ভারতীয় মন্দিরে মহিলাদের ওপর বিবিধ নিষেধাজ্ঞা জারি

কলকাতা থেকে মাসুমা পরভীন
2015.11.25
Ind-temple ভারতীয় মন্দিরে মহিলাদের ওপর বিবিধ নিষেধাজ্ঞা জারি।
অনলাইন

একা কাশীতে রক্ষা নেই, সবরীমালা দোসর!

ভারতে দাঁড়িয়ে কোনও মহিলা আজ এই ভাষাতেই নিজের হতাশা প্রকাশ করলে অবাক হওয়ার কিচ্ছু নেই।

কাশী বা বারানসীতে উত্তর ভারতের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ হিন্দু তীর্থস্থান বিশ্বনাথ মন্দির অবস্থিত। আর কেরলের সবরীমালার আয়াপ্পা মন্দির হল দক্ষিণ ভারতের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হিন্দু তীর্থ। গত কয়েক দিনে এই দুই মন্দির থেকেই এমন দুটি ঘোষণা শোনা গেল, যাতে নারীবিদ্বেষের গন্ধ অত্যন্ত তীব্র বলেই মনে করছেন ভারতের বিদ্বজ্জনরা।

সবরীমালা মন্দিরের নতুন প্রধান প্রায়ার গোপালকৃষ্ণন জানিয়েছেন, যে বয়সের মহিলারা রজঃস্বলা হন, সেই ১০ থেকে ৫০ বছর বয়সী মহিলাদের মন্দিরে প্রবেশ নিষেধ। অনেক হিন্দু মন্দিরেই নিয়ম, যখন কোনও মহিলার পিরিয়ড চলে, তখন তিনি সেই মন্দিরে প্রবেশ করতে পারবেন না। গোপালকৃষ্ণন আরও এক ধাপ এগিয়ে গেলেন।

তবে, এই সিদ্ধান্তের চেয়েও বিতর্কিত হয়েছে তাঁর একটি মন্তব্য। তিনি বলেছেন, “এখন তো এমন স্ক্যানার বেরিয়েছে, যাতে দেখে নেওয়া যায় কেউ নিজের শরীরে কোনও অস্ত্র লুকিয়ে রেখেছেন কি না। হয়তো অদূর ভবিষ্যতেই এমন স্ক্যানারও বেরোবে, যাতে দেখে নেওয়া যাবে, কোনও মহিলার পিরিয়ড চলছে কি না। তখন নিশ্চয়ই রজঃস্বলা বয়ঃক্রমের মহিলাদেরও মন্দিরে ঢুকতে দেব, কিন্তু তার আগে পরীক্ষা করে নেব, তিনি ‘শুদ্ধ’ কি না।“


টুইটার-ফেসবুকে প্রতিবাদ

গোপালকৃষ্ণনের মন্তব্যে স্বভাবতই বেজায় ক্ষেপেছেন ভারতের শিক্ষিত জনগোষ্ঠী। গত কাল থেকে ফেসবুক-টুইটার ভরে গিয়েছে #HappyToBleed হ্যাশট্যাগে। এমনিতে ভারতে মহিলাদের পিরিয়ড নিয়ে প্রকাশ্যে আলোচনা হয় না বললেই চলে। কিন্তু কাল থেকে মেয়েরা ফেসবুকে নিজেদের ছবি দিয়ে চলেছেন, হাতে ধরা প্ল্যাকার্ডে বার্তা সহ। বহু প্ল্যাকার্ডই আকৃতিতে স্যানিটারি ন্যাপকিনের মতো। তাতে লেখা, “আমাদের প্রতি মাসে কয়েক দিন পিরিয়ড হয়। সেটা আমাদের সমস্যা নয়। সমস্যা আপনাদের মানসিকতা।”

#HappyToBleed আন্দোলনটি আরম্ভ করেছেন কলেজছাত্রী নিকিতা আজাদ। তিনি নিজের ফেসবুক প্রোফাইলে লিখেছেন, “হ্যাঁ, আমাদের পিরিয়ড হয়। তা নিয়ে আমরা একেবারেই লজ্জিত নই। এটা মেয়েদের একটা অতি স্বাভাবিক শারীরিক ক্রিয়া। সে বিষয়ে কোনও মন্তব্য করার অধিকার অন্য কারও নেই।”

কেন এমন আন্দোলন আরম্ভ করার কথা ভাবলেন তিনি? নিকিতা জানালেন, “নারী-জীবনের এই বিশেষ দিকটিকে লুকিয়ে রাখার যে বিন্দুমাত্র কারণ নেই, সেই সচেতনতা তৈরি করার জন্যই এই আন্দোলন।” শুধু মেয়েরাই নয়, এগিয়ে এসেছেন ছেলেরাও। তাঁরাও জানাচ্ছেন, তাঁরা পুরুষতন্ত্রের এই আগ্রাসনের বিরুদ্ধে।

অন্য দিকে, বারানসীর কাশী বিশ্বনাথ মন্দির কর্তৃপক্ষ জানিয়েছেন, হাতকাটা জামা, হাঁটুঝুলের প্যান্ট বা অন্য কোনও পোশাক, যাতে হাত বা পা অনাবৃত থাকে, তা পরে মন্দিরে প্রবেশ করতে পারবেন না কোনও বিদেশিনী। তবে, সবরীমালার মতো কাশী বিশ্বনাথে তাঁদের প্রবেশ একেবারে নিষিদ্ধ করে দেওয়া হয়নি।

মন্দির কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, প্রতি বছর ভক্তরা মন্দিরে অজস্র শাড়ি দান করেন। সেই শাড়ি মন্দিরের বাইরে পুলিশ সহায়তা কেন্দ্রে দেওয়া থাকবে। পোশাক পরিবর্তনের ঘরও থাকবে। যিনি মন্দিরে ঢুকতে চান, প্রয়োজনে মহিলা কনস্টেবলের সাহায্য নিয়ে তিনি শাড়ি পরে নিলেই মন্দিরে প্রবেশে আর কোনও বাধা থাকবে না।

মন্দিরের অ্যাসিস্ট্যান্ট চিফ এক্সিকিউটিভ অফিসার পি এন দ্বিবেদী বেনার নিউজকে বললেন, “কোনও মহিলা জিন্স-টপ অথবা সালোয়ার-কুর্তা পরে মন্দিরে এলে কোনও সমস্যা নেই। আপত্তি শুধু শরীর অনাবৃত রাখা পোশাকেই।”

এমন বিচিত্র নিয়ম কেন? মন্দিরের চিফ এক্সিকিউটিভ অফিসার এম পি সিংহ সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তরে বলেন, “আমরা চাই বিদেশিরা ভারতের সনাতন বৈদিক সংস্কৃতির সঙ্গে পরিচিত হোক। আমরাও তো ধুতি পরে মন্দিরে যাই, পূজার সময় কপালে চন্দনের তিলক কাটি। কিন্তু চার্চে যাওয়ার সময় কি তেমন পোশাক পরি?”


প্রতিক্রিয়া

ইতিহাসবিদ শ্যামল সেনগুপ্ত অবশ্য বৈদিক সংস্কৃতির দোহাই মানতে নারাজ। বললেন, “বৈদিক যুগে মহিলারা তো ঊর্ধ্বাঙ্গ অনাবৃতও রাখতেন। সেখানে শাড়ির কোনও উল্লেখই নেই। এটা আসলে একটা নতুন আগ্রাসী হিন্দুত্ববাদ।”

দিল্লির শিব নাদার ইউনিভার্সিটির সমাজতত্ত্বের গবেষক শ্রীদীপ ভট্টাচার্য বললেন, “সাম্প্রতিক ভারতে সচেতন ভাবে যে হিন্দু্ত্ববাদী পরিমণ্ডল তৈরি করা হচ্ছে, এই ঘোষণাগুলো তারই অংশ। সেই হিন্দুত্ববাদ নিতান্তই উচ্চবর্ণের, এবং পুরুষতন্ত্রের। ফলে, মহিলাদের নিয়ে যাবতীয় অন্যায় বাধানিষেধ তৈরি হচ্ছে। মহিলাদের শরীর নিয়ে পুরুষতন্ত্রের অস্বস্তির শেষ নেই। হাত-পা দেখা দেলেও সমস্যা,  পিরিয়ড নিয়েও সমস্যা।”

নারীবাদী আন্দোলনের পরিচিত মুখ বোলান গঙ্গোপাধ্যায় বললেন, “মেয়েদের পিরিয়ড নিয়ে সমাজের মানসিকতা বদলানো যে কতটা জরুরি, সাবরীমালার উদাহরণ সেটা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছে। যেটা একেবারে স্বাভাবিক একটা ঘটনা, আমাদের সমাজে সেটা নিয়েও অস্বস্তির অন্ত নেই। পুরুষতন্ত্র আসলে নারীকে ছোট করে দেখতেই শিখিয়েছে। ফলে, যেটা তাদের স্বাভাবিক শারীরবৃত্তীয় প্রক্রিয়া,  পুরুষতন্ত্র তাকেও অস্বাভাবিক এবং ঘৃণ্য বোধ করে। এই ঘৃণা আসলে নারীর প্রতি।”

ভারতের দুই তীর্থ প্রশ্ন তুলে দিল, আর কবে এই দেশ মহিলাদের স্বাভাবিক চোখে দেখতে শিখবে?  গোটা দেশের বিদ্বৎমহল সেই প্রশ্নের উত্তর খুঁজছে।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।