নির্বাচনে সুফলের আশায়, মমতা দুই টাকা কেজিতে চাল-গম দেবে
2016.01.28
দু’বেলা দু’মুঠো খাবারের সংস্থান করতেই যাদের দিন কেটে যায়, তাদের ঘরে কি ভাতের গন্ধের নিশ্চয়তা নিয়ে এলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়?
২৭ জানুয়ারি কলকাতার ইন্দিরা গাঁধী সরণিতে উপস্থিত থাকলে এই প্রশ্নের একটাই উত্তর পাওয়া সম্ভব। হ্যাঁ। মুখ্যমন্ত্রীর প্রতিশ্রুতি সত্য হলে রাজ্যের সাত কোটি মানুষকে দু’বেলার খাবার নিয়ে আর ভাবতে হবে না।
প্রজাতন্ত্র দিবসের পরের দিন কলকাতার সভামঞ্চ থেকে মুখ্যমন্ত্রী তাঁর ‘খাদ্য সাথী’ প্রকল্পের সূচনা করলেন। এই প্রকল্প অনুযায়ী, পশ্চিমবঙ্গের ছয় কোটি দশ লক্ষ মানুষ প্রতি মাসে মাথাপিছু দুই কেজি চাল আর তিন কেজি গম পাবেন মাত্র দু’টাকা কিলোগ্রাম দরে। খোলা বাজারে এক কেজি চালের দাম অন্তত পঁয়ত্রিশ টাকা। গমের দামও তার কাছাকাছিই। এ ছাড়াও, আরও সত্তর লক্ষ মানুষ বাজার দরের অর্ধেক দামে চাল ও গম কিনতে পারবেন।
অর্থাৎ, মুখ্যমন্ত্রীর ঘোষণায় রাজ্যের অন্তত ৮০ শতাংশ মানুষের পাতে কার্যত নিখরচায় ভাত-রুটির ব্যবস্থা হল।
এই প্রকল্পে যে বিপুল টাকার প্রয়োজন, তা আসবে কোথা থেকে? বিশেষত, পশ্চিমবঙ্গের রাজকোষের বেহাল অবস্থা নিয়ে মুখ্যমন্ত্রী যেখানে নিজেই নিয়মিত সরব হন, সেখানে এই বিপুল ব্যয়ের বোঝা পশ্চিমবঙ্গ টানবে কী ভাবে? মুখ্যমন্ত্রীর ভাষণে এই প্রশ্নের কোনও স্পষ্ট উত্তর পাওয়া না গেলেও রাজ্য সরকারের এক উচ্চপদস্থ আমলা জানালেন, টাকার সিংহভাগ আসবে কেন্দ্র থেকে। খাদ্য সুরক্ষা আইনের অধীনে এই ব্যয়ভার বহন করতে কেন্দ্রীয় সরকার প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।
রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকরা বলছেন, মুখ্যমন্ত্রীর পাখির চোখ এখন আসন্ন বিধানসভা নির্বাচন। সবার পাতে খাবার জোগাতে পারলে নির্বাচনের ময়দানে তার যে বিপুল লাভ, মুখ্যমন্ত্রী সে কথা ভোলেননি।
তাঁর ভাষণেও কথাটি স্পষ্ট। তিনি একেবারে উল্লেখ করে জানিয়েছেন, এই প্রকল্পে সুবিধা হবে জঙ্গলমহলের বাসিন্দাদের, চা বাগানের শ্রমিকদের, সিঙ্গুরের জমিহারা পরিবারগুলির। অর্থাৎ, যাদের উন্নয়নের অভাব নিয়ে বিরোধীরা তাঁর দিকে আক্রমণ শানাতে অভ্যস্ত, মুখ্যমন্ত্রী সুকৌশলে তাঁদেরই জড়িয়ে নিলেন নিজের উন্নয়ন প্রকল্পের আখ্যানে।
সেই রাজনীতিতে অবশ্য আগ্রহ নেই ঊর্মিলা দাসের। বছর ষাটেকের ঊর্মিলা উত্তর কলকাতার দমদম অঞ্চলে গৃহপরিচারিকার কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করেন। তিনি বললেন, সত্যিই যদি দুই টাকা কেজি দরে চাল আর গম পাওয়া যায়, সংসারের অনেকখানি সুরাহা হবে। তাঁকে প্রশ্ন করা হল, এই সুবিধা যে ভোটের কথা মাথায় রেখেই, তা নিয়ে কোনও সংশয় আছে তাঁর? উত্তরে ঊর্মিলা বললেন, “ভোটের কথা ভেবেও যদি আমাদের সস্তায় চাল দেয়, তাতে আপত্তি করব কেন? ভোট তো আমরা ভাল থাকার জন্যই দিই। যে আমাদের ভাল রাখবে, তাকেই ভোট দেব।”
দিল্লির শিব নাদার বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির অধ্যাপক অরিজিৎ দাস বললেন, “ভারতের মতো দেশে উন্নয়নও হয় ভোটের কথা ভেবেই। শুধু পশ্চিমবঙ্গে নয়, ছবিটা গোটা দেশেই এক রকম। কাজেই, সে কথা আলাদা করে বলার মতো নয়। কিন্তু, সত্যিই যদি এই বিপুল সংখ্যক মানুষের কাছে কার্যত নিখরচায় চাল পৌঁছে দেওয়া যায়, মানব-উন্নয়নের ক্ষেত্রে তার গুরুত্ব অপরিসীম। এতে পুষ্টির দিকটা অনেক বেশি নিশ্চিত হবে তো বটেই, পাশাপাশি গরিব মানুষের মাথা থেকে সবচেয়ে বড় চিন্তাটা সরে যাবে। ফলে, তাঁরা অন্য কাজে মন দিতে পারবেন। তার লাভ বহু গুণ।”
মুখ্যমন্ত্রীর ঘোষণায় খানিক ব্যাকফুটে চলে গিয়েছেন বিরোধীরা। গরিব মানুষকে কার্যত নিখরচায় খাবার জোগানোর নীতিকে সরাসরি সমালোচনা করতে পারছেন না তাঁরা। হাওড়া অঞ্চলের সিপিআইএম নেতা দেবাশিস মিথিয়া যেমন বললেন, সত্যিই যদি গরিবকে সস্তায় খাবার দেওয়া যায়, সে তো ভাল কথা। কিন্তু, প্রতিশ্রুতি যে কাগজ-কলমেই থেকে যাবে না, তার গ্যারান্টি কী?
অর্থনীতিবিদ ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক দীপক বন্দ্যোপাধ্যায় অবশ্য সেই সম্ভাবনা উড়িয়ে দিচ্ছেন। তিনি বললেন, “অন্তত আগামী নির্বাচন অবধি জোরকদমে কাজ হবে এই প্রকল্পে। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় জানেন, ভোটের বাজারে খাবার একটা খুব স্পর্শকাতর প্রশ্ন। কংগ্রেসের রমরমার বাজারেও পশ্চিমবঙ্গে প্রফুল্ল সেন নির্বাচনে গোহারান হেরেছিলেন, কারণ তাঁর সরকারের নীতি সাধারণ মানুষের পাতে হাত দিয়ে ফেলেছিল। তার পরেও আলু-পেঁয়াজের দামে নির্বাচনের ফলের হেরফেরের ইতিহাস ভারতে আছে। অন্য দিকে, সস্তায় খাবার দিতে পারলে মানুষ যে খুশি হয়, সেটাও অনস্বীকার্য। ফলে, এই সিদ্ধান্তে মুখ্যমন্ত্রীর রাজনৈতিক লাভ বিলক্ষণ হবে। কিন্তু, সাধারণ মানুষেরও লাভ হবে। গণতন্ত্রে সেটাই সবচেয়ে বড় কথা।”
রাজনীতির চালে যদি দু’বেলা দু’মুঠো খাবার জোটে হতদরিদ্রের পাতে, তাতে মন্দ কী? সেটুকুই না হয় এই নির্বাচনের পাওনা হল।