গণগ্রেপ্তারে আটক সাড়ে আট হাজার,জঙ্গিবাদ নির্মুল নিয়ে প্রশ্ন

ঢাকা থেকে শাহরিয়ার শরীফ
2016.06.13
160613-BD-police-roundup-620.jpg জঙ্গি দমনে বিশেষ অভিযান শুরুর পর হাজার হাজার আসামী ও সন্দেহভাজনকে গ্রেপ্তার করছে পুলিশ। জুন ১৩, ২০১৬।
এএফপি

পুলিশের জঙ্গিবিরোধী বিশেষ অভিযানের তৃতীয়দিন পর্যন্ত দেশব্যাপী  গ্রেপ্তার হয়েছেন সাড়ে আট হাজার মানুষ। এদের মধ্যে সন্দেহভাজন জঙ্গি মাত্র ১১৯ জন।  মানবাধিকার কর্মীরা বলছেন, এভাবে ঢালাও গ্রেপ্তার করে জঙ্গিবাদ নির্মুল করা সম্ভব নয়। এতে নিরীহদের হয়রানীর শঙ্কা থাকে। আর পুলিশ বলছে, সুনির্দিষ্ট তথ্য ছাড়া কাউকে গ্রেপ্তার করা হচ্ছে না।

গত বছর থেকে ১৮ মাসে ৪৬টি হামলায় ৪৮ জন খুন হয়েছেন। খুন হওয়া ব্যক্তিদের মধ্যে রয়েছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, লেখক, ব্লগার, সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানুষ,পুলিশ কর্মকর্তার স্ত্রী, পীর,আশ্রমের সেবক ইত্যাদি।

গত ৫ জুন সকালে চট্টগ্রামের জিইসি মোড়ে কুপিয়ে ও গুলি করে পুলিশ সুপার বাবুল আক্তারের স্ত্রী মাহমুদা খানম মিতুকে হত্যা করে জঙ্গিরা। বাবুল আক্তার জঙ্গি বিরোধী বিভিন্ন অভিযানে নেতৃত্ব দিয়ে প্রশংসিত হন।

পুলিশ কর্মকর্তারা মনে করেন, বাবুল আক্তারের জঙ্গিবিরোধী কার্যক্রমের প্রতিশোধ নিতেই জঙ্গিরা এ ঘটনা ঘটায়। এরপর থেকেই জঙ্গি বিরোধী অভিযানে আট-ঘাঁট বেঁধে নামে পুলিশ। এর পরে পুলিশের সঙ্গে কথিত বন্দুকযুদ্ধে পাঁচজন সন্দেহভাজন জঙ্গি নিহত হয়।

গত বৃহস্পতিবার রাতে পুলিশ সদর দপ্তর থেকে সংবাদ বিজ্ঞপ্তি দিয়ে সাতদিনের জঙ্গি বিরোধী বিশেষ অভিযানের ঘোষণা দেওয়া হয়। শুরুর দিনই গত শুক্রবার সকালে পাবনার হেমায়েতপুরে শ্রীশ্রী ঠাকুর অনুকূল চন্দ্র সৎসঙ্গ সেবাশ্রমের সেবক নিত্যরঞ্জন পান্ডেকে (৬২) কুপিয়ে হত্যা করা হয়।

পুলিশ সদর দপ্তরের হিসেব অনুযায়ী তিন দিনে মোট গ্রেপ্তার আট হাজার ৫৩২ জন। এদের মধ্যে ৫ হাজার ৯৩৫ জন পরোয়ানাভূক্ত আসামি, ১ হাজার ৫২৭ জন নিয়মিত মামলার আসামি, ৯০৯ জন মাদকসহ আর ৭৯ জন অস্ত্রসহ গ্রেপ্তার হয়েছে।

জঙ্গিবাদ বিষয়ক বিশ্লেষক আইন ও সালিস কেন্দ্রের নির্বাহী পরিচালক (ভারপ্রাপ্ত) নূর খান বেনারকে বলেন, “জঙ্গি কায়দায় হত্যার পরে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পক্ষ থেকে যে বক্তব্য আসছে তাতে অনেক ক্ষেত্রে সুষ্ঠু তদন্ত বাধাগ্রস্ত হতে পারে। সুস্পষ্ট প্রমাণ ছাড়া কাউকে গ্রেপ্তার করা উচিত নয়”। তাঁর মতে, এভাবে গণগ্রেপ্তার করে জঙ্গিবাদ নির্মূল করা যাবে না।

তবে তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু বেনারকে বলেন, “সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টির জন্য দুর্বৃত্তরা সাধারণ মানুষ ও সংখ্যালঘুদের হত্যা করছে। এটা প্রতিরোধ করতে গিয়ে নিরীহ কেউ হয়রানীর মুখে পড়ার কথা নয়। তারপরও কেউ পরিস্থিতির শিকার হলে আদালতে ছাড়া পাবেন’’। এ প্রসঙ্গে মন্ত্রী বলেন, সাম্প্রতিক সময়ে জঙ্গি অভিযোগে আটক হওয়া কয়েকশ ব্যক্তি ছাড়া পেয়েছেন। এটাই প্রমাণ করে কেউ নিরপরাধ হলে তাঁর শাস্তি হবে না।

অভিযান নিয়ে প্রশ্ন, বাকযুদ্ধ

জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান অধ্যাপক মিজানুর রহমান এভাবে ঢালাও গ্রেপ্তারের সমালোচনা করে গত শনিবার একটি জাতীয় পত্রিকাকে দেওয়া সাক্ষাতকারে বলেন, “চট্টগ্রামে পুলিশ সুপারের স্ত্রী খুন হওয়ার পরে পুলিশ সম্পর্কে সাধারণ মানুষের একটা সহানুভূতি সৃষ্টি হয়েছে। মানুষ পুলিশের পাশে এসে দাঁড়িয়েছিল। এই গ্রেপ্তার সাধারণ মানুষের মধ্যে গ্রহণযোগ্যতা হারাচ্ছে, মানবাধিকার লঙ্ঘনেরও ঘটনা ঘটছে।”

“এভাবে গণগ্রেপ্তার হওয়ার ফলে গ্রেপ্তার-বাণিজ্যেরও আশঙ্কা রয়েছে,” বলেন মিজানুর রহমান।

এই বক্তব্যের জবাবে গত রোববার চট্টগ্রামের এক সুধী সমাবেশে পুলিশের মহাপরিদর্শক এ কে এম শহীদুল হক বলেন, “উনি না জেনে-বুঝেই মন্তব্য করেন। এটা ঠিক না।”

পরদিন আবার আইজিপির মন্তব্যের জবাবে অধ্যাপক মিজানুর রহমান বলেন, “আইজিপির মন্তব্য অশোভনীয়। তিনি আমার পুরো বক্তব্য না পড়েই মন্তব্য করেছেন।”

গ্রেপ্তার বাণিজ্য হচ্ছে: বিএনপি

এদিকে গ্রেপ্তার-বাণিজ্যের অভিযোগ করেছে বিএনপিও। বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী বলেছেন, সামনের ঈদে পুলিশকে বাণিজ্যের সুযোগ করে দিতে এ অভিযানের আয়োজন করা হয়েছে।

তবে এসব অভিযোগের বিষয়ে গত রোববার আইজিপি সাংবাদিকদের বলেন, “সুনির্দিষ্ট অভিযোগ ছাড়া একটা লোককেও গ্রেপ্তার করা হয়নি। কোনো নিরপরাধ মানুষকে হয়রানি করা হলে আমাকে তথ্য দিন। আমি আমার অফিসারদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেব।”

গ্রেপ্তারই সমাধান নয়: সুলতানা কামাল

এ বিষয়ে যোগাযোগ করা হলে মানবাধিকার কর্মী ও সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা সুলতানা কামাল বেনারকে বলেন, “আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর অপরাধ নিয়ন্ত্রণের বিভিন্ন কৌশল থাকতে পারে। সে কৌশল নিয়ে তারা মাঠে কাজ করবে। কিন্তু এভাবে গ্রেপ্তার তো একমাত্র সমাধান নয়।”

তিনি আরও বলেন, “যারা এ রকম ঘৃণ্যভাবে মানুষ হত্যা করছে তাদের অবশ্যই আইনের আওতায় আনা উচিত। তবে এত ঢালাওভাবে গ্রেপ্তার হলে আশঙ্কা করার যথেষ্ট কারণ থাকে যে নিরীহ মানুষেরাও হয়রানির শিকার হতে পারেন।” তাঁর মতে, এখন আমাদের আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর সামনে সুযোগ এসেছে সাধারণ মানুষের কাছে নিজেদের আস্থা বাড়ানোর। এ জন্য অভিযান হওয়া উচিত সুনির্দিষ্ট তথ্যের ভিত্তিতে।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।