তৃণমূলের মিছিলে বন্দুক-আস্ফালন, বিধানসভায় বামপন্থীদের বিক্ষোভ

কলকাতা থেকে মাসুমা পরভীন
2015.09.23
Ind-politics কলকাতায় বিধান সভার সামনে বামপন্থী বিধায়করা খেলনা পিস্তল দেখিয়ে বিক্ষোভ করছেন। ২২ সেপ্টেম্বর,২০১৫
অনলাইন

দিনদুপুরে বিধানসভা চত্বরে রিভলভার হাতে ঘুরছেন কয়েক জন।
এমনই এক অভূতপূর্ব দৃশ্যের সাক্ষী থাকল পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভা। গতকাল রাজ্যের বামপন্থী বিধায়করা রিভলভার হাতে বিক্ষোভ দেখালেন সেখানে। অবশ্য, খেলনা রিভলভার। বড়বাজার থেকে ডজন দরে কেনা!

কেন বিক্ষোভ? এমন বিচিত্র প্রতিবাদের পথে কেন হাঁটলেন বামপন্থী বিধায়করা? এই প্রশ্নের উত্তর পাওয়া যাবে মুর্শিদাবাদের কান্দিতে। তৃণমূল কংগ্রেস শুভেন্দু অধিকারীর সভা ছিল সেখানে। সেই সভায় যাওয়ার মিছিলে দেখা গেল, কয়েক জন যুবক প্রকাশ্যেই হাতে নাইন এম এম রিভলভার নিয়ে হাঁটছেন। বন্দুক ধরা হাত আকাশের দিকে তোলা। টেলিভিশনের ক্যামেরায় ধরা পড়ল ছবি, ছড়িয়ে পড়ল গোটা রাজ্যে। স্থানীয়রা জানালেন, যে চার জনকে রিভলভার হাতে মিছিলে হাঁটতে দেখা গিয়েছে, তারা হলেন সব্যসাচী দাস, পার্থসারথি দাস, দুঃশাসন ঘোষ এবং মাধব দাস, তৃণমূল কংগ্রেসের ঘনিষ্ঠ হিসেবেই এলাকায় পরিচিত।

এত দিন যে দৃশ্যটি উত্তর প্রদেশ বা বিহারের মতো রাজ্যের আইনহীনতার প্রতীক হিসেবে পরিচিত ছিল, পশ্চিমবঙ্গে ঠিক সেটাই দেখে চমকে গিয়েছে রাজ্যবাসী। রাজনৈতিক মহল থেকে নাগরিক সমাজ,  সর্বত্র দাবি উঠল,  অবিলম্বে অপরাধীদের প্রেফতার করতে হবে। পুলিশ অবশ্য তৎপর হল না। রাত পেরিয়ে পর দিন গ্রেফতার করল এমন দুজনকে,  যারা মিছিলে হাজির থাকলেও তাদের হাতে বন্দুক থাকার কোনও ছবি দেখা যায়নি। যাদের ছবি দেখা গিয়েছিল,  তারা নাকি ফেরার।

কান্দি থানার এক পুলিশকর্মী নাম গোপন রাখার শর্তে সংবাদমাধ্যমকে বললেন,  ‘উপরতলার নির্দেশ না থাকায় চোখের সামনে গোটা ঘটনাটি ঘটলেও কিছু করতে পারিনি।’  মুর্শিদাবাদের পুলিশ সুপার সি সুধাকর অবশ্য কোনও রাজনৈতিক চাপের কথা স্বীকার করেননি। বলেছেন,  ভিডিও ফুটেজ দেখে অপরাধীদের চিহ্নিত করতে সময় লেগেছে। তদন্তে যাদের নাম উঠে আসবে,  তারা অভিযুক্ত তালিকায় ঢুকে যাবে বলে আশ্বাস দিয়েছেন তিনি।

তৃণমূল কংগ্রেস অবশ্য দায় নিতে নারাজ। গ্রেফতার হওয়া দুই যুবকের সঙ্গে দলের সম্পর্ক অস্বীকার করেছেন জেলার নেতারা। মুর্শিদাবাদের জেলা তৃণমূল কংগ্রেস সভাপতি মান্নান হোসেন বললেন,  ‘তৃণমূলের মিছিলে এ সব হয় না। যদি কিছু হয়েও থাকে, তবে সেটা কোনও গলিতে হয়েছে। এবং  পুরোটাই কংগ্রেসের চাল।’

তবে,  সেই তত্ত্বকেও ছাপিয়ে গিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। বলেছেন,  ‘আমার কাছে খবর আছে, একটা টেলিভিশন চ্যানেল কংগ্রেসের সঙ্গে ষড়যন্ত্র করে লোক ঢুকিয়েছিল। অভিযোগ প্রমাণ হলে তাদের কঠোর শাস্তি হবে।’


বিধানসভায় তুলকালাম

অভিযুক্তদের ছবি এবং নাম গণমাধ্যমে প্রকাশিত হওয়ার পরেও তাদের গ্রেফতার করা গেল না কেন,  প্রশ্ন তুলে খেলনা রিভলভার হাতে বিধানসভায় অভূতপূর্ব বিক্ষোভের রাস্তা বেছে নিলেন বামপন্থী বিধায়করা। সরকার পক্ষ অবশ্য সেই বিক্ষোভকে ভাল চোখে দেখেনি। স্পিকারের নির্দেশে বিধানসভার মার্শাল খেলনা রিভলভারগুলি বাজেয়াপ্ত করেন। পুলিশ তদন্ত করে দেখবে,  সেগুলি আসল না নকল।

কান্দির ঘটনাটিকে মুখ্যমন্ত্রী টেলিভিশন চ্যানেলের সাজানো ঘটনা বলেছিলেন। অভিযুক্তরা গ্রেফতার হয়নি। অথচ, বিধানসভায় বিরোধীদের খেলনা রিভলভার হাতে বিক্ষোভের প্রসঙ্গে তিনি বললেন,  ‘বিধানসভায় এত বড় একটা নিষ্ঠুর ঘটনা ঘটল। এটা অসৌজন্য,  অশোভনীয়ই শুধু নয়,  গণতন্ত্রের কলঙ্কজনক দিন। আমি মনে করি,  যারা বন্দুক নিয়ে বিক্ষোভ দেখিয়েছে,  তাদের গ্রেফতার করা উচিত।’

মুখ্যমন্ত্রীর মন্তব্যে স্বভাবতই প্রবল প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন বিরোধীরা। বিরোধী দলনেতা সূর্যকান্ত মিশ্র বললেন, ‘পিস্তল নিয়ে যারা মিছিল করল,  তারা ধরা পড়ল না। আর আমাদের বিধায়করা খেলনা পিস্তল নিয়ে প্রতীকী প্রতিবাদ করলেন বলে তাঁদের নাকি গ্রেফতার করতে হবে! উনি গ্রেফতার করে দেখান!’


সিপিআইএম-এর পাশে দাঁড়িয়েছে বিজেপি,  কংগ্রেসও। রাজ্য বিধানসভায় বিজেপি-র একমাত্র বিধায়ক শমীক ভট্টাচার্য বললেন, ‘আসল পিস্তলের চেয়ে নকল পিস্তলেই রাজ্য সরকারকে বেশি উদ্বিগ্ন দেখা যাচ্ছে।’  কংগ্রেস বিধায়ক মানস ভুঁইয়া বললেন,  ‘নকল পিস্তলের প্রতিবাদ দেখে মুখ্যমন্ত্রী এত উদ্বিগ্ন! অথচ, আসল অপরাধীরা চিহ্নিত হওয়া সত্ত্বেও ধরা পড়ছে না।’


শাসনহীন পশ্চিমবঙ্গ

সমাজতত্ত্বের অধ্যাপিকা অনন্যা চট্টোপাধ্যায় বললেন,  ‘বামপন্থী বিধায়করা যে বিক্ষোভ দেখিয়েছেন, তার অনেকটাই চমক। সেই বিক্ষোভ নিয়েই এত কথা হচ্ছে যে তাতে আসল প্রশ্নটা ঢাকা পড়ে যাচ্ছে। টেলিভিশনের পর্দায় যে ছবি দেখলাম,  তাতে বুক কাঁপছে। ওই যুবকরা যে ভাবে রিভলভার উঁচিয়ে হাঁটছিল, সেই ভঙ্গিটি এত দিন উত্তর প্রদেশের গুন্ডারাজ নিয়ে তৈরি হিন্দি ছবির পর্দায় দেখতাম। স্পষ্টতই, তাদের মনে প্রশাসন সম্বন্ধে বিন্দুমাত্র ভয় নেই। এটা প্রশাসনেরই ব্যর্থতা। শাসক দলের লোক হলে কোনও অপরাধেই পুলিশ কিছু বলবে না,  এই কথাটা এখন পশ্চিমবঙ্গে প্রতিষ্ঠিত। ফলে, আইনের শাসন ভেঙে পড়ছে।’

মুর্শিদাবাদের বহরমপুরের বাসিন্দা মানিক মজুমদার প্রায় একই সুরে বললেন,  ‘এখন জোর যার, মুলুক তার। এই ছবিটা টিভির ক্যামেরায় ধরা পড়েছে বলে এত হইচই হচ্ছে। কিন্তু, মুর্শিদাবাদের মতো জেলায় এটাই এখন প্রাত্যহিক ঘটনা।’

তৃণমূল কংগ্রেসের এক রাজ্য স্তরের নেতাও বললেন,  ‘এই ঘটনাগুলোয় মানুষের কাছে ভুল বার্তা পৌঁছোচ্ছে। অপরাধীর রাজনৈতিক রঙ বিচার করলে প্রশাসনের নিরপেক্ষতা বলতে আর কিছু বাকি থাকে না। বরং, দ্রুত ব্যবস্থা গ্রহণ করলে, অবিলম্বে অপরাধীদের গ্রেফতার করলে সরকারের নৈতিক জোর বাড়ত।’


তা হলে কি পশ্চিমবঙ্গ অদূর ভবিষ্যতেই উত্তর প্রদেশ বা বিহারের সঙ্গে এক পঙক্তিতে বসতে চলেছে?  উত্তর খুঁজছেন রাজ্যের মানুষ।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।