আর্থিক অনুদানের দাবিতে আন্দোলনে নেমেছেন কলকাতার মাদ্রাসা শিক্ষকরা
2015.07.27
দু’হাজারেরও বেশি মাদ্রাসা শিক্ষক তাঁদের অনশন প্রত্যাহার করে নিলেন বটে, কিন্তু একই সঙ্গে জানিয়ে দিলেন, তাঁদের দাবিদাওয়া না মেটা অবধি অসন্তোষ ফুরোবে না, প্রয়োজনে তাঁরা বৃহত্তর আন্দোলনের পথে হাঁটবেন।
গত এক বছরে এ নিয়ে তৃতীয় বার মাদ্রাসা শিক্ষকদের অনশন আন্দোলন মমতা সরকারের সংখ্যালঘু নীতির দিকে প্রশ্ন তুলে দিল। মুখ্যমন্ত্রী প্রায় প্রত্যেক সুযোগেই দাবি করেন যে তিনি পশ্চিমবঙ্গের সংখ্যালঘুদের জন্য প্রয়োজনীয় সব কাজই সেরে ফেলেছেন। প্রশ্ন উঠল তা নিয়েও।
মধ্য কলকাতার হাজি মহম্মদ মহসিন স্কোয়্যারের মাদ্রাসা বোর্ডের প্রাঙ্গণে অনশনে বসেছিলেন রাজ্যের অনুমোদনহীন ও ‘আনএইডেড’ বা সরকারি সাহায্য না পাওয়া মাদ্রাসাগুলির শিক্ষকরা। তাঁদের অভিযোগ, ২০১১ সালে ক্ষমতায় আসার আগে তৃণমূল কংগ্রেস বলেছিল, রাজ্যে দশ হাজার মাদ্রাসাকে অনুমোদন দেওয়া হবে। গত চার বছরে অনুমোদন পেয়েছে মাত্র ২৩৪টি মাদ্রাসা। তবে, কোনওটির জন্যই সরকারি অনুদানের ব্যবস্থা হয়নি। ‘আনএইডেড মাদ্রাসা বাঁচাও কমিটি’-র নেতা মহম্মদ কামরুজ্জামান হিসেব দিয়ে বললেন, এখন প্রায় ২৬০০ মাদ্রাসার অনুমোদনের আবেদনপত্র জমা পড়ে আছে। সরকার কোনও পদক্ষেপ নিচ্ছে না।
রাজ্যের পুরমন্ত্রী ও সংখ্যালঘু নেতা ফিরহাদ হাকিম জানালেন, ‘‘অনুমোদনহীন মাদ্রাসাগুলিকে স্বীকৃতি দিতে সরকারের কোনও আপত্তি নেই। কিন্তু স্বীকৃতির সঙ্গে আর্থিক সহায়তা দেওয়ার ক্ষমতা নেই আমাদের।’’ তাঁর বক্তব্য, অনুমোদনহীন মাদ্রাসাগুলিকে ‘সর্বশিক্ষা অভিযান’-এর আওতায় আনার চেষ্টা করেছিল সরকার। কিন্তু কেন্দ্র ওই প্রস্তাব মানতে রাজি নয়। সেখানেই বিষয়টি আটকে আছে।
আন্দোলনকারী শিক্ষকদের দাবি, অনুমোদনহীন মাদ্রাসাগুলির সরকারি অনুমোদন ও অনুদানের ব্যবস্থা করতে হবে। মাদ্রাসার ছাত্রছাত্রীদের জন্য মিড-ডে মিল, পোশাক এবং বইপত্রেরও ব্যবস্থা করতে হবে। তাঁরা মনে করিয়ে দিলেন, গত বছর আন্দোলনকারী শিক্ষকরা যখন অনশনে বসেছিলেন, তখন মন্ত্রী ফিরহাদ হাকিম এই দাবিগুলির নিষ্পত্তি করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। কিন্তু, বছর ঘুরে গেলেও কিছুই হয়নি।
গত বৃহস্পতিবার মাদ্রাসা বোর্ডের প্রাঙ্গণে প্রতিবাদস্থলে উপস্থিত হয়ে বামপন্থী নেতা রেজ্জাক মোল্লা অভিযোগ তুলেছেন, মুখ্যমন্ত্রী মুসলমানদের উন্নতি নিয়ে শুধু রাজনীতিই করছেন। ‘কয়েক জন ইমাম ও মুয়াজ্জিনের মাসিক ভাতার ব্যবস্থা করলেই সংখ্যালঘুদের উন্নয়ন হয় না। মুখ্যমন্ত্রীর কথায় ও কাজে বিস্তর ফারাক।’
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, রেড রোডে ঈদের নামাজের জমায়েতে ইমাম ক্কারি ফজলুর রহমান রাজ্য সরকারের কড়া সমালোচনা করে বলেন, গত চার বছরে রাজ্য সরকার সংখ্যালঘুদের উন্নয়নে কম প্রতিশ্রুতি দেয়নি। কিন্তু, কাজের কাজ কিছুই হয়নি। এ বার সরকার কিছু কাজ করে দেখাক।
উত্তর চব্বিশ পরগণার সন্দেশখালি অঞ্চলের মাদ্রাসা শিক্ষক রওশন আলি বললেন, “ মাদ্রাসা শিক্ষা নিয়ে সচেতনতার অভাব রয়েছে সরকারি স্তরেও। বিশেষত গ্রামাঞ্চলের দরিদ্র মুসলমান পরিবারের ছেলেমেয়েদের লেখাপড়ার ক্ষেত্রে মাদ্রাসার ভূমিকা কতখানি গুরুত্বপূর্ণ, নেতারা সম্ভবত সে কথা জানেন না। ফলে, তাঁদের কাছে মাদ্রাসার প্রশ্নটি মূলত রাজনীতির। ভোটের সময় তাঁদের মাদ্রাসার কথা মনে পড়ে। মূলধারার প্রাথমিক স্কুলগুলির জন্য যা বরাদ্দ, মাদ্রাসার জন্যও সেই ব্যবস্থা করলে রাজ্যের মুসলমান সমাজের উন্নতি হত”।
নামপ্রকাশে অনিচ্ছুক এক মাদ্রাসা শিক্ষক অবশ্য শুধু মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বা তাঁর তৃণমূল কংগ্রেস সরকারকে দোষ দিতে নারাজ। তিনি বললেন, বাম আমলেও মাদ্রাসা শিক্ষা দুয়োরানি ছিল, এখনও তাই। কোনও সরকারই মাদ্রাসা শিক্ষাকে তার প্রাপ্য গুরুত্ব দেয়নি। ফলে, মূলধারার সঙ্গে ব্যবধান রয়েই গিয়েছে।
সমাজতত্ত্বের গবেষক ও পেশায় একটি এনজিও-র কর্মী সোহিনী সেন বললেন, “মাদ্রাসার প্রশ্নটি যত ক্ষণ শুধু মুসলমানদের দাবি হিসেবে থেকে যাবে, তত ক্ষণ রাজনীতির হাত থেকে এর নিস্তার নেই। বিশেষত প্রাথমিক শিক্ষার ক্ষেত্রে মাদ্রাসাগুলি কেন গুরুত্বপূর্ণ, সে কথা বৃহত্তর জনসমাজের কাছে প্রতিষ্ঠিত না হলে প্রশ্নটি মূলধারার রাজনীতিতে ঠাঁই পাবে না। এবং, মাদ্রাসাগুলি বঞ্চিতই থেকে যাবে”।
মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের হাতেই রয়েছে রাজ্যের মাদ্রাসা শিক্ষার দফতরটি। তিনি আপাতত লন্ডন সফরে। গত শুক্রবার রাজ্যের প্রশাসনিক সদর দফতর নবান্নে গিয়ে রাজ্যের সংখ্যালঘু উন্নয়ন দফতরের প্রিন্সিপাল সচিব সৈয়দ আহমেদ বাবার সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন আন্দোলনকারীরা। সচিব প্রতিশ্রুতি দেন, মুখ্যমন্ত্রী ফিরলেই শিক্ষকদের দাবিদাওয়া নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা হবে। তার পর অনশন প্রত্যাহার করে নেন আন্দোলনকারী শিক্ষকরা।