একের পর এক জঙ্গি হামলায় অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব পড়ার আশংকা
2016.07.08
ঢাকার গুলশান হত্যাকাণ্ডের পর কিশোরগঞ্জের শোলাকিয়ার ঈদগাহ ময়দান—এক সপ্তাহের মধ্যে পৃথক দুটি জঙ্গি হামলায় প্রাণ দিলেন চার পুলিশসহ ৩২ জন দেশি-বিদেশি নাগরিক। একের পর এক এসব নৃশংস হামলার ঘটনা দেশের অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে মনে করছেন বিশ্লেষকেরা।
এই পরিস্থিতিতে বিনিয়োগ, রপ্তানি ও পর্যটন খাত স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে বলে আশংকা করা হচ্ছে।
মেট্রোরেল প্রকল্পের সমীক্ষকসহ গুলশান হামলায় সাত জাপানি নিহত হওয়ার পরে বাংলাদেশ থেকে জাপানের উন্নয়ন সংস্থা জাইকা’র চলে যাওয়া নিয়ে গুঞ্জন ওঠে। তবে বাংলাদেশের পাশে থাকার প্রতিশ্রুতি দেওয়ায় বেশ স্বস্তিতে রয়েছে সরকার।
বিশ্লেষকেরা বলছেন, নিরাপত্তা পরিস্থিতির উন্নতি না হলে এমন প্রতিশ্রুতিও আর থাকবে না।
গত ১ জুলাই গুলশানের হলি আর্টিজান ক্যাফেতে হামলার ঘটনায় ১৭ জন বিদেশি নিহত হন। তাঁদের একজন ভারতের, নয়জন ইতালির এবং সাতজন জাপানের নাগরিক।
এ ছাড়া মুসলমানদের সবচেয়ে বড় ধর্মীয় উৎসব ঈদুল ফিতরের দিনেও হামলায় দুই পুলিশ, এক নারী নিহত হন এবং ঘটনাস্থলে এক হামলাকারীও মারা।
প্রভাব পড়তে পারে বিনিয়োগ, রপ্তানি ও পর্যটনে
অর্থনীতিবিদদের মতে, এ ধরনের জঙ্গি হামলার ঘটনা ক্রমাগত ঘটতে থাকলে নিরাপত্তা শঙ্কা থেকে বাংলাদেশ ছাড়তে পারেন বিদেশিরা। ফলে বিনিয়োগ, রপ্তানি আয়, পর্যটনসহ সার্বিক অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে।
এ ধরনের ঘটনার ভার বহনের শক্তি বাংলাদেশের খুব বেশি নেই জানিয়ে বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) অতিরিক্ত গবেষক ড. খোন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বেনারকে বলেন, “এমন ঘটনা অর্থনীতিতে মারাত্মক প্রভাব ফেলতে পারে। বিশেষ করে বিনিয়োগ, রপ্তানি আয় ও পর্যটনের দিক থেকে।”
তাঁর মতে, “বর্তমান পরিস্থিতির উন্নতি দৃশ্যমান না হলে দেশি–বিদেশি উদ্যোক্তা, বিশেষ করে নতুন বিদেশি উদ্যোক্তারা পিছপা হবেন। ফলে বিনিয়েোগের ক্ষেত্রে নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে, যা ভবিষ্যৎ রপ্তানির গতি শ্লথ করবে।”
এই পরিস্থিতিতে বিদেশি বিনিয়োগকারীদের উৎসাহ দেওয়ার জন্য প্রতিষ্ঠিত অর্থনৈতিক অঞ্চলেও বিনিয়োগ আকর্ষণ করা কষ্টকর হবে বলে মনে করেন তিনি।
পর্যটন শিল্পের কথা উল্লেখ করে এই অর্থনীতিবিদ বলেন, “বিভিন্ন বড় বড় প্রকল্পের কারণে প্রচুর বিদেশিরা বাংলাদেশে আসছেন। এর সঙ্গে মিলিয়ে পর্যটনের যতটুকু সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়েছে, তাও হ্রাস পেতে পারে।”
এ প্রসঙ্গে বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বেনারকে বলেন, “এসব ঘটনায় দেশের ভাবমূর্তি ক্ষুন্ন হচ্ছে। এতে করে রপ্তানি ব্যহত হতে পারে, বিনিয়োগকারীরা ফিরে যেতে পারে।”
পরিস্থিতি মোকাবেলার ওপর নির্ভর করছে
তবে অর্থনীতিবিদরা এটাও বলছেন, স্বল্প কিংবা দীর্ঘমেয়াদী প্রভাব নির্ভর করছে পরিস্থিতি মোকাবেলার উপর।
এ পরিস্থিতিতে জাইকা পাশে থাকার ঘোষণা ইতিবাচক এবং আশাব্যঞ্জক উল্লেখ করে ড. মোয়াজ্জেম বলেন, “জাইকা পাশে থাকার পাশাপাশি নিরাপত্তাকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিচ্ছে। তাঁরা মনে করছে, বাংলাদেশে কাজ করা মানে ঝুঁকির মধ্যেই কাজ করা। অর্থাৎ ঝুঁকির বিবেচনায় বাংলাদেশ একটি ঝঁকিপূর্ণ স্থান হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। ফলে বাংলাদেশের নিরাপত্তা পরিস্থিতি উন্নয়ন না হলে, এমন ঘটনা বারবার ঘটলে এ ধরনের প্রতিশ্রুতি পাওয়ার সম্ভাবনা কমতে পারে।”
অর্থনীতবিদ ও বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্ণর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বেনারকে বলেন, “অর্থনীতিতে তাৎক্ষণিক প্রভাব হয়ত পড়বে না। তবে বিদেশিরা পরিস্থিতির উন্নতি ঘটে কিনা, জঙ্গিবাদ মোকাবিলা করা সম্ভব কিনা, তা দেখতে আরও কিছুদিন অপেক্ষা করবে। যদি আগামী কয়েকমাসের মধ্যে হামলার ঘটনা না ঘটে তাহলে অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে না।”
নিরাপত্তাকে গুরুত্ব দিয়ে পাশে থাকবে জাইকা
স্বাধীনতার পর থেকে উন্নয়ন সহযোগী হিসেবে বাংলাদেশের পাশে রয়েছে জাপান। ২০১৫ সালে এ দেশে জাপানি বিনেয়োগের প্রবাহ ছিল ৮১ দশমিক ৮ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। এ ছাড়া গত বছরের ডিসেম্বর পর্যন্ত পুঞ্জিভূত জাপানি বিনিয়োগের পরিমাণ ছিল ৩৩২ দশমিক ৭ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ভারত ও ইতালিসহ বিভিন্ন দেশে বাংলাদেশে বড় অঙ্কের বিনিয়োগ করে থাকে।
গুলশান হামলার পরে বাংলাদেশ থেকে পরীক্ষিত বন্ধু জাপান চলে যাওয়ার শঙ্কা দেখা দিলেও তা কেটে গেছে। এ দেশের উন্নয়নে অবদান রাখতে সব সময় পাশে থাকবে বলে জানিয়েছে জাপানের উন্নয়ন সংস্থা জাইকা।গত বুধবার জাইকার প্রেসিডেন্টের পক্ষে এক বিবৃতিতে এ কথা জানানো হয়।
বিবৃতিতে জাইকার প্রেসিডেন্ট শিনিচি কিতাওকা বলেন, “জাইকা–সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের নিরাপত্তার বিষয়টি সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দেওয়া হবে। আমরা যেখানে কাজ করব, সেখানে পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে পরিস্থিতি মূল্যায়নের চেষ্টা থাকবে। বাংলাদেশের উন্নয়নে অবদান রাখতে দৃঢ়ভাবে সচেষ্ট থাকবে জাপান।”
তিনি বলেন, ঢাকা শহরের যানজট পরিস্থিতি উন্নয়নে একটি অবকাঠামো প্রকল্পের জরিপে অংশ নিতে জাইকার পক্ষ থেকে নিহত ওই আটজন জাপানি ঢাকায় এসেছিলেন। কিন্তু দুঃখের বিষয় হলো, বাংলাদেশের উন্নয়নে কঠোর পরিশ্রম করছিলেন যাঁরা, এই মর্মান্তিক ঘটনার শিকার হলেন তাঁরাই। জাইকা প্রেসিডেন্ট বলেন, “তাঁরা বেঁচে থাকলে আরও অনেক কিছু দিতে পারতেন।”
পাশে থাকবে বন্ধুরা
তবে এ হামলার ঘটনা দেশের অর্থনীতিতে খুব বেশি প্রভাব ফেলবে না বলে দাবি করছে সরকার।
এ বিষয়ে পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম বেনারকে বলেন, গুলশান হামলায় নাগরিকদের প্রাণহানি এবং সাম্প্রতিক জঙ্গিবাদের ঘটনা বাংলাদেশের সঙ্গে বন্ধুরাষ্ট্রগুলোর সম্পর্কে কোন বাধা সৃষ্টি করবে না।
তিনি বলেন, ঘটনার আকস্মিকতায় অনেকে হয়ত সাময়িকভাবে বিনিয়োগ বন্ধ করবে, অথবা পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করবে। তবে পরিস্থিতি সামলে নিয়ে আবারও ফিরবেন তাঁরা। কারণ ব্যবসা–বাণিজ্য ও বিনিয়োগের জন্য বাংলাদেশ একটি চমৎকার জায়গা।
বাংলাদেশ সরকার বিদেশিদের নিরাপত্তাকে সর্বোচ্চ গুরুত্বের সঙ্গে দেখছেন বলেও জানান পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী। তিনি বলেন, গত মঙ্গলবার সরকারের পক্ষ থেকে কুটনীতিকদের এ বিষয়ে আশ্বস্ত করা হয়েছে।