কলকাতায় মহিলা ট্রেনে পুরুষ, মহিলা যাত্রীদের বিক্ষোভ
2015.08.19
প্রকাশ্য দিবালোকে সর্বসমক্ষে পুরুষ ও মহিলাদের সম্মুখ সমরের সাক্ষী থাকল পশ্চিমবঙ্গ। টানা তিন দিন। সোমবার ১৭ অগস্ট খড়দহে যে যুদ্ধের সূচনা, বুধবার তা ছড়িয়ে পড়ল বামনঘাটা থেকে বিরাটি অবধি কলকাতার শহরতলির বিস্তীর্ণ অঞ্চল জুড়ে।
অশান্তির সূত্রপাত একটি লোকাল ট্রেনকে ঘিরে। পশ্চিমবঙ্গের বর্তমান মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যখন কেন্দ্রীয় রেলমন্ত্রী ছিলেন, তখন তিনি মাতৃভূমি লোকাল নামে শিয়ালদহ-র বিভিন্ন শাখায় কয়েকটি ট্রেন চালু করেন। ট্রেনগুলি মহিলাদের জন্য সংরক্ষিত। রেলসূত্রে জানা গিয়েছে, ট্রেনগুলি নিয়মিত চললেও তাতে যথেষ্ট যাত্রী হচ্ছিল না। অন্য দিকে, একই সময়ে একই শাখায় চলা সাধারণ লোকাল ট্রেনগুলিতে যাত্রীর ভিড় উপচে পড়ছিল। সেই কারণেই পূর্ব রেল কর্তৃপক্ষ সিদ্ধান্ত করে, ১৭ অগস্ট থেকে মাতৃভূমি লোকালের কয়েকটি নির্দিষ্ট কামরায় পুরুষদেরও প্রবেশাধিকার দেওয়া হবে।
এই সিদ্ধান্ত ঘিরেই অশান্তি। সোমবার রানাঘাট-শিয়ালদহ মাতৃভূমি লোকালের নির্দিষ্ট কামরায় পুরুষ যাত্রীরাও সওয়ার হন। ট্রেন প্রায় ৫৫ কিলোমিটার চলার পর খড়দহ স্টেশনে পৌঁছোলে হঠাৎই কিছু মহিলা যাত্রী বিক্ষোভ দেখাতে শুরু করেন। মহিলাদের জন্য নির্দিষ্ট ট্রেনে পুরুষদের উঠতে দেওয়া যাবে না, এই দাবিতে তাঁরা রেল অবরোধ করেন।
অফিস টাইমে ট্রেন বন্ধ হয়ে যাওয়ায় উত্তেজনার পারদ চড়তে থাকে। প্রথমে বাকবিতণ্ডা, এবং পরে হাতাহাতি আরম্ভ হয়। পুলিশ এসে অবরোধ তোলার চেষ্টা করায় শুরু হয় ইঁটবৃষ্টি। পুলিশ ও যাত্রী মিলিয়ে বেশ কয়েক জন জখম হন। শেষ পর্যন্ত পুলিশ লাঠি চার্জ করে এবং কাঁদানে গ্যাস ছুড়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে। মহিলাসহ মোট ১০ জন গ্রেফতার হন।
খড়দহ স্টেশনেই আটকে পড়েছিলেন নৈহাটির শ্যামল সরকার। তিনি জানান, মহিলারাই প্রথমে কটূক্তি আরম্ভ করেন। সবারই দেরি হচ্ছিল, ফলে সবাই উত্তেজিত ছিলেন। কাজেই, অশান্তি দীর্ঘতর হয়। একই ট্রেনে আটকে পড়া অন্বেষা রায় অবশ্য বললেন, যেহেতু মহিলাদের নিরাপত্তা লঙ্ঘন করা সহজ, অতএব নিত্যযাত্রী পুরুষরা কার্যত বিনা প্ররোচনাতেই সেই পথে হেঁটেছেন।
এই ঘটনার প্রেক্ষিতে পূর্ব রেল কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, আপাতত রানাঘাট শাখার মাতৃভূমি লোকালে পুরুষদের প্রবেশাধিকার থাকছে না। কিন্তু, অন্য শাখায় থাকছে। এই ঘোষণার পরেই ক্ষোভ জমতে থাকে অন্যান্য শাখাতেও। মঙ্গলবার বিভিন্ন শাখায় রেল অবরোধ হয়। অশান্তি চরমে পৌঁছোয় বুধবার, যখন বনগাঁ শাখার মাতৃভূমি লোকালে পুরুষদের প্রবেশের বিরুদ্ধে মহিলা যাত্রীরা বামনঘাটা স্টেশনে রেল অবরোধ করেন। অভিযোগ উঠেছে, পুরুষরা একেবারে বিনা প্ররোচনাতেই পাথর ছুঁড়তে আরম্ভ করেন। মহিলাদের প্রতি কটূক্তি, জামাকাপড় ধরে টানাটানি, বাদ যায়নি কিছুই।
বামনঘাটার অবরোধ এবং অশান্তির খবর ছড়িয়ে পড়তেই অবরোধ আরম্ভ হয় দত্তপুকুর থেকে বারাসত, মধ্যমগ্রাম থেকে বিরাটি, সমস্ত স্টেশনেই। তার মধ্যে বিরাটিতে মহিলা কামরায় উঠে কয়েক জন যুবক কিছু মহিলা যাত্রীর শ্লীলতাহানির চেষ্টা করে বলে জিআরপি-র কাছে অভিযোগ দায়ের করা হয়। ছিনতাইয়ের ঘটনাও ঘটেছে বলে অভিযোগ।
বারাসত শাখার নিত্যযাত্রী পিয়াসা চক্রবর্তী বললেন, পুরুষরা অপ্রত্যাশিত রকম মারমুখী ছিলেন। তাঁরা কোনও আলোচনাতেই আসতে রাজি ছিলেন না। বরং, মহিলাদের হেনস্থা করার দিকেই তাঁদের নজর ছিল। মধ্যমগ্রামের বাসিন্দা, নিত্যযাত্রী সায়ন ঘোষ আবার উল্টো কথা বললেন। তাঁর মতে, মহিলারা অভিযোগ করলে তা যেহেতু বাড়তি গুরুত্ব পায়, তাঁরা সেই সুবিধাটাই নিয়েছেন। সায়ন বললেন, এক মহিলা বিনা প্ররোচনায় এক জন পুরুষের গালে থাপ্পড় কষিয়েছেন, এমন ঘটনাও আজ ঘটেছে।
সমাজতত্ত্ববিদ অনন্যা চট্টোপাধ্যায় বললেন, এই অশান্তির শিকড় অনেক গভীরে। বাড়ির বাইরের পরিসরে মেয়েদের সমান উপস্থিতি মেনে নিতে অনেক পুরুষ আজও স্বচ্ছন্দ নন। তাঁরা মনে করেন, এটা তাঁদের এলাকায় মহিলাদের অন্যায় অনুপ্রবেশ। পুরুষতন্ত্র তাঁদের শিখিয়েছে, মেয়েরা তাঁদের তুলনায় নিকৃষ্ট। ফলে, যে কোনও ঘটনাকে কেন্দ্র করেই তাঁদের ভিতরের তীব্র মহিলাবিদ্বেষ প্রকাশ পায়। সোমবার থেকে কলকাতার শহরতলি জুড়ে যা ঘটছে, তা এই বিদ্বেষেরই ফল।
পূর্ব রেলের মুখ্য জনসংযোগ আধিকারিক রবি মহাপাত্র জানিয়েছেন, মহিলা স্পেশাল ট্রেনে পুরুষদের প্রবেশাধিকার নিয়ে মহিলা যাত্রীদের যদি কোনও অভিযোগ থাকে, রেল অবশ্যই তা গুরুত্ব সহকারে শুনবে, এবং খতিয়ে দেখবে। কিন্তু এ বিষয়ে কোনও অবরোধ মেনে নেওয়ার প্রশ্নই নেই।
এই অশান্তির জেরে আরও কত দিন অফিস টাইমে রেল পরিষেবা ব্যাহত হবে, আশঙ্কায় রয়েছেন নিত্যযাত্রীরা।