কলকাতায় এক ইঞ্জিনিয়ারের বাড়ি থেকে ২০ কোটি টাকা উদ্ধার!

কলকাতা থেকে মাসুমা পরভীন
2015.08.18
Ind-money কলকাতায় এক সাব-ইঞ্জিনিয়ারের বাড়িতে পাওয়া গেলো ২০ কোটি টাকা ও অনেক অলংকার। ১৪ আগষ্ট,২০১৫
অনলাইন

হাওড়ার নস্করপাড়া লেনের ১৪০ নম্বর বাড়িটা যেন আলিবাবার গল্পের ডাকাতদের গুহা। গত শুক্রবার রাতে চিচিং ফাঁক হওয়ার পর চোখ ধাঁধিয়ে গেল অভিজ্ঞ পুলিশ কর্মীদেরও।

আলমারি-ওয়াড্রোব-কাবার্ড তো বটেই, মেঝের টালির নীচে, দেওয়ালে, বিছানার তোষকে, সোফার গদিতে এমনকী বাথরুমের অব্যবহৃত কমোড থেকেও বেরিয়ে এল রাশি রাশি টাকা। ৫০০ আর ১০০০ টাকার নোটের বান্ডিল মিলিয়ে মোট নগদের পরিমাণ ২০ কোটি টাকারও বেশি। পাওয়া গিয়েছে ১৪ লক্ষ টাকার সোনার গহনা এবং ৫৮ লক্ষ টাকার পোস্ট অফিসের দীর্ঘমেয়াদি আমানতও।

তদন্তের সঙ্গে যুক্ত নামপ্রকাশে অনিচ্ছুক এক পুলিশকর্মী জানালেন, তাঁরাও অবাক হয়ে গিয়েছেন উদ্ধার হওয়া টাকার পরিমাণে। মজার কথা, উদ্ধার হওয়া টাকার মধ্যে পাওয়া গিয়েছে বেশ কিছু জাল নোটও। পুলিশকর্মীটি হাসতে হাসতে বললেন, সম্ভবত কোনও প্রোমোটারই ঘুষের টাকায় নকল নোট গুঁজে দিয়েছিলেন।


প্রণবের পরিচয়

এই গুপ্তধনের মালিক সাবেক বালি পুরসভার (এখন হাওড়া পুরসভার অন্তর্গত) অ্যাসিস্ট্যান্ট সাব ইঞ্জিনিয়র প্রণব অধিকারী। ১৯৯৫ সালে পুরসভার চাকরিতে যোগ দেন প্রণব। মাইনে কত?  মাসে বড় জোর পঞ্চাশ হাজার টাকা। তিনতলা বাড়িতে জমিয়ে রাখা এই কুবেরের ধনের উৎস হল ঘুষের টাকা। জানা গিয়েছে, বালি-লিলুয়া অঞ্চলে প্রণবকে ঘুষ না দিয়ে একটি ইঁটও গাঁথা সম্ভব ছিল না। আয়ের সঙ্গে সঙ্গতিহীন সম্পত্তির অভিযোগে গ্রেফতার করা হয়েছে প্রণব এবং তাঁর পুত্র তন্ময় অধিকারীকে। বাজেয়াপ্ত টাকা আপাতত সিআইডি-র হেফাজতে রয়েছে।

তিনতলা বাড়ির গোটাটাই দামি মার্বেল পাথরে মোড়া। বাথরুমে সুদৃশ্য টাইলস। ছেলের জন্য বাড়িতে একটা মাল্টিজিমও বানিয়ে দিয়েছিলেন প্রণব অধিকারী। বাড়িতে যে কারও প্রবেশাধিকার ছিল না। দরজা বন্ধই থাকত। প্রতিবেশীরা জানিয়েছেন, বালি পুরসভার চাকরিতে যোগ দেওয়ার কয়েক বছরের মধ্যেই আর্থিক অবস্থা ফিরে যায় প্রণবের। নস্করপাড়া অঞ্চলেরই পুরনো বাসিন্দা প্রণবরা। তাঁর মা-বাবা আজও থাকেন ঢিল ছোড়া দূরত্বে, একটি এক কামরার টালির বাড়িতে।


যেভাবে ধরা পড়লো

হঠাৎ পুলিশের নজরে পড়লেন কেন প্রণব অধিকারী?  জানা গিয়েছে, লিলুয়া অঞ্চলের দুই প্রোমোটার আত্মপ্রকাশ ও ভানুপ্রকাশ সিংহ তাঁর নামে রাজ্য পুলিশের দুর্নীতিদমন শাখায় অভিযোগ করেন। তাঁদের দাবি, লিলুয়া অঞ্চলে একটি ১৩ কাঠার জমিতে প্রোমোটিং করার জন্য পুরসভার কাছে আবেদনপত্র পেশ করলে প্রণব তাঁদের কাছে কাঠাপিছু দেড় লক্ষ টাকা দাবি করেন। সেই টাকার বড় অংশ মিটিয়ে দেওয়ার পরেও বিভিন্ন অজুহাতে অনুমতিপত্র দিতে অস্বীকার করেন প্রণব এবং আরও টাকা দাবি করতে থাকেন। শেষ পর্যন্ত নাচার হয়েই দুর্নীতিদমন শাখায় অভিযোগ করেন তাঁরা। তারই ফলে তদন্ত,  এবং তাতেই উদ্ধার আলিবাবার গুপ্তধন।

কিন্তু, প্রণবের মতো এক জন মাঝারি মাপের কর্মীর পক্ষে কি এত বড় মাপের দুর্নীতি চালানো সম্ভব?  বালি অঞ্চলের তৃণমূল কংগ্রেস নেতা প্রদ্যোৎ মুখোপাধ্যায় বললেন, বাম আমলের পুরবোর্ডের প্রত্যক্ষ প্রশ্রয়েই এই দুর্নীতিচক্র চলেছে। বস্তুত, ঘটনায় বারে বারেই উঠে এসেছে তৎকালীন বাম পুরপ্রধান অরুণাভ লাহিড়ির নাম। আত্মপ্রকাশ ও ভানুপ্রকাশ সিংহ অভিযোগ করেন, অরুণাভ তাঁদের কোনও অভিযোগেই কর্ণপাত করেননি এবং তাঁদের প্রণব অধিকারীর কাছেই ঠেলে দেন। আরও অনেকের গলাতেই এক অভিযোগের সুর। আর এক ভুক্তভোগী,  লিলুয়ার বাসিন্দা কমলকুমারী কুণ্ডুও জানিয়েছেন,  প্রণবের বিরুদ্ধে কোনও অভিযোগই পাত্তা দিতেন দিতেন না অরুণাভ।


দূর্নীতিতে আরো অনেকেই জড়িত

প্রাক্তন পুরপ্রধান এই অভিযোগ অস্বীকার করলেও নড়েচড়ে বসেছে সিপিআইএম-এর শীর্ষনেতৃত্ব। খোঁজখবর নেওয়া চলছে। প্রণব অধিকারীর হাতে পুরস্কার তুলে দিচ্ছেন অরুণাভ লাহিড়ি,  তেমন ছবিও পৌঁছেছে শীর্ষ নেতাদের হাতে। খবরে জানা গিয়েছে, প্রণবের হাত থেকে ঘুষের বখরা পৌঁছে যেত বহু হাতে। সেই তালিকায় যেমন সব রাজনৈতিক দলের স্থানীয় নেতারা ছিলেন, তেমনই ছিলেন পুরসভার বিভিন্ন স্তরের কর্মী, পুলিশ এমনকী স্থানীয় দুষ্কৃতীরাও। ঠিক কারা জড়িত,  এই প্রশ্নের উত্তরে এক পুরকর্মী বললেন,  কম্বলের লোম বাছতে বসলে মুশকিল! এই দুর্নীতিতে জড়িতদের তালিকা তৈরি করলে কারও নামই বাদ পড়বে না।

স্বভাবতই প্রশ্ন উঠছে, এই দুর্নীতি কি শুধু বালি পুরসভারই ঘটনা,  নাকি পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন প্রান্তে একই খেলা চলছে?  কলকাতা পুলিশের প্রাক্তন অ্যাসিস্ট্যান্ট কমিশনার দীপক আইচ বললেন, সব জায়গাতেই টাকার খেলা চলে। কেউ যদি সাহস করে অভিযোগ করেন এবং সত্যিই যদি সেই অভিযোগের তদন্ত হয়,  তবে অনেকেরই মুখোশ খুলে যাবে।

আতঙ্কের রেশ ধরা পড়ছে বিভিন্ন পুরসভার ইঞ্জিনিয়র,  কর্মীদের গলাতেও। নাম প্রকাশ করা যাবে না,  এই শর্তে কলকাতা পুরসভার এক অ্যাসিস্ট্যান্ট ইঞ্জিনিয়র বেনারনিউজকে বললেন,  বাম আমলেও পুরসভায় টাকার খেলা চলত,  এই আমলেও চলে। বস্তুত,  শুধু কলকাতা পুরসভা নয়,  দমদম, রাজারহাট-গোপালপুরের মতো পুরসভাতেও একই অবস্থা। যেখানেই জোরকদমে বাড়িঘর তৈরি হচ্ছে,  সেখানেই দুর্নীতি আছে। তদন্ত হলে অনেকের নামই উঠে আসবে।

শহরবাসী প্রশ্ন তুলছেন,  রাজনৈতিক জমানা বদলালেও কেন এই ছবিটা অপরিবর্তিত থাকে?  তা হলে কি সব শুধু টাকারই খেলা?

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।