ভারতে সহিষ্ণুতার প্রয়োজন তীব্র, বললেন অমর্ত্য সেন

কলকাতা থেকে মাসুমা পরভীন
2016.01.20
Ind-amarta কলকাতার প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয় নোবেলজয়ী প্রাক্তনী অমর্ত্য সেনকে ডি লিট ডিগ্রিতে ভূষিত করল।
অনলাইন

হায়দরাবাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে দলিত ছাত্রের আত্মহত্যার ঘটনায় গোটা দেশে কেন্দ্রীয় সরকারের দলিতবিরোধী অবস্থান এবং হিন্দুত্ববাদী অসহিষ্ণু রাজনীতির বিরুদ্ধে সমালোচনার ঝড় উঠেছে। সেই প্রেক্ষিতে গণতন্ত্রে সহিষ্ণুতার প্রয়োজনীয়তা বিষয়ে অমর্ত্য সেনের মন্তব্যটি তাৎপর্যপূর্ণ।

এই মুহূর্তে ভারতে সহিষ্ণুতার অত্যন্ত প্রয়োজন।

কথাটা নতুন নয়। কেউ এমন কথা বলছেন না, তা-ও নয়। তবুও, বক্তার নাম যদি হয় অমর্ত্য সেন, তবে এই বহুচর্চিত কথাটিই নতুন মাত্রা পেয়ে যায়।

কলকাতার প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয় তার খ্যাতনামা অর্থনীতিবিদ ও নোবেলজয়ী প্রাক্তনীকে বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ সম্মান সাম্মানিক ডি লিট ডিগ্রিতে ভূষিত করল। সেই অনুষ্ঠানের মঞ্চ থেকেই ভারতের অসহিষ্ণু পরিবেশ নিয়ে বার্তা দিলেন অমর্ত্য সেন।

তিনি বললেন, যে কোনও মতকেই খোলা মনে গ্রহণ করতে শিখতে হবে। এই গ্রহণের নামই সহিষ্ণুতা। তবে, কোনও মত গ্রহণ করা মানেই যে তাকে মেনে নেওয়া, তেমনটা নয়। যে কোনও মতকেই প্রশ্ন করতে হবে। এটাই গণতন্ত্রের প্রক্রিয়া।

প্রসঙ্গত, দিনকয়েক আগে প্রায় এই কথাটিই বলেছিলেন বিশ্বের অন্যতম প্রাচীন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটির সদ্যনিযুক্ত প্রথম মহিলা ভাইস চ্যান্সেলর লুই রিচার্ডসন। তাঁর বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের তিনি বলেন, যে কথার সঙ্গে তোমরা সম্পূর্ণ ভিন্নমত, সেই কথাটিকেও সম্পূর্ণ মর্যাদার সঙ্গে শোনার অভ্যাস উচ্চশিক্ষার অপরিহার্য অঙ্গ।

ভারতীয় গণতন্ত্র কি বিপন্ন? সেই প্রশ্নের উত্তরে অমর্ত্য সেন বললেন, এখন গণতন্ত্রের কিছু বিপদ আছে। আমাদের বুঝতে হবে, গণতন্ত্র মানে শুধু সংখ্যাগরিষ্ঠের আধিপত্য নয়। সংখ্যালঘুর অধিকারের নিশ্চয়তা দেওয়াও গণতন্ত্রের আবশ্যিক অঙ্গ। যে কোনও মূল্যে মানুষের বাকস্বাধীনতা রক্ষা করাও গণতন্ত্রে কর্তব্য।

অমর্ত্য সেনের কথাগুলি এই মুহূর্তে ভারতে আরও বেশি তাৎপর্যপূর্ণ, তার কারণ, হায়দরাবাদ বিশ্ববিদ্যালয়ে রোহিত ভেমুলা আত্মঘাতী হয়েছেন। গোটা ভারত এখন এই আত্মহত্যা নিয়ে উত্তাল। রোহিত এই বিশ্ববিদ্যালয়েরই ছাত্র ছিলেন। জাতিগত পরিচয়ে তিনি দলিত।

গত বছর আগস্ট মাসে তিনি বিজেপির ছাত্র সংগঠন অখিল ভারতীয় বিদ্যার্থী পরিষদের এক নেতার সঙ্গে সংঘাতে জড়িয়ে পড়েন। সেই জল গড়ায় বহু দূর। রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘের ঘনিষ্ঠ কেন্দ্রীয় মন্ত্রী বন্দারু দত্তাত্রেয় রোহিত ও তাঁর আরও চার দলিত সহপাঠীর বিরুদ্ধে কেন্দ্রীয় মানবসম্পদ উন্নয়নমন্ত্রী স্মৃতি ইরানির কাছে অভিযোগ জানান। স্মৃতির দফতর বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের ওপর লাগাতার চাপ সৃষ্টি করে। শেষ পর্যন্ত বহিষ্কৃত হন এই পাঁচ দলিত ছাত্র। তারই জেরে আত্মঘাতী হলেন রোহিত।

স্বভাবতই প্রশ্ন উঠেছে, রোহিতদের দলিত পরিচয়ই কি তাঁদের বিজেপি-র সহজ শত্রু করে তুলল? সমাজতত্ত্ববিদ অমৃতা গুপ্ত বললেন, কথাটা অস্বীকার করার কোনও উপায় নেই। বিজেপি যে হিন্দুত্বে বিশ্বাস করে, তা মূলত বর্ণহিন্দুর হিন্দুত্ব, অর্থাৎ শুধু উচ্চবর্ণের লোকরাই সেখানে হিন্দুর স্বীকৃতি পান। দলিতদের দলে টানার একটা চেষ্টা হয় বটে, কিন্তু সেটা মূলত লোক দেখানো। আমার ধারণা, দলিতের বদলে কোনও মুসলমান ছাত্রের সঙ্গে এই সংঘাত হলেও তার একই পরিণতি হত। কিন্তু কোনও বর্ণহিন্দুর সঙ্গে এই বিরোধ তৈরি হলে তার মীমাংসা হত অনেক সহজ পথে।

কেমব্রিজ ইউনিভার্সিটি প্রেসের সহকারী সম্পাদক অভিষেক সেনগুপ্ত বললেন, দেশ জুড়ে যে অসহিষ্ণুতার পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে, এই মর্মান্তিক ঘটনা তারই পরিণতি। কোনও দলিত ছাত্র যে কোনও বর্ণহিন্দুর বিরোধিতা করতে পারে, এটা মেনে নেওয়ার মতো মানসিক উদারতাই সঙ্ঘ পরিবার বা বিজেপির সমর্থকদের নেই।

তিনি আরো বলেন,  তারা এই বিরোধের ফয়সলা করতে চেয়েছিল রোহিতদের একেবারে দুরমুশ করে দিয়ে। তাদের বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিষ্কার করাও এই প্রক্রিয়ারই অঙ্গ। এবং, ভেবে অবাক লাগছে, দেশে এমনই অবস্থা যে রাজনৈতিক চাপ প্রতিরোধ করার ক্ষমতা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যেরও নেই। তাঁরাও এই অসহিষ্ণুতাকেই প্রশ্রয় দিচ্ছেন।

এই ঘটনার কথা মনে রেখেই কি অমর্ত্য সহিষ্ণুতার বার্তা দিলেন? সেই প্রশ্নের উত্তরে অমর্ত্য বললেন, হায়দরাবাদের ঘটনা নিয়ে তিনি সরাসরি কোনও মন্তব্য করবেন না। কিন্তু, তাঁর চিন্তাধারার সঙ্গে পরিচিতরা বলছেন, অমর্ত্যর ইঙ্গিত হায়দরাবাদের দিকেই। দিল্লির অর্থনৈতিক গবেষণা সংস্থা টেরি-র অর্থনীতিবিদ শাশ্বত চৌধুরী বললেন, অমর্ত্য অর্থনীতির বিবেক হিসেবে খ্যাত। গণতন্ত্রে তাঁর বিশ্বাস অটল। ফলে, অনুমান করা চলে, রোহিত ভেমুলার মৃত্যুকে তিনি ভারতীয় গণতন্ত্রের ওপর অসহিষ্ণুতার আঘাত হিসেবেই দেখছেন।

প্রসঙ্গত উল্লেখ করা চলে, নরেন্দ্র মোদীর নেতৃত্বাধীন কেন্দ্রীয় সরকারের সঙ্গে অমর্ত্য সেনের সম্পর্ক কখনও হৃদ্য হয়নি। গত লোকসভা নির্বাচনের আগে অমর্ত্য জানিয়েছিলেন, তিনি মোদীকে ভারতের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দেখতে চান না। মোদীর উন্নয়নের মডেলেরও তীব্র সমালোচক অধ্যাপক সেন। আবার, ইন্ডিয়ান কাউন্সিল ফর স্যোসাল সায়েন্স রিসার্চ ২০১৩ সাল থেকে অমর্ত্য সেনের নামে যে পুরস্কারটি চালু করেছিল, তা নিয়ে সম্প্রতি কেন্দ্রীয় সরকার প্রশ্ন তুলল। হয়তো পুরস্কারটি তুলে দেওয়া হবে।

সহিষ্ণুতার প্রয়োজন এবং গণতন্ত্রে সংখ্যালঘুর অধিকারের বিষয়ে বার্তা দিয়ে অমর্ত্য কি জানালেন, সরকারের সঙ্গে সংঘাতের পথে হাঁটতে তাঁর আপত্তি নেই? গণতন্ত্রের সুস্বাস্থ্য কামনায় যা বলা প্রয়োজন, যা করা প্রয়োজন, তা তিনি নির্দ্বিধায় বলবেন এবং করবেন?

অর্থনীতির বিবেক হিসেবে যিনি পরিচিত, তাঁর কাছে বুঝি এই অবস্থানই প্রত্যাশা করা যায়।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।