এবার জামায়াতের ধনকুবের যুদ্ধাপরাধী মীর কাসেমের ফাঁসির পালা

ঢাকা থেকে শাহরিয়ার শরীফ
2016.06.06
Meer-Kashem-Ali620.jpg তিন বিচারক মীর কাসেম আলীর মৃত্যু পরোয়ানায় সই করার পর লাল সালুতে মুড়ে তা ট্রাইব্যুনাল থেকে পাঠানো হয় ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে। জুন ৬, ২০১৬।
ফোকাস বাংলা

জামায়াতে ইসলামীর অর্থের অন্যতম যোগানজগা এবং কেন্দ্রীয় নির্বাহী পরিষদের সদস্য মীর কাসেম আলীর মৃত্যুদণ্ড বহালের রায়ের পূর্ণাঙ্গ অনুলিপি প্রকাশের পর পরই গতকাল সোমবার মৃত্যু পরোয়ানা জারি করেছে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল। এর মধ্য দিয়ে তাঁর ফাঁসি কার্যকরের প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে।

সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ রায় ঘোষণার প্রায় তিন মাস পর গতকাল দুপুরে বিচারকেরা ২৪৪ পৃষ্ঠার সেই রায়ে সই করেন । এরপর বিকেলে ওই রায়ের অনুলিপি আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে পাঠানো হয়।

মুক্তিযুদ্ধকালীন চট্টগ্রামে কিশোর মুক্তিযোদ্ধা জসিম উদ্দিন আহমেদকে খুনের দায়ে  মীর কাসেম আলীর মৃত্যুদণ্ড বহালের রায় আসে সর্বোচ্চ আদালত থেকে। নৃশংসতার জন্য একাত্তরে মীর কাসেমের পরিচয় হয় ‘বাঙালি খান’।

প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহার নেতৃত্বে পাঁচ সদস্যের আপিল বেঞ্চ গত ৮ মার্চ এই রায়ের সংক্ষিপ্তসার জানিয়ে দিয়েছিলেন, পূর্ণাঙ্গ রায় এল গতকাল।

“তিন বিচারক সন্ধ্যা পৌনে ৭টার দিকে আসামির মৃত্যু পরোয়ানায় সই করেছেন। এরপর লাল সালুতে মুড়ে এই মৃত্যু পরোয়ানা ট্রাইব্যুনাল থেকে পাঠানো হয় ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে,” বেনারকে জানান ট্রাইব্যুনালের রেজিস্ট্রার মো. শহীদুল আলম ঝিনুক।

“আমরা মীর কাসেমের মৃত্যু পরোয়ানা হাতে পেয়েছি। এটা গাজীপুরের কাশিমপুর কারাগারে পাঠানো হবে,” বেনারকে জানান ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে জেলার মোহাম্মদ নেছার আলম।

মীর কাসেম আলী ওই কারাগারের কনডেম সেলে আছেন। মৃত্যু পরোয়ানা হাতে পেলে আসামিকে তা পড়ে শোনাবে কারা কর্তৃপক্ষ।

অবশ্য দণ্ড কার্যকরের আগে আপিলের রায় পুনর্বিবেচনার আবেদন করার সুযোগ পাবেন যুদ্ধাপরাধী মীর কাসেম। রিভিউ খারিজ হলে রাষ্ট্রপতির কাছে প্রাণভিক্ষা চাইতে পারবেন তিনি। তার আগে আসামির সঙ্গে দেখা করার সুযোগ পাবেন পরিবারের সদস্যরা।

অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম রায় প্রকাশের পর সাংবাদিকদের বলেন, “এই রায়ের সত্যায়িত অনুলিপি আসামিপক্ষ নিয়ে ১৫ দিনের ভেতর রিভিউ পিটিশন দায়ের করতে পারবে। রিভিউ পিটিশনের রায়ের ওপরই নির্ভর করবে দণ্ড কার্যকরের বিষয়টি।”

নিয়ম অনুযায়ী, আসামিপক্ষ রিভিউ আবেদন করলে তার নিষ্পত্তি হওয়ার আগে দণ্ড কার্যকর করা যাবে না।

মীর কাসেমের ছেলে ব্যারিস্টার মীর আহম্মেদ বিন কাসেম সাংবাদিকদের বলেন, “আমরা পূর্ণাঙ্গ রায় হাতে পাওয়ার পর রিভিউ আবেদন করার প্রস্তুতি নেব।”

কে এই কাসেম আলী?

২০১২ সালের ১৯ জুন ট্রাইব্যুনালে জামিনের আবেদন করেছিলেন কাসেম আলী। এতে তিনি নিজেকে সফল ও সম্মানিত ব্যবসায়ী হিসেবে উল্লেখ করেন। ওই নথি অনুসারে, মীর কাসেম কেয়ারি লিমিটেডের চেয়ারম্যান ও পরিচালক, দিগন্ত করপোরেশনের চেয়ারম্যান ও পরিচালক, ইবনে সিনা ট্রাস্টের প্রতিষ্ঠাতা ট্রাস্টি, ফুয়াদ আল-খতিব চ্যারিটি ফাউন্ডেশনের সদস্য সচিব, এগ্রো ইন্ডাস্ট্রিয়াল ট্রাস্টের চেয়ারম্যান, ইসলামী ব্যাংক ফাউন্ডেশনে সদস্য সচিব, সোসাইটি ফর ইন্টারন্যাশনাল ডেভেলপমেন্টের (এসআইডি) সদস্য, ইবনে সিনা ফার্মাসিউটিক্যালস ইন্ডাস্ট্রিজের পরিচালক, মাল্টিপারপাস ওয়েলফেয়ার এজেন্সি সমিতির চেয়ারম্যান, শিল্পপতি ও ব্যবসায়ী কল্যাণ ফাউন্ডেশনের ভাইস চেয়ারম্যান।

এর আগে অ্যাটর্নি জেনারেল যুক্তি উপস্থাপনের শুরুতে আদালতকে বলেছিলেন, মীর কাসেম জামায়াতের অর্থের সবচেয়ে বড় যোগানদাতা। তিনি আরও বলেন, মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারকে বানচাল করতে সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টির জন্য যুক্তরাষ্ট্রের একটি লবিস্ট ফার্মকে (ক্যাসিডি অ্যান্ড অ্যাসোসিয়েটস) কাসেম ২৫ মিলিয়ন মার্কিন ডলার দেন। আসামিপক্ষ এই অভিযোগকে ভিত্তিহীন ও প্রমাণিত নয় বলে উল্লেখ করেছে।

মীর কাসেমের অপরাধ

মীর কাসেমের নেতৃত্ব ও দিকনির্দেশনায় মুক্তিযুদ্ধকালে চট্টগ্রাম শহরের আন্দরকিল্লা এলাকার ডালিম হোটেলে স্থাপিত হয় আলবদর বাহিনীর ক্যাম্প ও নির্যাতনকেন্দ্র। এই হোটেলকে কেন্দ্র করেই আবর্তিত হতো সব ধরনের মানবতাবিরোধী অপরাধ, যার তত্ত্বাবধানে ছিলেন মীর কাসেম। এ কারণে ডালিম হোটেল মানুষের কাছে পরিচিতি পায় হত্যাপুরী হিসেবে।

মীর কাসেম ছিলেন গুপ্তঘাতক আলবদর বাহিনীর চট্টগ্রাম অঞ্চলের প্রধান । তিনি ১৯৭০ সালে চট্টগ্রাম সরকারি কলেজ শাখা ইসলামী ছাত্রসংঘের সভাপতি হন।

একাত্তরের ২৫ মার্চ থেকে ৬ নভেম্বর পর্যন্ত তিনি চট্টগ্রাম শহর শাখা ছাত্রসংঘের সভাপতি ছিলেন। ৭ নভেম্বর তিনি পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রসংঘের সাধারণ সম্পাদক হন। স্বাধীনতার পর ১৯৭৭ সালে ইসলামী ছাত্রসংঘ নাম বদলে ইসলামী ছাত্রশিবির নামে আত্মপ্রকাশ করলে মীর কাসেম এর প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি হন।

১৯৮০ সালে তিনি রাবেতা আল-আলম আল-ইসলামী নামের একটি বিদেশি বেসরকারি সংস্থার এ দেশীয় পরিচালক হন। তিনি দিগন্ত মিডিয়া করপোরেশনের চেয়ারম্যান। এই কর্পোরেশনের আওতায় রয়েছে নয়াদিগন্ত পত্রিকা এবং দিগন্ত টেলিভিশন। যদিও দিগন্ত টেলিভিশনের সম্প্রচার বন্ধ করে দিয়েছে বর্তমান সরকার।

উল্লেখ্য, মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে এ পর্যন্ত পাঁচজনের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়েছে।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।