মহিলাদের বিরুদ্ধে গার্হস্থ্য হিংসায় পশ্চিমবঙ্গ প্রথম স্থানে
2015.12.01
পর পর সাত বছর গোটা দেশে এক নম্বর স্থানে থাকল পশ্চিমবঙ্গ।
তবে, তাতে গর্বিত হওয়ার বিন্দুমাত্র কারণ নেই। ২০০৮ থেকে ২০১৪ অবধি টানা সাত বছর গোটা দেশে মহিলাদের বিরুদ্ধে পারিবারিক হিংসার ঘটনার সংখ্যায় পশ্চিমবঙ্গ এক নম্বরে। ২০০৬ এবং ২০০৭ সালে এই রাজ্য দ্বিতীয় স্থানে ছিল। শীর্ষ স্থানটি দখল করেছিল সাবেক অন্ধ্র প্রদেশ।
ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ডস ব্যুরোর পরিসংখ্যান থেকে এই তথ্য পাওয়া গিয়েছে।
সম্প্রতি প্রকাশিত তথ্যে দেখা যাচ্ছে, ২০১৪ সালে গোটা দেশে মোট ১২২৮৭৭টি গার্হস্থ্য হিংসার অভিযোগ নথিভুক্ত হয়েছিল। তার মধ্যে ২৩২৭৮টি অভিযোগ নথিভুক্ত হয়েছিল এই পশ্চিমবঙ্গে। অর্থাৎ, দেশে নথিভুক্ত হওয়া প্রতি পাঁচটি অভিযোগের একটি পশ্চিমবঙ্গ থেকে এসেছে। ২০১৩ সালে দেশে মোট গার্হস্থ্য হিংসার অভিযোগ নথিভুক্ত হয়েছিল ১১৮৮৬৬টি, তার মধ্যে পশ্চিমবঙ্গে নথিভুক্ত অভিযোগের সংখ্যা ছিল ১৮১১৬। অর্থাৎ, অনুপাত ছিল ১৫.২৪ শতাংশ। হিসেব বলছে, ২০১৩ সালের তুলনায় ২০১৪ সালে পশ্চিমবঙ্গে গার্হস্থ্য হিংসার অভিযোগ বেড়েছে ২৮.৫ শতাংশ, আর গোটা দেশের মোট অভিযোগে পশ্চিমবঙ্গের অনুপাতের হার বেড়েছে প্রায় ২৪.৫ শতাংশ।
মহিলাদের বিরুদ্ধে গার্হস্থ্য হিংসার ঘটনা গোটা দেশেই বেড়েছে। ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ড ব্যুরোর পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০০১ সালে এই গোত্রের মোট ৪৯১৭০টি অভিযোগ নথিভুক্ত হয়েছিল। ২০১৪ সালে সংখ্যাটি বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১২২৮৭৭। সব ধরনের অপরাধের সংখ্যাই বেড়েছে। ২০০১ সালে মহিলাদের বিরুদ্ধে অপরাধের মোট পনেরো লক্ষ অভিযোগ নথিভুক্ত হয়েছিল। ২০১৪ সালে সংখ্যাটি বেড়ে দাঁড়িয়েছে প্রায় ৩৫ লক্ষে। মহিলাদের বিরুদ্ধে অপরাধের ঘটনা সবচেয়ে বেশি ঘটেছে উত্তর প্রদেশে, ধর্ষণের সংখ্যা সর্বাধিক ভারতের রাজধানী দিল্লিতে। পশ্চিমবঙ্গের মতোই পূর্ব ভারতের অন্য তিনটি রাজ্য অসম, বিহার ও ওড়িশাতেও মহিলাদের বিরুদ্ধে সংঘটিত অপরাধের সংখ্যা এবং হার বৃদ্ধি পাচ্ছে।
আরও আশঙ্কাজনক খবর, গোটা দেশে শিশু ধর্ষণের মতো ঘৃণ্য অপরাধের সংখ্যাও বাড়ছে দ্রুত হারে। ২০০৯ সালে এই সংখ্যাটি ছিল ৫৪৮৪। ২০১৪ সালে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১৩৭৬৬।
নারীর ওপর সহিংসতা বৃদ্ধির কারণ কি?
প্রশ্ন উঠছে, যে পশ্চিমবঙ্গ সামাজিক ভাবে ভারতের অন্যতম অগ্রসর রাজ্য হিসেবেই পরিচিত, সেখানে গার্হস্থ্য হিংসার সংখ্যা এমন উদ্বেগজনক রকম বেশি কেন?
কলকাতা পুলিশের প্রাক্তন অ্যাসিস্ট্যান্ট কমিশনার দীপক আইচ বললেন, “এই রাজ্যে মহিলাদের বিরুদ্ধে গার্হস্থ্য অপরাধের যত অভিযোগ নথিভুক্ত হচ্ছে, তা গোটা দেশের মধ্যে সর্বোচ্চ বটে, কিন্তু সেটা শুধু পশ্চিমবঙ্গের নেতিবাচক দিকটিকেই তুলে ধরে না। মনে রাখতে হবে, অপরাধ সংঘটিত হওয়া আর অপরাধ নথিভুক্ত হওয়ার মধ্যে মস্ত ফারাক রয়েছে। মহিলারা অভিযোগ নিয়ে পুলিশের কাছে আসছেন মানে এই রাজ্যে পুলিশ এবং প্রশাসন অপেক্ষাকৃত ভাবে অনেক বেশি সংবেদনশীল। বছর পনেরো আগেও বিহারে মহিলাদের বিরুদ্ধে সংঘটিত কোনও অপরাধের অভিযোগ থানায় জমা পড়ত না। নীতীশ কুমারের মুখ্যমন্ত্রিত্বে ক্রমে অভিযোগ জমা পড়তে আরম্ভ করে। তার মানে তো এই নয় যে আগে মহিলাদের বিরুদ্ধে অপরাধ হত না। এতে বরং বোঝা যায়, আগের তুলনায় পুলিশ সংবেদনশীল হয়েছে।“
অর্থনীতিবিদ ও নারীবাদী তত্ত্বের গবেষক সীমন্তী বন্দ্যোপাধ্যায় এই যুক্তিটিকে অস্বীকার করলেন না। বললেন, “ভারতের হিন্দি বলয়ের তুলনায় পশ্চিমবঙ্গে পুলিশ বেশি সংবেদনশীল, অস্বীকার করার উপায় নেই। কিন্তু প্রথমত, মহিলাদের বিরুদ্ধে গার্হস্থ্য হিংসার যত ঘটনা এই রাজ্যে নথিভুক্ত হয়েছে, সেই সংখ্যাটি বিপুল, এবং দ্বিতীয়ত, যত অপরাধ হয়, পশ্চিমবঙ্গেও তার সামান্যই শেষ অবধি নথিভুক্ত হয়। মনে রাখতে হবে, এই রাজ্য কিন্তু চিরাচরিত ভাবে মহিলাদের প্রতি সদয় নয়। কন্যাভ্রূণ হত্যাই হোক বা বিধবাদের সহায়সম্বলহীন অবস্থায় বৃন্দাবনে পাঠিয়ে দেওয়া, পশ্চিমবঙ্গ কিন্তু দেশে প্রথম স্থানে রয়েছে। এটা পিতৃতন্ত্রের গভীর অসুখ। সহজে সারার নয়।”
আরও একটি ক্ষেত্রে পশ্চিমবঙ্গ দেশে প্রথম স্থানে রয়েছে। নারী পাচার। ২০১৪ সালে দেশে দেহব্যবসার জন্য মেয়ে বিক্রির মোট ৮২টি অভিযোগ নথিভুক্ত হয়েছিল। তার মধ্যে ৬৮টি ঘটনাই পশ্চিমবঙ্গের। সুন্দরবনের সন্দেশখালি অঞ্চলে নারীপাচার বিরোধী আন্দোলনের কর্মী সুপর্ণা মাইতি বললেন, “আর্থিক অভাব এমনই তীব্র যে অনেক পরিবার কার্যত জেনেবুঝেই মেয়েকে পাচার হয়ে যেতে দেয়। যত ক্ষণ না এই অঞ্চলে অর্থনৈতিক উন্নয়ন হচ্ছে, তত ক্ষণ ভারতীয় সুন্দরবন ভারতের নারীপাচার রাজধানীই থাকবে।”
কোন পথে সমাধান?
সমাধানের পথ কী? রাজ্য প্রশাসনের এক অভিজ্ঞ আমলা, বিভিন্ন জেলায় কাজ করার অভিজ্ঞতার ঝুলি উপুড় করলেন, কিন্তু নাম গোপন রাখার শর্তে। বললেন, “প্রথম কাজ হল দুষ্কৃতীদের ওপর থেকে রাজনৈতিক ছত্রছায়া সরিয়ে নেওয়া। শাসক দলের ছাতার তলায় থাকলেই যা খুশি করে পার পাওয়া যায়, এই বিশ্বাসটি ভয়ানক ক্ষতিকর। দ্বিতীয় কাজ, মেয়েদের মধ্যে প্রচার চালানো, তাদের লেখাপড়া এবং হাতের কাজ শিখিয়ে স্বাবলম্বী করে তোলা, যাতে পরিবারের কারও বিরুদ্ধে পুলিশে অভিযোগ জানানোর সময় তাদের ভাবতে না হয় যে কাল থেকে কী খাব। তৃতীয় কাজ, রাজ্যের মহিলা কমিশনকে শক্তিশালী করা। ওই রকম গুরুত্বপূর্ণ একটি প্রতিষ্ঠান এখন শাসক দলের স্বজনপোষণের আখড়ায় পরিণত হয়েছে। এটা বন্ধ করতে হবে।”
পশ্চিমবঙ্গের পক্ষে কি সম্ভব হবে পরিবর্তনের পথে হাঁটা? না কি, যে রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী স্বয়ং এক জন মহিলা, সেই রাজ্যে মহিলাদের বিরুদ্ধে অপরাধের সংখ্যায় গোটা দেশে এক নম্বর স্থানে থাকার লজ্জা চিরস্থায়ী হবে?