নিজামীর ফাঁসি কার্যকর

ঢাকা থেকে জেসমিন পাপড়ি
2016.05.10
Share on WhatsApp
Share on WhatsApp
160510-BD-nizami-execution-620.jpg জামায়াত নেতা মতিউর রহমান নিজামীর ফাঁসি কার্যকর হওয়ার আগে বিচিত্র পোশাক পরে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের সামনে প্লাকার্ড হাতে মুক্তিযোদ্ধাদের অবস্থান। মে ১০, ২০১৬।
ফোকাস বাংলা

সাড়ে চার দশক আগে মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে আলবদর নেতা ও জামায়াত ইসলামের আমীর মাওলানা মতিউর রহমান নিজামীর(৭৩)মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়েছে। তিনিসহ জামায়াতের চার বড় নেতার ফাঁসি কার্যকর হওয়ার পর দলটিতে শীর্ষ নেতা বলে কেউ আর থাকছেন না।

জামায়াতের আরেক শীর্ষ নেতা দেলওয়ার হোসাইন সাঈদী যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত হয়ে কারাগারে আছেন। ফলে পুরানো ও প্রবীণ নেতৃত্ব থেকে জামায়াত নবীন ও নতুন নেতৃত্বের মাধ্যমে পরিচালিত হবে। এর মধ্যে যুদ্ধাপরাধীদের দল হিসেবে জামায়াত নিষিদ্ধের একটি প্রস্তাব বিবেচনার কথা জানিয়েছেন আইনমন্ত্রী আনিসুল হক।

দুইদিন নাটকীয় পরিস্থিতির পর মঙ্গলবার রাত ১২ টা ১০ মিনিটে শীর্ষ জামায়াত নেতা নিজামীকে ফাঁসির রশিতে ঝুলিয়ে হত্যা করা হয়। পুলিশের মহাপরিদর্শক এ কে এম শহীদুল হক ওই সময়ে ফাঁসি কার্যকর হওয়ার কথা গণমাধ্যমকে জানান।

এরপর রাতেই মরদেহ কড়া পুলিশ পাহারায় গ্রামের বাড়ি পাবনার সাঁথিয়ায় পাঠানো হয়। সেখানেই তাঁকে দাফন করার যাবতীয় প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছে।

ফাঁসি কার্যকরের সঙ্গে সঙ্গে উল্লাসে ফেটে পড়েন মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষের বিভিন্ন শ্রেণি ও পেশার মানুষ। অনেকেই স্মৃতিচারণ করেন ২০০১ সালে বিএনপিজামায়াত জোট সরকারের সময় শিল্পমন্ত্রী হিসেবে নিজামীর গাড়িতে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা ওড়ার কথা। ট্রাইব্যুনালও রায়ে বলেছিলেন, তাঁকে মন্ত্রী করার মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধের ৩০ লাখ শহীদ ও দুই লাখ নির্যাতিত নারীকে অবমাননা করা হয়।

মঙ্গলবার দিনভর ফাঁসির তোড়জোড়ের মধ্যেই রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদের কাছে নিজামীর প্রাণ ভিক্ষার আবেদন করার শেষ সুযোগ ছিল। তবে তিনি রাষ্ট্রপতির কাছে প্রাণভিক্ষার আবেদন করেননি বলে রাত আটটার দিকে গণমাধ্যমকে নিশ্চিত করেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন কামাল।

সরকারের আদেশ পেয়ে রাতে ‘শেষ সাক্ষাতের’ জন্য নিজামীর স্বজনদের ডেকে পাঠানো হয়। শিশুসহ ২৪ জন আত্মীয়–স্বজন সন্ধ্যার পরপরই কারাগারে প্রবেশ করেন। সাক্ষাৎ​ শেষে প্রায় দেড় ঘণ্টা পর তারা কারগার থেকে বের হয়ে আসেন।

এসময় তারা সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলতে চাননি। তবে নিজামীর ভাতিজি পরিচয় দিয়ে সাংবাদিকদের কাছে একজন নারী জানান, “উনি নামাজ শেষ করেছেন। সবার সঙ্গে কথা বলেন।সবাইকে শক্ত থাকতে বলেন।”

এর আগে সকাল থেকে ফাঁসির আদেশ কার্যকরের বিষয়ে কয়েক দফা বৈঠক করেন কারা কর্তৃপক্ষ ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা। বিকেলে নিজামীর দণ্ড কার্যকরে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের আদেশ কারাগারে পৌঁছে। তখন থেকেই কারাফটক এলাকায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তৎপরতা বেড়ে যায়। কয়েক স্তরের নিরাপত্তা দিয়ে ঢেকে ফেলা হয় পুরো এলাকা। সন্ধ্যার পর রাজধানী ঢাকায় বিজিবি মোতায়েন করা হয়।

ফাঁসি কার্যকরের জন্য কাশিমপুর কারাগার থেকে জল্লাদ রাজুকে কেন্দ্রীয় কারাগারে আনা হয় মঙ্গলবার বিকেলে। এর মধ্যে সোমবার থেকে কয়েক ধাপে নিজামীর শারীরিক অবস্থা পরীক্ষা করেন কারা চিকিৎসক।

একাত্তরে বুদ্ধিজীবী হত্যার পরিকল্পনা, নির্দেশনা ও নেতৃত্ব দেওয়া,  হত্যা, গণহত্যা ও ধর্ষণসহ  নানা অপরাধে ২০১৪ সালের ২৯ অক্টোবর একাত্তরের আলবদর নেতা নিজামীকে মৃত্যুদণ্ডের আদেশ দেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল। মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানি বাহিনীর সহযোগী কিলিং স্কোয়াড আলবদর বাহিনীর সর্বোচ্চ নেতা নিজামী সে রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করেন।

চলতি বছরের ৬ জানুয়ারি মৃত্যুদণ্ড বহাল রাখার আদেশ দেন আপিল বিভাগ। গত ৫ মে সে রায় পুনর্বিবেচনায় নিজামীর করা আবেদনও খারিজ হয়ে যায়। এর মাধ্যমে শেষ হয় সকল আইনি প্রক্রিয়া। সোমবার ওই রায় প্রকাশের পর তার মৃত্যুদণ্ড কার্যকরের প্রক্রিয়া শুরু হয়।

নিজামীর ফাঁসি কার্যকর হওয়ার আগে ও পরে শাহবাগে অবস্থান নেয় যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে গড়ে ওঠা গণজাগরণ মঞ্চের কর্মীরা। শীর্ষ যুদ্ধাপরাধীর ফাঁসির সংবাদের প্রতিক্রিয়ায় গণজাগরণ মঞ্চের মুখপাত্র ইমরান এইচ সরকার বেনারকে বলেন, “এটি ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ সময়। দেশের ১৬ কোটি মানুষ সাড়ে চার দশকেরও বেশি সময় ধরে এই দিনটির জন্য অপেক্ষা করছেন।”

তাঁর মতে, নিজামীর ফাঁসির রায় বাস্তবায়নের মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় দেশ গড়ার স্বপ্ন আরও এক ধাপ এগিয়ে গেল। কিছুটা হলেও শান্তি পেলো বুদ্ধিজীবীদের আত্মা।

নিজামীর মামলার রাষ্ট্রপক্ষের সাক্ষী মুক্তিযোদ্ধা রুস্তুম আলী বেনারকে বলেন, “বুদ্ধিজীবী হত্যার জন্য প্রধান দায়ী ছিল আল বদর বাহিনী। আর সে বাহিনীর প্রধান ছিলেন মতিউর রহমান নিজামী। এদের কাজ ছিল বুদ্ধিজীবীদের চিহ্নিত করে হত্যা করা। ৪৫ বছর পরে হলেও সেই ঘৃণ্য শীর্ষ যুদ্ধাপরাধীর ফাঁসি কার্যকর হয়েছে।”

মুক্তিযুদ্ধে বীর প্রতিক খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধা লে. জে.(অব.) এম হারুন অর রশিদ বলেন, “এতোদিন পর হলেও সত্যের জয় হয়েছে, ঘাতকের শাস্তি হয়েছে।”

এদিকে নিজামীর ফাঁসিকে সামনে রেখে প্রধান বিচারপতি ও কারা মহাপরিদর্শকের গ্রামের বাড়িতেও নিরাপত্তা জোরদার করা হয়। তবে মামলার সরকার পক্ষের সাক্ষীদের নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেন সংশ্লিষ্টরা।

এ বিষয়ে হারুণ অর রশিদ বেনারকে বলেন, “৪৫ বছর পর যুদ্ধাপরাধের বিচার হচ্ছে। এই সময়ের মধ্যে সমাজে এসব যুদ্ধাপরাধীদের অনেক শাখা প্রশাখা ছড়িয়েছে। অনেক জঙ্গি, দুষ্কৃতিকারী দল সৃষ্টি হয়েছে। তারা যেকোনো সময় সাক্ষীদের ক্ষতি করতে পারে। তাই রাষ্ট্রকে এই সাহসী ব্যক্তিদের নিরাপত্তা দিতে হবে।”

একাত্তরে মানবতাবিরোধী অপরাধে এ পর্যন্ত মোট পাঁচজনের ফাঁসি কার্যকর করা হয়েছে। এর মধ্যে চারজন জামায়াতে ইসলামীর এবং একজন বিএনপির।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।