টিকে থাকার জন্য নিজেদের মধ্যে বিবাহ প্রথা চালু করেছে জঙ্গি গোষ্ঠী

বেনার নিউজ স্টাফ,ওয়াশিংটন ডিসি
2016.09.30
20160816-JMB-Women1000.jpg জঙ্গিবাদে সম্পৃক্ততার সন্দেহে সাম্প্রতিক সময়ে বেশ কয়েকজন নারী সদস্যকে গ্রেপ্তার করেছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। আগস্ট ১৬,২০১৬।
ফোকাস বাংলা

এক দশকেরও বেশি সময় ধরে বাংলাদেশে নৃশংসতা চালানো একটি জঙ্গি গোষ্ঠী টিকে থাকার জন্য নিজেদের মধ্যে বিয়ের প্রথা চালু করেছে। সম্প্রতি এই গোষ্ঠীর একজন সদস্য বেনার নিউজকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে এমনটিই জানিয়েছেন।

গোষ্ঠীর একজন সদস্য খাদেম জানিয়েছেন, নিরাপদ স্থানে অবস্থান করার জন্য জামায়াতুল মুজাহিদীন বাংলাদেশের (জেএমবি) শীর্ষস্থানীয় নেতারা চারটি পর্যন্ত বিয়ে করতে পারেন।

এমনকি জেএমবি সদস্যরা নিজেদের স্ত্রীর জন্য একজন স্বামী প্রস্তুত রাখেন যাতে বিধবা হলে তারা সংগঠনটিরই কারও সঙ্গে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হতে পারেন।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে একজন খাদেম বেনারকে বলেন, “আমরা জানি যে আমাদের যেকোনো সময় মেরে ফেলা হতে পারে। তাই আমাদের সদস্যরা তাদের স্ত্রীর জন্য একজন স্বামী প্রস্তুত রাখেন।”

তিনি বলেন, “যেমন মনে করেন, জনাব ক এবং জনাবা খ স্বামী-স্ত্রী। জনাব ক জনাব গ এর সঙ্গে তার স্ত্রীকে পরবর্তী স্বামী হিসেবে পরিচয় করিয়ে দেবেন। জনাব ক যদি পুলিশি বা অন্য কোন অভিযানে নিহত হন তবেই জনাবা খ জনাব গ কে বিয়ে করতে পারবেন। জনাবা খ ও এই সিদ্ধান্ত মেনে নেন।”

যদি ওই স্ত্রী এমন শর্ত মেনে না নেন তবে তিনি গোষ্ঠীর কোন গোপনীয়তা প্রকাশ করবেন না, এমন শর্তে গোষ্ঠী থেকে বেরিয়ে যেতে পারেন।

তিনি বলেন, “তথ্য ফাঁস করলে তা খুবই কঠোরভাবে দেখা হয়। কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রেই আমাদের নারী সদস্যরা আগে থেকে প্রস্তুত থাকা স্বামীকে বিয়ে করে গোষ্ঠীর মধ্যেই থেকে যান।”

টাঙ্গাইলের মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্রিমিনলজি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক রুকসানা সিদ্দিকা বলেন, উগ্র মতাদর্শে জড়িয়ে পড়া নারীর সংখ্যা কত তা অজানা। তবে বাংলাদেশের সামাজিক পরিস্থিতি তাদের উগ্রবাদে জড়িয়ে পড়তে সহায়তা করছে বলে মন্তব্য করেন তিনি।

সিদ্দিকা বলেন, “আমাদের নারীরা বাধ্য ও অনুগত। তারা পুরুষদের দ্বারা যেমন বাবা, ভাই, ছেলে এবং স্বামী দ্বারা অতিমাত্রায় প্রভাবিত। একজন বোন সহজাতভাবেই তার ভাইকে বিশ্বাস করেন। একজন নারী জঙ্গি হয়ে ওঠে যখন তাকে তার বড় ভাই বা স্বামী, যাকে সে খুবই বিশ্বাস করে সে তাকে জঙ্গিবাদে উদ্বুদ্ধ করে।”

তিনি বলেন, বাংলাদেশের তরুণী ও যুবতীরা তার পারিপার্শ্বিকতা যেমন কলেজের পরিবেশ দ্বারাও প্রভাবিত হতে পারে।

“যেমন ধরেন, কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন ছাত্র জঙ্গিবাদের দিকে ঝুঁকে পড়ে যখন সে দেখে যাদের সঙ্গে সে একই কক্ষে থাকে তাদের সবাই ইসলামের নামে জঙ্গিবাদকে সমর্থন করছে”, বেনারকে বলেন সিদ্দিকা।

সময়ে সময়ে স্থান পরিবর্তন

পুলিশ বলছে, এ বছর আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী অন্তত ১৭ জন নারী জঙ্গিকে গ্রেপ্তার করেছেন। এদের মধ্যে তিনজন ছিলেন আততায়ী দলের সদস্য।

খাদেম বলেন, “আমি আপনাকে এই মুহূর্তে আমাদের নারী সদস্যদের সঠিক সংখ্যাটি বলতে পারছি না। তবে চার বছর পূর্বে ৬৪টি জেলার প্রতিটিতেই গড়ে ১০০ জন করে নারী সদস্য ছিল।”

তিনি বলেন, সাম্প্রতিক জঙ্গিবাদ বিরোধী অভিযান সংগঠনের কার্যক্রমকে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে এবং জেএমবিকে তার বিবাহ প্রথা পুনর্নির্ধারিত করতে বাধ্য করেছে।

তিনি বলেন, “আমাদের নিজেদের অবস্থান খুবই দ্রুত পরিবর্তন করতে হয়। গোয়েন্দা সংস্থার লোকজন অত্যন্ত সক্রিয় হওয়ায় হোটেল ও গেস্ট হাউজগুলোতে অবস্থান করা বিপজ্জনক। তাই আমরা নতুন এই কৌশল নিয়েছি।”

সংগঠনে একজন ব্যক্তির গুরুত্ব অনুযায়ী বিভিন্ন জায়গায় অবস্থানের জন্য জেএমবি এখন চারজন পর্যন্ত নারীকে বিয়ের অনুমতি দিচ্ছে।

খাদেম বলেন, “স্বামী অন্য জায়গায় কাজ করে এবং কিছুদিন পর পর আসবে এমনটা বলে আমাদের নারী সদস্যরা বাড়ি ভাড়া নেয়। এইভাবে আমাদের সৈনিকরা নিরাপদ বাড়িতে থেকে তাদের অভিযান চালাতে পারে।”

বাড়ি ভাড়া এবং অন্যান্য খরচের জন্য অর্থ যোগান জেএমবিই দিয়ে থাকে।

খাদেম জানান, জঙ্গিরা জন্ম নিয়ন্ত্রণ ও গর্ভপাত বিরোধী। কিন্তু গর্ভধারণের হার অত্যন্ত কম। যদি কেউ গর্ভধারণ করে সেক্ষেত্রে সংগঠন বাচ্চার খরচও বহন করে।

কার্যক্রম গোপন রাখার স্বার্থে

২০০৪ সালের আগস্টে দেশের ৬৪টি জেলায় একযোগে বোমা হামলার মধ্য দিয়ে জেএমবি আলোচনায় আসে। ২০০৭ সালে সংগঠনটির শীর্ষ নেতাদের ফাঁসি কার্যকর এবং একের পর এক অভিযানের পরও সংগঠনটি সক্রিয় রয়েছে।

বর্তমানে সংগঠনটির সবচেয়ে সক্রিয় অংশ যেটি ‘নব্য জেএমবি’ হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে, এরা ইসলামিক স্টেটেরে আদর্শে অনুপ্রাণিত। এই অংশটিই বাংলাদেশের মাটিতে প্রথম আন্তর্জাতিক জঙ্গি হামলা করে। ১ জুলাই ঢাকার গুলশানের হলি আর্টিজান রেস্তোরাঁয় ওই হামলায় ২৯ জন নিহত হয়।

বাংলাদেশ পুলিশের কাউন্টার টেরোরিজম ইউনিটের প্রধান মনিরুল ইসলাম জেএমবির নতুন বিয়ে প্রথার বিষয়টি স্বীকার করেন। বেনারকে তিনি বলেন, “তারা নিজেদের কার্যক্রম গোপন রাখার স্বার্থে নিজেদের মধ্যে বিয়ে করে। দম্পতিরা সংগঠন থেকে অর্থ পেয়ে থাকে বলে আমাদের কাছে খবর আছে।”

নিরাপত্তা বিশ্লেষক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) সাখাওয়াত হোসেন বেনারকে বলেন, “নিজেদের কার্যক্রম গোপন রাখার জন্যই জঙ্গিরা নিজেদের মধ্যে বিয়ে করে। কারণ তারা বাইরে বিয়ে করলে তাদের কার্যক্রম ফাঁস হয়ে যাবে।”

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, গত ৭ সেপ্টেম্বর র‍্যাব দুটি জেএমবি দম্পতিকে গ্রেপ্তার করে। এর মধ্য দিয়ে গোষ্ঠীর মধ্যে বিয়ের কৌশলের অন্যান্য দিকও উন্মোচিত হয়।

র‍্যাবের সংবাদ বিজ্ঞপ্তি অনুযায়ী, দুই দম্পতির মধ্যে একটি দম্পতির স্ত্রী তার স্বামীর চেয়ে অনেক বেশি শিক্ষিত। উদ্ভিদবিজ্ঞানে ওই স্ত্রীর একটি উচ্চতর ডিগ্রি রয়েছে।

র‍্যাবের মুখপাত্র মুফতি মাহমুদ খান বেনারকে বলেন, “সংগঠনই (জেএমবি) তাদের বিয়ে ঠিক করে দিয়েছিল। উচ্চ শিক্ষিত নাহিদা সুলতানা সংগঠনের সিদ্ধান্ত অনুযায়ীই অষ্টম শ্রেণি পাশ করতে না পারা আমিনুলকে বিয়ে করে।”

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।