ভারতে চাকরির আকাল, ৩০ আসনে আবেদন ৭৫ হাজার
2015.09.01

স্থির ছিল, ৩০ আগস্ট রাজ্যের বিভিন্ন কেন্দ্রে পরীক্ষাটি নেওয়া হবে। সেই অনুযায়ী আবেদনপত্রও চাওয়া হয়েছিল। কিন্তু, মাত্র ৩০টি আসনের জন্য ৭৫,০০০ আবেদনপত্র জমা পড়ল। আবেদনের এই বিপুল সংখ্যা এতটাই অপ্রত্যাশিত ছিল যে পরীক্ষা বাতিল করতে বাধ্য হল ছত্তীসগঢ় সরকারের ডাইরেক্টরেট অব ইকনমিকস অ্যান্ড স্ট্যাটিস্টিকস।
এতটুকু পড়েই যদি বিস্মিত হন, তা হলে আরও বড় বিস্ময় আপনার অপেক্ষায় রয়েছে। যে পদের জন্য আবেদনপত্র চাওয়া হয়েছিল, সেটা বেয়ারা-র চাকরি। এক টেবিল থেকে অন্য টেবিলে ফাইল পৌঁছে দেওয়া, মাঝেমধ্যে চা এনে দেওয়াই যাদের কাজ। সরকারি বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছিল, ক্লাস ফাইভ পাশ হলেই আবেদন করা যাবে। কিন্তু দেখা গেল, বহু ইঞ্জিনিয়ারও আবেদন পাঠিয়েছেন। পাঠিয়েছেন বিজ্ঞান ও কলা বিভাগের স্নাতকোত্তর স্তর পাশ করা ছেলেমেয়েরাও। ডাইরেক্টরেটের প্রধান অমিতাভ পান্ডা বললেন, ‘এটা প্রায় অবাস্তব একটা পরিস্থিতি। আমরা ভেবেছিলাম, বড় জোর দু’-তিন হাজার আবেদনপত্র জমা পড়বে।’
ঘটনাটি চমকে দেওয়ার মতোই। ভারতে শিক্ষিত যুবসমাজের সামনে চাকরির সুযোগ কতখানি কম, এই ঘটনা তা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়। তবে, সমাজতত্ত্ববিদ অনন্যা চট্টোপাধ্যায় মনে করিয়ে দিলেন, ছত্তীসগঢ়ের ঘটনাটিই একমাত্র নয়। গুজরাটে প্যাটেলদের যে আন্দোলন এখন চরমে উঠেছে, তার কেন্দ্রেও কিন্তু রয়েছে শিক্ষিত যুবসমাজের চাকরি না পাওয়ার ক্ষোভ। সেখানে হার্দিক প্যাটেল নামে মাত্র ২১ বছর বয়সী এক যুবকের নেতৃত্বে প্যাটেলরা এই আন্দোলনে নেমেছেন। তার দাবি, সরকারি চাকরিতে প্যাটেলদের জন্যও সংরক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে।
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, আর্থিক দিক থেকে প্যাটেলরা ভারতের অন্যতম অগ্রসর জনগোষ্ঠী। অনন্যা মনে করিয়ে দিলেন, পশ্চিমবঙ্গেও সম্প্রতি প্রাথমিক স্কুল শিক্ষকের ৫০,০০০ শূন্য পদে প্রায় ২৫ লক্ষ ছেলেমেয়ে আবেদন করেছিলেন।
বেকারের হার কম, কিন্তু চাকরির জন্য হাহাকার কেনো?
সার্বিক ভাবে দেখলে, ভারতে কর্মসংস্থানের ছবিটি মন্দ নয়। এখন দেশে বেকারত্বের হার ৪.৯ শতাংশ। গত কয়েক বছরে হারটি অনেকাংশেই কমেছে। ছত্তীসগঢ়ের ছবিটি আরও ভাল। ২০১৩ সালে প্রকাশিত কেন্দ্রীয় শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রকের রিপোর্ট অনুযায়ী, ছত্তীসগঢ়েই বেকারত্বের হার সবচেয়ে কম। সেখানে ১৫ থেকে ২৯ বছর বয়সীদের মধ্যে প্রতি ১০০০ জনে মাত্র ১৪ জন কর্মহীন। গুজরাটের মতো রাজ্যে সংখ্যাটি ২৭, পাঞ্জাব-হরিয়ানায় ৪৮। (তথ্যসূত্র: http://timesofindia.indiatimes.com/city/raipur/Chhattisgarh-has-lowest-rate-of-unemployment/articleshow/22834883.cms)
তা হলে কেন বেয়ারার চাকরির জন্য ৭৫,০০০ আবেদনপত্র জমা পড়ে?
দিল্লির অর্থনৈতিক গবেষণা সংস্থা টেরি-র অর্থনীতিবিদ শাশ্বত চৌধুরী বললেন, ‘সমস্যাটির দুটো দিক রয়েছে। এক, সত্যিই চাকরির অভাব রয়েছে। প্রতি বছর যত ছেলেমেয়ে লেখাপড়া শেষ করছে, সেই অনুপাতে নতুন চাকরি তৈরি হচ্ছে কম। ফলে, প্রতি বছর বেকার ছেলেমেয়ের সংখ্যা বাড়ছে। হতাশাও বাড়ছে। সেই হতাশা থেকেই ইঞ্জিনিয়ারিং পাশ করা ছেলেমেয়েরাও বেয়ারা-র চাকরি চাইছেন।
‘দ্বিতীয় দিক হল, সরকারি চাকরির প্রতি মানুষের আকর্ষণ এখনও প্রবল। সেই চাকরির নিরাপত্তা, কম খাটুনিতে নিশ্চিত মাইনে ইত্যাদির আকর্ষণে অনেক ছেলেমেয়েই যে কোনও প্রকারে একটা সরকারি চাকরি জোগাড় করতে চায়। পশ্চিমবঙ্গে প্রাথমিক শিক্ষক পদে চাকরিতে যে প্রতি বার এত শিক্ষিত ছেলেমেয়ে আবেদন করে, তার কারণ এটাই।’
ছবিটা হতাশাব্যাঞ্জক, কিন্তু এটা কি বলা চলে যে ভারতীয় অর্থনীতিতে যথেষ্ট চাকরি তৈরি হচ্ছে না? বিশেষজ্ঞরা মানতে নারাজ।
তরুনরা দক্ষতা অর্জনের সুযোগ পাচ্ছে না
ভারতের ন্যাশনাল স্কিল ডেভেলপমেন্ট কর্পোরেশনের এক কর্ণধার ত্রিদিবেশ বন্দ্যোপাধ্যায় বললেন, সরকারি চাকরি প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল ঠিকই, তবে বেসরকারি ক্ষেত্রে যথেষ্ট নতুন চাকরি তৈরি হচ্ছে।
তিনি বলেন, ‘কর্মক্ষেত্রে শ্রমনির্ভর বা হাতে-কলমে কাজের চাহিদা বাড়ছে, একেই আমরা ব্লু-কলার কাজ বলি। আজ দেশের অধিকাংশ শিল্প শ্রমনির্ভর কর্মীর অভাবে থমকে দাঁড়িয়ে। কিন্তু লক্ষণীয় যে, কর্মীদের ট্রেনিং-এর ব্যাপারে সংস্থাগুলির তীব্র অনীহা, কারণ ট্রেনিং-এ এক জন আনকোরা তরুণকে নিজের খরচে দক্ষ করে ফেলার পর অন্য কেউ তাঁকে অনেক বেশি মাইনে দিয়ে নিয়ে চলে যায়— দক্ষ শ্রমিকের এতই অভাব। ফলে এই তরুণ সমাজকে দক্ষ করে তোলার পুরো দায়ভার গিয়ে পড়ছে সরকারের উপর।’
তাঁর মতে, এখনও ভারতের তরুণ প্রজন্মের মধ্যে এই গুণগুলোর অভাব রয়েছে। ফলে, যে চাকরিতে এমন কোনও চাহিদা নেই, তারা সেই সরকারি চাকরির মুখ চেয়েই থাকে।
এই সত্যটি অস্বীকার করতে পারছেন না তরুণ প্রজন্মও। যশোবন্তী চক্রবর্তী কলকাতার একটি বেসরকারি ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ থেকে এ বছর বিই পাশ করেছেন। তিনি বললেন, ‘খুব নামকরা প্রতিষ্ঠান ছাড়া কোথাও তেমন ক্যাম্পাস প্লেসমেন্ট হয় না। আসলে আমাদের কলেজগুলোতে মাস্টারমশাইরা সেই বই ধরে পড়িয়ে যান। ইন্ডাস্ট্রিতে কী হচ্ছে, সে বিষয়ে আমাদের কোনও ধারণাই তৈরি হয় না। তাই আমাদের চাকরিও হয় না।’
যেখানে শিল্পায়ন নেই সেখানেই সরকারি চাকরির প্রত্যাশা
অর্থনীতির অধ্যাপক সীমন্তী বন্দ্যোপাধ্যায় বললেন, ‘যে রাজ্যে শিল্পায়ন যত কম, সে রাজ্যে সরকারি চাকরির জন্য হাহাকার তত বেশি। যেমন পশ্চিমবঙ্গ ও ছত্তীসগঢ়। নতুন শিল্প তৈরি না হলে যেমন নতুন চাকরি তৈরি হয় না, তেমনই নতুন ছোট ব্যবসারও সুযোগ কমে। ফলে, সরকারি চাকরির ওপর নির্ভর করে থাকা ছাড়া আর কোনও উপায় থাকে না।’
কিন্তু যে গুজরাট ভারতে শিল্পায়নে এক নম্বর, সেখানে কেন প্যাটেলরা সরকারি চাকরিতে সংরক্ষণের দাবিতে বিক্ষোভে ফেটে পড়ছেন? অধ্যাপক বন্দ্যোপাধ্যায় বললেন, ‘গুজরাটের গল্পটা আলাদা। সেখানে প্যাটেলরা চিরাচরিত ভাবে ব্যবসায়ী শ্রেণি। বেশি লেখাপড়া করার চল নেই প্যাটেলদের মধ্যে। তাঁরা হাতেকলমে ব্যবসার কাজ শিখে নেন। এখন গুজরাটে এত বড় বৈদেশিক পুঁজি আসছে যে তার সঙ্গে পাল্লা দেওয়ার মতো জোর প্যাটেলদের নেই। ফলে তাঁরা পিছু হঠছেন। এখন তাঁরা চাকরি চাইছেন। কিন্তু, বেসরকারি ক্ষেত্রে চাকরি পাওয়ার যোগ্যতাও তাঁদের সিংহ ভাগেরই নেই। ফলে, তাঁরা এখন যে কোনও ভাবে সরকারি চাকরি চাইছেন। তাই সংরক্ষণের দাবি।’
সব মিলিয়ে, ভারত এক বিচিত্র সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে আছে। দেশ এগিয়ে চলেছে উদার অর্থনীতির মুক্ত দুনিয়ার দিকে, কিন্তু তরুণ সমাজের বড় অংশ এখনও তৈরি নন। তাঁরা এখনও সরকারি চাকরির মুখাপেক্ষী। এবং, সেই কারণেই ৩০টি বেয়ারার চাকরির জন্য ৭৫,০০০ আবেদনপত্র জমা পড়ছে।