পশ্চিম বঙ্গে রমজান ও ঈদ, হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে বন্ধন গড়ে তুলছে

কলকাতা থেকে মাসুমা পরভীন
2015.07.21
Ind-eid কলকাতার নাখোদা মসজিদে ঈদের নামাজ। ১৮ জুলাই,২০১৫
এএফপি

‘ঈদ মুবারক।’
সম্পূর্ণ অচেনা এক জনের শুভেচ্ছায় থমকে দাঁড়ালেন মধ্য পঞ্চাশের এক মুসলমান প্রৌঢ়। কলকাতার লেকটাউন যশোহর রোডের মোড়ে, শনিবার সকাল সাড়ে দশটায়। সদ্য শেষ হয়েছে ঈদের নামাজ। কোলাকুলির পর বাড়ির রাস্তা ধরেছিলেন তিনি। তখনই তাঁর দিকে উড়ে এল অপ্রত্যাশিত শুভেচ্ছাবার্তা।

যিনি শুভেচ্ছা জানালেন, তিনি নিজের পরিচয় দিলেন। বছর ত্রিশের হিন্দু যুবক। তাঁর গন্তব্য কাছের সিনেমা হল। সলমন খানের নতুন সিনেমা ‘বজরঙ্গি ভাইজান’ দেখতে যাচ্ছেন তিনি। বললেন, মসজিদ ফেরত প্রৌঢ়কে দেখে তাঁর ইচ্ছে হল ঈদের খুশি ভাগ করে নিতে। কোলাকুলির পর যে যার নিজের পথে হাঁটা দিলেন।

ব্যতিক্রমী?  হয়তো তা-ই। তবু, কলকাতা বদলাচ্ছে।

মোমিনপুরের বাসিন্দা শেখ ইরশাদ বললেন, ‘বড়দিনে যেমন ভিড় জমে সেন্ট পলস ক্যাথিড্রালে, ছাপোষা মধ্যবিত্ত হিন্দুরাও যেমন সপরিবারে উপস্থিত হন গির্জায়, ঈদ এখনও ততখানি সর্বজনীন হয়নি, ঠিকই। তবুও, কয়েক বছর আগেও ঈদ যতখানি শুধু মুসলমানদের উৎসব ছিল, এখন আর ততটা নয়। ঈদের সকালে চিৎপুরের নাখোদা মসজিদের সামনে ভিন্ন ধর্মাবলম্বীদের দেখা পাওয়া এখন আর ব্যতিক্রমী ঘটনা নয়। একটু দূরে দাঁড়িয়ে হলেও রেড রোডের নামাজ দেখেন অনেকেই।’

সমাজতত্ত্বের গবেষক, বর্তমানে একটি এনজিও-র সঙ্গে যুক্ত সমাজকর্মী সোহিনী সেন বললেন, ‘ঈদের মতো উৎসবে অন্য ধর্মের মানুষরা কম যোগ দেন, তার একটা বড় কারণ অপরিচয়ের ব্যবধান। বড়দিনের সঙ্গে হিন্দু বাঙালির পরিচয় ঔপনিবেশিক শাসনের সূত্রে। কিন্তু, ঈদ বা শব-এ-বারাতের মতো উৎসবের সঙ্গে সেই পরিচয় হয়নি। তবে, আস্তে আস্তে পরিস্থিতি বদলাচ্ছে।’

বদলের একটা পথ অবশ্যই খাবার টেবিল হয়ে যায়। রমজান মাস জুড়ে কলকাতার সব মোগলাই খাবারের দোকানের সামনে দাঁড় করানো মস্ত হাঁড়ি। হালিম বিক্রি হচ্ছে। দুপুরবেলাতেই অজস্র ক্রেতার ভিড়। বেশির ভাগ মুসলমান যখন রোজায়, তখন এত  কিনছেন কারা?  তেমন কোনও রেস্তোরাঁর সামনে খানিক ক্ষণ দাঁড়ালেই বোঝা যায়, হালিম খেতে ভিন্ন ধর্মের মানুষদের আগ্রহের বিন্দুমাত্র অভাব নেই।

আগ্রহ বাড়ছে সেমাই, লাচ্ছা নিয়েও।
কলকাতার জাকারিয়া স্ট্রিট অঞ্চলে হাজি আলাউদ্দিনের মিষ্টির দোকানে ঈদের সময় তিলধারণের ঠাঁই থাকে না। দ্রুত হাতে খদ্দেরদের চাহিদা মেটাতে মেটাতেই দোকানের এক কর্মচারী জানালেন, অন্য ধর্মের মানুষরাও আসছেন ঈদের বিশেষ মিষ্টির খোঁজে।

এ ভাবেই হয়তো উৎসব সর্বজনীন হয়। কলেজছাত্রী ঈপ্সিতা বন্দ্যোপাধ্যায় জানালেন, ইফতার কাকে বলে, সেহরি-ই বা কী, তাঁর কোনও ধারণা ছিল না কয়েক বছর আগেও। এখন জানেন। জাকাত কাকে বলে, জানেন তা-ও।

কলকাতার বাইরেও ছবিটা বদলাচ্ছে। উত্তর চব্বিশ পরগনার মতো জেলায়, যেখানে জনসংখ্যার প্রায় ২৫ শতাংশ মুসলমান, সেখানকার ছবিটা কী রকম? সন্দেশখালি অঞ্চলের বাসিন্দা, পেশায় ইমারতি দ্রব্যের ব্যবসায়ী আবু নাসের লস্কর জানালেন, এখন বিভিন্ন পাড়ায় ঈদ উপলক্ষে প্যান্ডেল বাঁধা হচ্ছে। দুর্গাপূজায় যেমন হয়। সকালের নামাজ শেষ হওয়ার পর সবাই জমায়েত হচ্ছেন সেই প্যান্ডেলে। যোগ দিচ্ছেন অন্যান্য সম্প্রদায়ের কিছু মানুষও। গানবাজনা হচ্ছে। কোথাও সন্ধ্যার দিকে জলসার ব্যবস্থাও হচ্ছে।

উৎসবকে সর্বজনীন করে তোলার ক্ষেত্রে বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানগুলির ভূমিকাও কম নয়। পশ্চিমবঙ্গে চির কাল দুর্গাপূজা ও দীপাবলি উপলক্ষে কেনাকাটার ওপর বিশেষ ছাড়ের ব্যবস্থা হয়ে এসেছে। সেই ছাড়ে অবশ্য সব ধর্মের মানুষই যোগ দিয়ে থাকেন। এই বার দেখা গেল, ঈদ উপলক্ষে ছাড় ঘোষণা করেছে বহু সংস্থা। কলকাতার জনপ্রিয় গহনা বিক্রেতা অঞ্জলি জুয়েলার্স ছাড় তো দিচ্ছেই, তার সঙ্গে প্রত্যেক ক্রেতার হাতে ধরিয়ে দিচ্ছে এক প্যাকেট লাচ্ছা।

রাজনীতিকদের মধ্যে ইফতার পার্টির চল ছিলই। সেই ধারা অব্যাহত। পশ্চিমবঙ্গের প্রায় সমস্ত প্রধান রাজনৈতিক দলের নেতা-নেত্রীরাই রমজান চলাকালীন ইফতার পার্টির আয়োজন করেছেন। তার মধ্যে অবশ্য রাজনীতির গন্ধ বেশ প্রকট। এই বছর দেখা গেল, রাজ্যের কয়েকটি কলেজের ছাত্র ইউনিয়নও ইফতার পার্টির আয়োজন করেছে। এবং, তাতে যোগ দিয়েছেন ধর্মনির্বিশেষে বহু ছাত্রছাত্রীই।

ফেসবুক-হোয়াটস্যাপেও পরিবর্তনের ঢেউ। ঈদের শুভেচ্ছাবার্তার ঢল নেমেছে ভিন্ন ধর্মাবলম্বীদের ওয়ালেও। ঘটনাক্রমে, ঈদের দিনেই ছিল রথযাত্রা। ওয়াল থেকে ওয়ালে শেয়ার হয়েছে একটি ছবি, যাতে লেখা, ‘রথ টানা ও চাঁদ দেখার শুভেচ্ছা।’

হয়তো আরও কয়েক বছর বাদে পথচলতি অচেনা মানুষের শুভেচ্ছায় আর অবাক হবেন না মসদজিদ ফেরত কেউ। তিনি জানবেন, এমনটাই স্বাভাবিক।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।