের কাছে বলার মতো কী-ই বা আছে তাঁর?

২৭ বছরের সৈয়দ জাহিরের গলায় হতাশা স্পষ্ট। বিএ পাশ করে চাকরির চেষ্টায় রয়েছেন কলকাতার এই তরুণ। জানালেন, ‘‘এই রাজ্যে সরকারি চাকরি ছাড়া উপায়ান্তর নেই। বিনিয়োগই যদি না আসে, বেসরকারি চাকরি তৈরি হবে কী ভাবে?’’

‘‘বিনিয়োগের জন্য যে পরিবেশ দরকার, পশ্চিমবঙ্গে তার অভাব রয়েছে। জমি নিয়ে মুখ্যমন্ত্রীর অবস্থান শিল্পপতিদের কাছে ইতিবাচক বার্তা দেয়নি, ’’ বললেন দিল্লির অর্থনৈতিক গবেষণাকেন্দ্র টেরি-র গবেষক শাশ্বত চৌধুরী।

সম্প্রতি নিজের শততম প্রশাসনিক মিটিং উপলক্ষে মমতা বলেছেন,  ‘‘যাঁরা শিল্প গড়তে চান, তাঁরা নিজেরা ভালবেসে, আদর করে জমি কিনে নিন।’’  অর্থাৎ, তাঁর সরকার শিল্প গড়ার জমি জোগাড় করে দেবে না। মুখ্যমন্ত্রীর বক্তব্যের দু’দিন পরেই রাজ্যের মুখ্যসচিব সঞ্জয় মিত্র শিল্পপতিদের বললেন,  ‘‘আপনাদের ইচ্ছুক জমিদাতাকেই খুঁজে বের করতে হবে। কাউকে জোর করতে পারব না। তাতে যদি শিল্প না আসে, না-আসবে।’’

রাজ্যের এক অতি বৃহৎ বিনিয়োগের অধিকর্তা মুখ্যমন্ত্রীর লন্ডন সফরের প্রেক্ষিতে এই জমির প্রসঙ্গটি টেনে আনলেন। বললেন,  ‘‘পশ্চিমবঙ্গে শিল্প গড়তে চাইলে যে বিপুল সরকারি বাধার সম্মুখীন হতে হয়, সে কথা এখন গোটা দুনিয়ার শিল্পমহল জানে। কাজেই, তাঁর এই সফরে কতটা বিনিয়োগ আসবে, বিস্তর সন্দেহ আছে।’’  রাজ্য সরকারের বেশ কয়েক জন আমলার মনেও একই সংশয়। কিন্তু, কেউই স্বনামে সেই কথা বলতে রাজি নন, পাছে মুখ্যমন্ত্রীর রোষে পড়তে হয়।

কোনও আশাই কি নেই?  ততখানি হতাশ হতে রাজি নন শাশ্বত চৌধুরী। বললেন, ‘‘ঘুরে দাঁড়াতে তো হবেই। মুখ্যমন্ত্রী যদি এখনও শিল্পায়নের বিষয়ে আন্তরিক হন, লন্ডন সফর থেকেই হয়তো পশ্চিমবঙ্গের পুনর্জন্ম হতে পারে।’’

জুলাইয়ের শেষ সপ্তাহের দিকে তাকিয়ে রয়েছে পশ্চিমবঙ্গ।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।