মোদীর অভিষেককালীন প্রতিশ্রুতির দিকে এখনো তাকিয়ে আছে ভারতের মুসলিমরা
2015.05.27

প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী একবছর আগে যখন দায়িত্ব নেন তখন তিনি ধর্ম-বর্ণ ও জাতি নির্বিশেষে ভারতের সকল জাতি-গোষ্ঠীর দারিদ্র নিরসনে ব্যবস্থা গ্রহন করবেন বলে অঙ্গীকার করেছিলেন।
কিন্তু ক্ষমতায় হিন্দু জাতীয়তাবাদী ভারতীয় জনতা পার্টির (বিজেপি)এক বছর পার হবার পর ভারতীয় মুসলিমরা বলছেন, তারা তাদের উন্নতির কোনো কিছু দেখছেন না।যদিও ১২০ কোটি জন সংখ্যার এইদেশে ১৪.৪ শতাংশ মুসলিম প্রতিনিধিত্ব করে, যারা দেশের বৃহত্তর ধর্মীয় সংখ্যালঘু, যাদের ব্যপকভাবে দারিদ্র মুক্তি জরুরী।
কলকাতার মোটর রিপেয়ার শপে কর্মরত মোহাম্মদ রিয়াজ বললেন, “ এটা ছিল আমাদের জন্য কঠিন বছর”।
ভারতের সংখ্যাগুরু হিন্দুদের সাথে মুসলিমদের সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা দীর্ঘদিন ধরে বিরাজমান। ২০০২ সালে গুজরাটের দাংগায় মৃত্যু ঘটেছে অনেক মুসলমানের, যেখানে মোদী মূখ্যমন্ত্রী ছিলেন। ২০১৪ সালের ২৬ মে প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব নেবার পর রিয়াজের মতো মানুষরা ভেবেছিলেন মুসলিম বিরোধী পরিস্থিতির পরিবর্তন হবে।
রিয়াজ বেনারকে বলেন, “পরিস্থিতি পরিবর্তনের জন্য কেউ আসেনি, কিন্তু আবাতাসে একটা অবিশ্বাসের গন্ধ ছিল।আমি ভীত ছিলাম যে কেউ একদিন এসে আমাকে দোকান বন্ধ করতে বলবে।মুসলিম হিসেবে চলা খুব সহজ না”।
অব্যাহত বিচ্ছিন্নতা
বিশ্লেষকরা একমত যে মোদীর অধীনে মুসলিমদের অবস্থার উন্নতি হয়নি।তারা এমন কোনো আশা দেখতে পাচ্ছে না যে, নিকট ভবিষ্যতে সংখ্যালঘুদের ভালো কিছু পরিবর্তন ঘটবে।
“মুসলিমরা দেশের বৃহত্তর সংখ্যালঘু দুরাবস্থার মধ্যে জীবন কাটাচ্ছে”, বেনার নিউজকে বললেন কলকাতার সমাজ বিজ্ঞানী অনন্যা চাটার্জী।
তিনি জানান, বিজেপি হচ্ছে প্রথম একটি দল যারা লোকসভায় সংখ্যা গরিষ্ঠতা নিয়ে এসেছে যেখানে একজনও নির্বাচিত মুসলিম প্রতিনিধি নেই।তার মতে, গত বছরের নির্বাচনে বিজেপির ৭ মুসলিম প্রার্থীর একজনও নির্বাচিত না হওয়া মুসলিমরা সামাজিকভাবে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে।
নির্বাচনের পর সংখ্যালঘু সদস্যরা স্থানীয় অনেকের বিরুপ মন্তব্যের শিকার হন।২০১৪ সালের জুনে ২৪ বছরের মুসলিম আইটি প্রফেশনাল মহসিন সাদিক শেখ বিজেপির কর্মিদের হাতে নিহত হন এবং কমিউনিটিতে তারা ত্রাসের সঞ্চার করে।
চাটার্জী বলেন, “ কিছু হিন্দু নেতা উদ্দেশ্যপূর্ণভাবে বোঝাতে চান ভারত মুসলিমদের ছাড়াই এগিয়ে যেতে পারে আর তাই কোথাও তাদের স্থান নেই সেই ধারনা দিচ্ছেন”।
সঙ্কুল ঘটনা প্রবাহ
মোদীর এক বছরের শাসনামলে সাম্প্রদায়ীক কোনো দাঙ্গা সংঘটিত হয় নাই, তবে, বেশ কিছু ঘটনা বিপজ্জনক মোড় নিয়েছে।
ইউএস কমিশন অন ইন্টারন্যাশনাল রিলিজিয়াস ফ্রিডম ২০১৫ সালের বার্ষিক রিপোর্টে জানায়, মোদী ক্ষমতাসীন হবার পর এক বছরে সংখ্যালঘুরা ভারতে “সহিংস আক্রমন” ও “জোরপূর্বক ধর্মান্তর”-এর শিকার হয়েছে।“হিন্দু জাতীয়তাবাদীরা জোরপূর্বক “ধর্মান্তরের” ঘোষণা দেয় এবং ৪,০০০ খ্রিস্টান ও ১,০০০ মুসলিম পরিবারকে হিন্দুত্ব বরণ করতে বাধ্য করে। এটা ছিলো তাদের ‘ঘর ওয়াপসি’ বা ঘরে ফেরত কর্মসূচির অংশ।
ইউএসসিআইআরএফ আরো উল্লেখ করে, “ মুসলিমরা অভিযোগ করেছে যে, তাদের মসজিদ নজরদারীতে রাখা হয় এবং অনেক তরুন ও পুরুষদের নির্বিচারে আটক রাখা হয় সন্ত্রাসবাদ প্রতিরোধের নামে”।
“মুসলিমদের আরো অভিযোগ, ভারতের অধিকাংশ রাজ্যে মুসলিমদের ধর্মীয় স্বাধীনতা সীমিত কিংবা ব্যাহত করা হয় গরু জবাই নিষিদ্ধ করার মাধ্যমে, যা ঈদ-উল আযহাতে মুসলিমদের অপরিহার্য বিষয়”।
অর্থনৈতিকভাবে পিছিয়ে
কলকাতার একজন পন্ডিত মিরাতুন নাহার বলেন, জনসংখ্যার উল্লেখযোগ্য অংশ মুসলিমরা অর্থনৈতিকভাবে বঞ্চনার শিকার।“ তাদেরকে ধর্মীয় গ্রুপ হিসেবে দেখার চেয়ে তাদেরকে পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠি হিসেবে দেখা উচিত। মোদী সরকার সামাজিকভাবে ও অর্থনৈতিকভাবে ক্ষমতাবান করার ব্যাপারে কিছুই করে নাই।আমি অবাক হচ্ছি, এই দুই দিক দিয়ে তাদেরকে সামাজিক বঞ্চিত করে ভারত সামনে এগিয়ে যাবে কি করে?”
নয়াদিল্লির ইকনোমিক রিসার্স ফাউন্ডেশনের সিনিয়র অর্থনীতিবিদ অভিজিত মুখোপাধ্যায় বেনারকে বলেন, “এটা নয় যে শুধু মুসলিমদের জন্য করূণ সুর বাজবে, বরং পুরো অর্থনীতির জন্য ভোগান্তি হবে।যদি অস্থিরতা থাকে আর তা যদি ধর্মীয় কারণে হয়, তাহলে ব্যক্তিখাতে বিনিয়োগ হবে না”।
জাতির প্রতিটি নাগরিক বেড়ে উঠছেঃ বিজেপি
মোদী সরকারের মন্ত্রী সিনিয়র বিজেপি নেতা এইসব সমালোচনার জবাবে বলেন, সরকার সামগ্রিকভাবে উন্নয়নের ধারা এগিয়ে নিচ্ছে।
নগর উন্নয়ন, গৃহায়ন ও দারিদ্র বিমোচন মন্ত্রী বাবুল সুপ্রিয় বেনার নিউজকে বলেন, “যখন একটা জাতি বেড়ে ওঠে তখন জাতির প্রতিটি নাগরিক প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে বেড়ে ওঠে, সে হিন্দু হোক আর মুসলিম হোক বা অন্য কোনো সম্প্রদায়ের হোক”।
মন্ত্রী তার বক্তব্যের সমর্থনে একটি তালিকা দেন যাতে সংখ্যালঘুরা বিশেষ করে মুসলিমদের জন্য করা হয়েছে।এতে স্কুলের উন্নয়ন সাধন ও স্কুলে ভর্তির সুযোগ, উর্দুতে শিক্ষার ব্যবস্থা, গরীবদের জন্য স্ব-উদ্যোগে কর্মসংস্থান ও কর্ম দক্ষতা বৃদ্ধির প্রযুক্তি ভিত্তিক প্রশিক্ষণ।
কিন্তু, এইসব কর্মসূচি মুসলিমদের তেমন উল্লেখ করার মতো অগ্রগতি নিয়ে আসে নাই।
অর্থনীতিবিদ মুখোপাধ্যায় জানান, “যদি ১৫ শতাংশ জনগোষ্ঠী বৈষম্যের শিকার হয় তাহলে অর্থনীতিতে অসাম্য, সমাজে অস্থিরতা এবং সহিংসতা বিরাজ করবে যা সামগ্রিক উন্নয়নকে ব্যাহত করবে। অর্থনৈতিক অসাম্য বিচ্ছিন্নতাও ডেকে আনে, এতে করে কমিউনিটি মৌলবাদী শক্তির জন্য সহজ টার্গেট হয়ে ওঠে”।