সব ধর্মের পক্ষ থেকে সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদ বর্জনের আহ্বান
2016.04.29
চাপাতির আঘাতে কয়েকটি নিষ্ঠুর হত্যার বর্ণনা দিয়ে সংখ্যাগরিষ্ঠ সুন্নি ও সংখ্যালঘু শিয়া মুসলিম, হিন্দু, খ্রিষ্টান ও বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের প্রতিনিধিত্বকারী ধর্মীয় নেতারা এগুলো ‘অগ্রহণযোগ্য’ বলে মত দিয়েছেন। এর পাশাপাশি জঙ্গিবাদ ও সন্ত্রাসবাদ দমনে তাঁরা ঐক্যবদ্ধ প্রতিরোধের ডাক দিয়েছেন।
গত বৃহস্পতিবার রাজধানীর কৃষিবিদ ইনস্টিটিউশনের সম্মেলনকক্ষে ‘ধর্মীয় সম্প্রীতি সম্মেলন’-এ বিভিন্ন ধর্মের ধর্মীয় নেতারা এ ডাক দেন। বাংলাদেশ পুলিশ এই সম্মেলনের আয়োজন করে।
ইসলাম, হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিষ্টানসহ সব ধর্মের নেতারা সম্মেলনে অংশ নেন। তাঁরা বলেছেন, এ দেশে ধর্মীয় উগ্রবাদকে কখনোই ঘাঁটি গাড়তে দেওয়া হবে না। বাংলাদেশ থেকে জঙ্গিবাদ নির্মূল করতে হবে।
আলোচনায় উঠে এল, দেশটিতে এক ধর্মে বিশ্বাসীর সঙ্গে আরেক ধর্মের বিশ্বাসীর বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হওয়ার মতো হাজার বছরের ঐতিহ্য থাকার দৃষ্টান্ত।
দেশের বিভিন্ন স্থানে একের পর এক হামলা চালিয়ে ছাত্র, শিক্ষক, প্রকাশক, সংস্কৃতিকর্মীদের হত্যা করা হচ্ছে। দায় স্বীকার করে এসব হত্যাকাণ্ডের অনেকগুলোতেই বিবৃতি দিয়েছে মধ্যপ্রাচ্যভিত্তিক জঙ্গিগোষ্ঠী আইএস। এসব ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশ পুলিশের পক্ষ থেকে এ সম্মেলন আয়োজন করা হয়।
চলতি এপ্রিল মাসেই অন্তত পাঁচজন চাপাতির আঘাতে মৃত্যু বরণ করেছেন। সর্বশেষ গত সোমবার জোড়া খুনের শিকার হন, দেশের প্রথম সমকামী পত্রিকার সম্পাদক জুলহাস মান্নান ও তাঁর বন্ধু নাট্যকর্মী মাহবুব রাব্বি তনয়।
প্রথমবারের মতো অনুষ্ঠিত এই ‘ধর্মীয় সম্প্রীতি সম্মেলন’ চরমপন্থীদের শক্তিশালী বার্তা দিয়ে বলেছে, বাংলাদেশে জঙ্গিদের কোনো স্থান নেই।
সম্মেলনের প্রধান অতিথি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বলেন, “আমরা জঙ্গিদের হুমকি মোকাবিলায় বিভাগীয়, জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে এ জাতীয় সম্মেলন আয়োজন করব।”
তিনি বলেন, “ইসলাম কখনোই হত্যা, লুটপাট, ধ্বংসযজ্ঞ ও নির্যাতন সমর্থন করে না। আমরা ধর্মে বিশ্বাসী বা অবিশ্বাসী নির্বিশেষে সকল নাগরিকের নিরাপত্তা নিশ্চিত করব।”
মৌলবাদ নিন্দনীয়
পুলিশের মহাপরিদর্শক এ কে এম শহিদুল হক সম্মেলনে সভাপতিত্ব করেন। তিনি বলেন, জঙ্গি হামলাকারীদের ৮০ শতাংশ ইতিমধ্যে গ্রেপ্তার হয়েছে। অধিকাংশ মামলায় জঙ্গিরা স্বীকার করেছে যে, তারা তাদের নেতাদের মাধ্যমে মগজ ধোলাইয়ের শিকার হয়েছে এবং তারা এখন অনুতপ্ত।
তিনি সম্মেলনে অংশগ্রহণকারীদের উদ্দেশ্যে বলেন, “ইসলামের শান্তিপূর্ণ বার্তা ছড়িয়ে দিতে আপনাদের সহযোগিতা আমাদের প্রয়োজন।”
শোলাকিয়া ঈদগাহের ইমাম মাওলানা ফরিদ উদ্দিন মাসউদ সম্মেলনে বলেছেন, যারা চরমপন্থী শিষ্য তৈরি করে তাদেরও এসব হামলার জন্য দায়ী করতে হবে। তিনি বলেন, “একজন ধর্মীয় নেতা হিসেবে আমি যদি বলি যে, ওই ব্যক্তিকে হত্যা করলে তুমি বেহেশতে যাবে, তবে একজন সাধারণ মানুষ এমন কাজ করতে পারে। অতএব এই সাধারণ মানুষ কোনো সমস্যা নয়; সমস্যা তারাই যারা ইসলামের অপব্যাখ্যা দিয়ে তাঁদের চরমপন্থী হিসেবে গড়ে তুলছে।”
ওই চিন্তাবিদ আরও বলেন, এক লাখ ইসলামি চিন্তাবিদদের স্বাক্ষর সংগ্রহের একটি প্রচারাভিযান অব্যাহত আছে, যেখানে তাঁরা ধর্মীয় চরমপন্থা, সহিংসতা এবং সংখ্যালঘু নির্যাতনের নিন্দা করেছেন।
জনাব মাসউদ চরমপন্থীদের উদ্দেশ্যে বলেন, “তারা ইসলামের সবচেয়ে বড় শত্রু। তারা ইসলাম ধর্মকে সন্ত্রাস ও বর্বরতার ধর্ম হিসেবে চিত্রিত করছে। আমরা হাজার বছর ধরে ধর্মীয় সম্প্রীতি বজায় রেখে আসছি। এটা যে কোনো মূল্যে রক্ষা করতে হবে।”
বিভিন্ন ধর্মের একই বিশ্বাস
আন্তর্জাতিক কৃষ্ণ চেতনা সমাজের সভাপতি সত্য রঞ্জন বাড়ৈ অনুষ্ঠানে বলেন, বাংলাদেশের জনগণকে সংখ্যালঘুদের ওপর সহিংসতা মোকাবিলায় এগিয়ে আসতে হবে।
ঢাকার আর্চবিশপ প্যাট্রিক ডি রোজারিও বলেন, “বাংলাদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ বরাবরই শান্তিকামী ছিল। তবে সম্প্রতি সংখ্যালঘুদের ওপর আক্রমণগুলি ছিল, একটি সাদা কাগজের ওপর ছোট্ট একটি কাল দাগের মতো। আমরা সবাই কাগজের সাদা অংশটি বিবেচনায় না এনে শুধু কাগজের কাল দাগটি নিয়েই কথা বলি। আর এটাই আমাদের সমস্যা।” তিনি আরও বলেন, “আমাদের মধ্যে হাজার বছর ধরে দৃঢ় ধর্মীয় সম্প্রীতি বিদ্যমান ছিল। এটা আমাদের রক্ষা করতে হবে।”
তিনি স্মৃতিচারণ করে বলেন, “২৫ বছর আগে আমি গ্রামের বাড়ি পরিদর্শনে গিয়েছিলাম। দেখলাম, প্রায় দুই মাইল সড়কজুড়ে আমাকে অভ্যর্থনা জানাতে বড় বড় গেট বানানো হয়েছে। অথচ ওই এলাকায় কোনো খ্রিষ্টান বসবাস করতেন না।”
প্যাট্রিক ডি রোজারিও বলেন,“তবে কারা সেদিন আমার জন্য গেইটগুলি বানিয়েছিল? আমার মুসলিম ভাইয়েরা, আমার হিন্দু ভাইয়েরাই এগুলো বানিয়েছিলেন।” আন্তঃবিশ্বাসীয় সংলাপ তৃণমূল পর্যায়ে ধর্মীয় সম্প্রীতি বজায় রাখতে সাহায্য করবে বলে মনে করেন ওই ধর্মীয় নেতা।
বাংলাদেশে বৌদ্ধ কৃষ্টি প্রচার সংঘের সভাপতি ভদন্ত সংঘনায়ক শুদ্ধানন্দ মহাথিরো বলেন, “আসুন আমরা ধর্মীয় সম্প্রীতি রক্ষার লক্ষ্যে নিজেদের মধ্যে আলোচনা করি, তবেই দূরত্ব ঘুচবে।” তিনি আরও বলেন, ঘৃণা কিংবা সহিংসতা নয়, সব ধর্মই ভালোবাসা ও সম্প্রীতির কথা প্রচার করে।
ইসলামি শিক্ষাকেন্দ্রের অধ্যক্ষ ও শিয়া নেতা সৈয়দ ইব্রাহীম খলিল রাজভি বলেন, যেসব জঙ্গিরা গত বছর শিয়া মসজিদ ও শিয়া মিছিলে হামলা চালিয়েছিল, তারা দেশের ভাবমূর্তি কলঙ্কিত করেছে।
“আসুন আমরা এ ধরনের ইসলাম বিরোধী কার্যক্রম প্রতিহত করতে আমাদের হাত একত্রিত করি। তা ছাড়া দুর্বৃত্তদের অবশই শাস্তি হওয়া উচিত, যাতে অন্যরা এমন অপরাধ করতে সাহস না পায়,” বলেন ওই শিয়া নেতা।
রামকৃষ্ণ মঠ ও মিশনের অধ্যক্ষ শ্রীমৎ স্বামী ধ্রুবেশানন্দজি বলেন, “নিজ ধর্মে নিষ্ঠা রেখে অন্য সব ধর্মে শ্রদ্ধা দেখানোই ধর্মের মূল কথা। এ কাজটি সঠিকভাবে করলেই আর কোনো ভেদাভেদ থাকে না।”