চাঞ্চল্যকর ইন্দ্রাণী কাহিনী, ভারতীয় মিডিয়ায় তোলপাড়
2015.08.28
ছোট শহরের উচ্চাকাঙ্ক্ষী তরুণীর পৌঁছে যাওয়া স্বপ্নের রাজধানী মুম্বাইয়ে। দেশের টেলিভিশন দুনিয়ার অন্যতম প্রধান পুরুষের সঙ্গে বিয়ে— তরুণীর তিন নম্বর বিয়ে, তা-ও প্রথম পক্ষের বিয়ের কথা সম্পূর্ণ গোপন করে। প্রথম বিয়ের সন্তানদের নিজের ভাই-বোন হিসেবে দেখানো। তার পর, প্রথম পক্ষের মেয়েকে দ্বিতীয় পক্ষের স্বামীর সাহায্য নিয়ে খুন।
টাকা। ব্ল্যাকমেল। ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের মধ্যে অবৈধ যৌনতা। সবই রয়েছে এই আখ্যানে। যে কোনও সোপ অপেরার গল্পকেও হার মানাবে ইন্দ্রাণী মুখার্জী ওরফে পরির গল্প। যে গল্পের প্রত্যেকটা মুহূর্ত নিয়ে এখন মজে আছে গোটা ভারত। তবে, ইন্টারটেনমেন্ট চ্যানেলে নয়, ভারতের নিউজ চ্যানেলের প্রাইম টাইম আর সংবাদপত্রের প্রথম পাতা দখল করে আছে এই গল্প।
দ্বিতীয় স্বামীর সাহায্যে প্রথম পক্ষের কন্যাকে খুন
গল্পের মুল চরিত্র ইন্দ্রাণী মুখোপাধ্যায়। ইন্দ্রাণী নিজের প্রথম বিয়ের সন্তান শিনা বোরাকে খুন করেন ২০১২ সালে। তার পর, দ্বিতীয় পক্ষের স্বামী সঞ্জীব খন্নার সহায়তায় মহারাষ্ট্রের রায়গড় জেলায় এক নির্জন এলাকায় পেট্রোল ঢেলে সেই মৃতদেহ পুড়িয়ে দেন। তার পর বলেন, শিনা আমেরিকা চলে গিয়েছে লেখাপড়া করতে।
সেই মিথ্যেটাকেই বিভিন্ন কৌশলে সত্য প্রতিপন্ন করেন পরের তিন বছর ধরে। আগস্টের একুশ তারিখ তার গাড়ির চালক শ্যাম মনোহর রাইকে পুলিশ গ্রেফতার করে এক অন্য মামলায়। জেরার সময় সে এই পুরনো খুনের কথা উল্লেখ করে। সেই সূত্র ধরেই পুলিশ গত মঙ্গলবার গ্রেফতার করল ইন্দ্রাণীকে এবং তৃতীয় স্বামী স্টার টিভির প্রাক্তন সিইও পিটার মুখার্জীকে।
তখনও অবধি অবশ্য সবাই জানত, শিনা ইন্দ্রাণীর বোন। প্রথমে ভাবা হয়েছিল, সম্পত্তি সংক্রান্ত সমস্যাতেই বুঝি এই খুন, যেমনটা হয়ে থাকে। কিন্তু, তখনও বিস্ময় বাকি ছিল। ইন্দ্রাণী স্বীকার করলেন, শিনা আসলে তাঁর মেয়ে। এত দিন সবার কাছে মেয়েকেই বোন হিসেবে পরিচয় দিতেন তিনি। এমনকী, মেয়ের বার্থ সার্টিফিকেট বদলে সেখানে তার মা-বাবা হিসেবে নিজের মা-বাবার নামও নথিভুক্ত করান ইন্দ্রাণী।
কেন? সেই রহস্যের কেন্দ্রে পৌঁছোতে গেলে আগে ইন্দ্রাণী মুখোপাধ্যায়কে চিনতে হবে।
বয়েস পঞ্চাশের কাছাকাছি। দেখতে আকর্ষণীয়, এবং ঘনিষ্ঠ জনদের মতে, ক্ষমতাবান পুরুষদের নিজের প্রতি আকৃষ্ট করায় সিদ্ধহস্ত ইন্দ্রাণী। ২০০২ সালে তেমন ভাবেই আলাপ পিটার মুখার্জীর সঙ্গে। পিটার তখন স্টার টিভির সিইও। অত্যন্ত ক্ষমতাবান ও প্রভাবশালী। দম্পতির ঘনিষ্ঠ বন্ধু, ভারতের রাজনৈতিক ও বাণিজ্যিক ক্ষমতামহলের অতি পরিচিত মুখ সুহেল শেঠ জানালেন, আলাপের অতি অল্প দিনের মধ্যেই তাঁরা বিয়ের সিদ্ধান্ত নেন।
এবং, বিয়ের পরেই বদলে যান ইন্দ্রাণী। সাদামাটা ছোট শহরের মেয়ে থেকে হয়ে ওঠেন মুম্বইয়ের বিজনেস ম্যাগনেট। বদলে যায় তাঁর মেলামেশার দুনিয়াও। শুধু বদলায়নি তাঁর প্রতি পিটার মুখোপাধ্যায়ের প্রেম। সুহেল শেঠ বললেন, ‘এ রকম গভীর ভালবাসা খুব কমই দেখেছি।’
ছেলেমেয়েকে ‘ভাইবোন’ পরিচয় দিয়ে চলতেন
সেই ভালবাসার কি দাম দিয়েছিলেন ইন্দ্রাণী? সঞ্জীব খন্নার সঙ্গে নিজের বিয়ের কথা গোপন করেননি। সেই বিয়ের সন্তান, মেয়ে বিধিকে দত্তকও নেন পিটার, যাতে সে আইনত পিটারের পরিবারের অংশ হতে পারে। কিন্তু প্রথম বিয়ের কথা উল্লেখও করেননি। সেই বিয়ের দুই সন্তান মেয়ে শিনা ও ছেলে মিখাইলকে যখন মুম্বই নিয়ে আসেন ইন্দ্রাণী, তখন তাদের নিজের ভাই-বোন হিসেবেই পরিচয় করিয়ে দেন।
এমন বিচিত্র ব্যবস্থায় ছেলেমেয়েরা রাজি হয়েছিলেন কেন? ছেলে মিখাইল জানিয়েছেন, তাঁদের জন্মের পর থেকে (শিনার জন্ম ১৯৮৯ সালে, মিখাইলের তার এক বছর পর, ১৯৯০-এ) তাঁরা কখনও মা-কে দেখেননি। দাদু-দিদিমার কাছেই মানুষ তাঁরা।
২০০২ সালে তাঁরা খবরের কাগজে পিটারের সঙ্গে ইন্দ্রাণীর বিয়ের খবর দেখে তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ করেন। তখন ইন্দ্রাণী গুয়াহাটিতে আসেন। সেই প্রথম তাঁদের মায়ের সঙ্গে দেখা। ইন্দ্রাণী জানান, ছেলেমেয়ের আর্থিক দায়িত্ব, পড়াশোনার দায়িত্ব নিতে তিনি রাজি। কিন্তু শর্ত, তারা বলতে পারবে না যে ইন্দ্রাণী তাঁদের মা। ভাইবোন হিসেবে পরিচয় দিয়েই থাকতে হবে। দুই ভাইবোন সেই শর্তে রাজি হয়ে যান, কারণ, মিখাইলের বয়ান অনুযায়ী, তখন তাদের টাকার প্রয়োজন ছিল।
রাহুলের সাথে শিনার সম্পর্ক গড়ে ওঠে
দুই ভাইবোন মুম্বাই চলে আসেন। মিখাইল কিছু দিন পরে গুয়াহাটি ফিরে যান, কিন্তু থেকে যান শিনা। মুম্বইয়ের সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজে ভর্তি হন। মা (অবশ্য প্রকাশ্য পরিচয়ে দিদি) ইন্দ্রাণীর সঙ্গে তাঁর অশান্তি লেগেই থাকে।
আলাদা ফ্ল্যাট নিয়ে বাস করতে থাকেন তিনি। এই সময়ই তাঁর সঙ্গে সম্পর্ক তৈরি হয় রাহুল মুখার্জীর। রাহুল পিটারের প্রথম পক্ষের সন্তান। সেই সম্পর্ক নিয়ে তীব্র আপত্তি ছিল ইন্দ্রাণীর। তিনি পিটারকে জানান, বোনের সঙ্গে রাহুলের এই সম্পর্ক মেনে নিতে রাজি নন তাঁর বাবা-মা। ২০১২ সালের এপ্রিলে ইন্দ্রাণী জানান, তিনি শিনাকে আমেরিকা পাঠিয়ে দিচ্ছেন। আপত্তি করেননি পিটার।
২০১২ সালের ২৪ এপ্রিলই শিনাকে বিদায় জানান ইন্দ্রাণী। অবশ্য আমেরিকার উদ্দেশ্যে নয়, তিনি শিনাকে মৃত্যুর পথে পাঠিয়ে দেন। সেই কাজে তাঁর সঙ্গে যোগ দেন তাঁর দ্বিতীয় স্বামী সঞ্জীব খন্না। কলকাতার বাসিন্দা সঞ্জীবকে পুলিশ গ্রেফতার করেছে, এবং তাঁকে মুম্বাই নিয়ে যাওয়া হয়েছে। জেরার মুখে সঞ্জীব স্বীকার করেছেন এই হত্যাকাণ্ডে তাঁর জড়িত থাকার কথা।
তবে গাড়িচালক, সঞ্জীব এবং ইন্দ্রাণীর বয়ানে অনেক অমিল বলে জানিয়েছে পুলিশসূত্র।অবশ্য, তাঁরা যে মুম্বাই থেকে রায়গড় গিয়ে সেখানে শিনার মৃতদেহে পেট্রোল ঢেলে জ্বালিয়ে তার পর সেই দেহ গোপন জায়গায় ফেলে আসেন, তার প্রমাণ মিলেছে। পুলিশ মৃতদেহের অংশাবশেষ উদ্ধার করেছে।
প্রাক্তন দ্বিতীয় স্বামীর সাথে যোগাযোগ থেকে যায়
এই ঘটনায় কী ভাবে জড়িয়ে গেলেন ইন্দ্রাণীর প্রাক্তন স্বামী সঞ্জীব? তিনি জানিয়েছেন, বিবাহবিচ্ছিন্ন হলেও তাঁদের মধ্যে যোগাযোগ ছিল। মেয়ে বিধিকে দেখার জন্যই তিনি মাঝেমধ্যে মুম্বাই যেতেন। সঞ্জীব জানিয়েছেন, ইন্দ্রাণীর সঙ্গে ইদানীং তাঁর ঘনিষ্ঠতা বাড়ছিল। তাঁর কাছে ফিরে আসার ইচ্ছাও নাকি প্রকাশ করেছিলেন ইন্দ্রাণী।
জানা গিয়েছে, দু’জনের মধ্যে কিছু ব্যবসায়িক লেনদেনও সম্ভবত ছিল। কিন্তু কেন শিনাকে খুন করার চক্রান্তে জড়িয়ে পড়লেন তিনি, এখনও পুলিশ সেই উত্তর খুঁজছে।
ইন্দ্রাণীর বর্তমান স্বামী পিটার মুখোপাধ্যায় কতটা জানতেন? পিটার গোড়ায় দাবি করেন, শিনা যে ইন্দ্রাণীর বোন নন, কন্যা— সে বিষয়ে তিনি সম্পূর্ণ অন্ধকারে ছিলেন। দাবি করেন, তাঁর স্ত্রী তাঁকে ঠকিয়েছেন। সেই দাবি অবশ্য ধোপে টিকছে না। প্রথমে জানা গেল, রাহুল নাকি নিজের বাবাকে শিনার প্রকৃত পরিচয় জানিয়েছিলেন। তার পরের খবর, শিনা নিজেও কথা বলেন পিটারের সঙ্গে, নিজের আসল পরিচয় প্রকাশ করেন।
সব শেষে প্রকাশিত হল যে পিটার সম্ভবত ২০০২ সাল থেকেই সব কথা জানতেন। পিটারের সঙ্গে বিয়ের খবর পেয়ে ইন্দ্রাণীর মা-বাবা তাঁকে যে চিঠি লেখেন, পিটার সেই চিঠি পড়েছিলেন বলেই জানিয়েছেন নামপ্রকাশে অনিচ্ছুক ইন্দ্রাণীর এক ঘনিষ্ঠ আত্মীয়। পুলিশ সূত্রে খবর, সব দিকই তদন্ত করে দেখা হচ্ছে।
মুখ খুলতে শুরু করেছে ছেলে মিখাইল
মা হয়েও কেন সন্তানকে খুন করলেন ইন্দ্রাণী? ছেলে মিখাইল বললেন, ‘আমার মায়ের পক্ষে কিছুই অসম্ভব নয়। আমার কাছে অনেক প্রমাণ আছে। সময় হলে সব পুলিশের হাতে তুলে দেব।’ মুম্বই পুলিশের এক উচ্চপদস্থ কর্তা জানালেন, সম্ভাবনা অনেকগুলো।
এক, শিনা হয়তো ইন্দ্রাণীকে ব্ল্যাকমেল করছিলেন। দুই, ইন্দ্রাণী চাননি যে রাহুলের সঙ্গে শিনার কোনও বৈবাহিক সম্পর্ক হোক, কারণ সম্পর্কে তারা ভাইবোন। তিন, হয়তো শিনার সঙ্গে ইন্দ্রাণীর কোনও ঘনিষ্ঠ পুরুষের গোপন যৌন সম্পর্ক গড়ে উঠছিল। পুলিশের অনুমান, খুন হওয়ার সময় শিনা কয়েক মাসের অন্তঃস্বত্বা ছিলেন। সেই পুরুষটি স্বয়ং পিটারও হতে পারেন, এমন সন্দেহও উড়িয়ে দিচ্ছে না মুম্বই পুলিশ।
অনেক প্রশ্নের উত্তর জানা বাকি
প্রশ্ন উঠছে, তিন বছর ধরে শিনার তরফ থেকে কোনও সাড়াশব্দ না পেয়েও কেন চুপচাপ ছিলেন মিখাইল এবং তাঁর দাদু-দিদিমা? কেন তাঁরা পুলিশে অভিযোগ জানাননি? মুম্বাই পুলিশের এক সূত্র জানালেন, এর পিছনেও হয়তো টাকার খেলা থাকা বিচিত্র নয়। ইন্দ্রাণীর বাবা উপেন্দ্র কুমার বোরা এই অভিযোগ অস্বীকার করলেও জানিয়েছেন, শিনা তাঁর মেয়ে নয়, নাতনি— কিন্তু তার নথিপত্রে যে বাবা হিসেবে তাঁরই নাম ছিল, সে কথা তিনি জানতেন।
আজ মুম্বাই পুলিশের অভিজ্ঞ অফিসাররা দফায় দফায় জেরা করেন ইন্দ্রাণীকে। কিন্তু তাঁরা বলছেন, তাঁদেরও ঘোল খাইয়ে ছাড়ছেন ইন্দ্রাণী। এখনও অবধি কোনও বেফাঁস কথা বলেননি তিনি। সব প্রশ্নের মাপা জবাব দিচ্ছেন। তবে, তাঁর থেকে যে আরও অনেক কথা বেরোবে, পুলিশ অফিসাররা নিশ্চিত।
রহস্যের জাল ঘনীভূত। অনুমান, এখনও অনেক তথ্য প্রকাশ্যে আসার অপেক্ষায়, আলমারি থেকে আরও অনেক কঙ্কাল বেরোবে।