গভীর সংকটে নার্সিং পেশা,শিক্ষিত নার্সের সংখ্যা অপর্যাপ্ত
2016.04.29
“এই ওয়ার্ডের বেশিরভাগ রোগীর বেলা দুটায় ওষুধ বা ইনজেকশন পাওয়ার কথা। কিন্তু এটা দেওয়া শুরু করি দুপুর ১২টা থেকে।নইলে শেষ রোগীর কাছে পৌঁছাতে বিকেল চারটা বাজবে,” ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ক্যাজুয়ালটি ওয়ার্ডের একজন নার্স বলছিলেন এ কথা।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ওই নার্স বলেন, শুধু ওষুধ বা ইনজেকশন নয়, রোগীর কখন কি হয় তা খেয়াল রাখতে হয় তাঁকেই।
দেশের এই শীর্ষ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে একজন নার্সের ওপর ৩০ থেকে ৩৫ জন রোগীর ভার। রোগী সামলাতে হিমশিম খাচ্ছেন সেখানকার নার্সরা।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার শর্ত অনুযায়ী, একজন চিকিৎসকের বিপরীতে কমপক্ষে তিনজন নার্স থাকার কথা। কিন্তু আছেন একজন।
বাংলাদেশে সেবা খাতে ৬৫ হাজার ৭৬৭ জন চিকিৎসকের বিপরীতে আছেন ৩৩ হাজার ১৮৩ জন নার্স। থাকার কথা ১ লাখ ৯৭ হাজার ৩০১ জন।
নার্সিং পরিদপ্তরের তথ্য মতে, এই মুহূর্তে তিন হাজার পদ শূন্য। আর বেকার নার্সের সংখ্যা নয় হাজার।
সাধারণ রোগীদের সেবার জন্য যেকোনো নার্সই যথেষ্ট। কিন্তু জটিল বা বিশেষ ধরনের রোগে ভোগা মানুষের জন্য প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত নার্স দরকার। সেই সংকট আরও ব্যাপক।
বাংলাদেশ নার্সিং কাউন্সিলের তথ্যমতে, ১২৩টি নার্সিং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এবং দেশের সব হাসপাতাল ও ক্লিনিকে কর্মরত নার্সদের মধ্যে মনোরোগ সেবাদানকারী নার্সের সংখ্যা ৮২ জন, চোখের রোগীদের জন্য ৩১, শিশু রোগীদের জন্য ৬০, হৃদরোগের জন্য ১৯৭ জন এবং বক্ষব্যাধিতে ৪৩ জন নার্স আছেন।
স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ মন্ত্রণালয় সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে ১০ হাজার নার্স নিয়োগের প্রক্রিয়া শুরু করেছে। কিন্তু নানা জটিলতায় সে প্রক্রিয়ায় খুব একটা গতি নেই।
তবে স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের নার্সিং বিভাগের দায়িত্বে থাকা যুগ্ম সচিব গৌতম আইচ সরকার বেনারকে বলেছেন, “হাসপাতালে নার্সদের সংখ্যাই শুধু বাড়ানোর চেষ্টা হচ্ছে না, মানসম্মত নার্স নিয়োগের চেষ্টা করছি আমরা।”
পেশায় নানামুখী সংকট, বিরোধ তুঙ্গে
বাংলাদেশে ২০০৮ সাল পর্যন্ত যে কোনো বিভাগ থেকে এসএসসি বা এইচএসসি পাসের পর তিন বছর লেখাপড়া করে ডিপ্লোমা ডিগ্রি পেতেন নার্সেরা।
২০০৮ সাল থেকে ডিপ্লোমা কোর্সের পাশাপাশি বিএসসি কোর্স চালু হয়।বিজ্ঞান বিভাগ থেকে এইচএসসি পাসের পর চার বছর লেখাপড়া করে নার্সরা বিএসসি কোর্স করছেন। বিএসসি কোর্সে অংশ নিচ্ছেন অপেক্ষাকৃত মেধাবীরা।
চাকরির ক্ষেত্রে ডিপ্লোমা ও বিএসসি নার্সদের মধ্যে বিরোধ এখন তুঙ্গে। নিজেদের মধ্যে বিভক্তির কারণে ঝুলে গেছে নিয়োগ প্রক্রিয়াও।
ডিপ্লোমা নার্সরা চাইছেন সরকারি চাকরিতে ঢোকার বয়স সীমা শিথিল করা হোক এবং পরীক্ষা ছাড়াই ব্যাচভিত্তিক নিয়োগ হোক। এই দাবিতে গত কয়েক সপ্তাহ ধরে তাঁদের ধারাবাহিক আন্দোলন চলছে।
“ডিপ্লোমা নার্সদের মধ্যে ১৩ তম ব্যাচের চাকরি হয়নি, কিন্তু ২০ তম ব্যাচ পাস করে বসে আছে। জ্যেষ্ঠতার বিচারে নিয়োগ না হলে অস্থিরতা দেখা দেবে,” বেনারকে জানান বাংলাদেশ ডিপ্লোমা নার্সেস অ্যাসোসিয়েশনের যুগ্ম মহাসচিব মো. আসাদুজ্জামান।
অন্যদিকে বাংলাদেশ বেসিক গ্র্যাজুয়েট নার্সেস অ্যাসোসিয়েশনের মুখপাত্র অসীম কুমার দে বেনারকে বলছেন, “আমরা চাই মেধার ভিত্তিতে নিয়োগ হোক। এর আগেও ২০১৩ সালের দিকে একবার বয়স সীমা শিথিল করে নিয়োগ দিয়েছিল মন্ত্রণালয়। তাতে মেধাবীরা পিছিয়ে পড়েছিল।”
মন্ত্রণালয় সূত্র বলছে, সরকার বয়সসীমা শিথিলের সিদ্ধান্ত নিলেও সরকারী কর্মকমিশন পরীক্ষা নিতে চাইছে। ২০১২ সালে তৃতীয় শ্রেণি থেকে নার্সদের পদমর্যাদা দ্বিতীয় শ্রেণিতে উন্নীত করা হয়।
শিক্ষকের অভাবে পড়ালেখা ব্যাহত
২০০৯ সালের ১২ জুলাই বেসরকারি পর্যায়ে নার্সিং প্রতিষ্ঠান স্থাপন ও নার্সিং কোর্স চালু করতে নীতিমালা করে সরকার। নীতিমালায় সর্বক্ষণিক বিষয়ভিত্তিক নার্স, শিক্ষক ও কর্মচারী নিয়োগের বাধ্যবাধকতা আছে।
নার্সিং কাউন্সিল ও সেবা পরিদপ্তরের কর্মকর্তারা নিশ্চিত করেছেন, নীতিমালার প্রয়োগ সরকারি-বেসরকারি কোনো প্রতিষ্ঠানেই নেই।
দেশে এখন ১২৩টি নার্সিং কলেজ ও ইনস্টিটিউট। সরকারি খাতের ৫৩টি প্রতিষ্ঠানে ৩৬৬টি পদের ২৩২টিই শূন্য।
সেবা পরিদপ্তরের ভারপ্রাপ্ত পরিচালক নিলোফার ফরহাদ বলেন, “এখন ১৯৭৭ সালের নিয়োগবিধির ওপর চলছে নার্সিং পেশায় নিয়োগ। নতুন নিয়োগবিধি আমরা মন্ত্রণালয়ে জমা দিয়েছি। এটি কার্যকর হলে সমস্যার সমাধান হবে।”
সরকারি খাতে দেশের নয়টি ও বেসরকারি খাতে ১৮টি নার্সিং কলেজ বিভিন্ন সরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে চার বছরের বিএসসি কোর্স পরিচালনা করছে ২০০৮ সাল থেকে।বিএসসি কোর্সে মোট ৫৩টি বিষয় চার বছরে পড়ানো হয়।বিষয়ভিত্তিক শিক্ষক নেই বললেই চলে।
ঢাকা নার্সিং কলেজে এ মুহূর্তে ছাত্রসংখ্যা ৪০০।শিক্ষকের নিয়মিত পদে আছেন জাসিন্তা অলিম্পিয়া গোমেজ নামের একজন শিক্ষক। এর বাইরে অধ্যক্ষসহ আরও যে ২০ জন শিক্ষক আছেন, তাঁদের প্রত্যেকে হাসপাতালের সিনিয়র স্টাফ নার্স।
শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, যাঁরা নার্সিং পড়ছেন তাঁদের এমবিবিএস কোর্সের শিক্ষার্থীদের মতো অ্যানাটমি, ফিজিওলজি, মাইক্রোবায়োলজি, ফার্মাকোলজি ও প্যাথোফিজিওলজির মতো মৌলিক বিজ্ঞানের বিষয়গুলো পড়তে হয়। মেডিকেল কলেজগুলোয় এ বিষয়ের শিক্ষকের সংকট রয়েছে।
এর বাইরে সমাজবিজ্ঞান, ইংরেজি, কম্পিউটার বিজ্ঞান ইত্যাদি বিষয় পড়ানোর সরকারি বা বেসরকারি কলেজের শিক্ষকদের ডেকে আনা হয়। সার্বক্ষণিক কোনো শিক্ষক নেই।
মৃতদেহ দেখে শেখার যে সুযোগ এমবিবিএস কোর্সের শিক্ষার্থীরা পাচ্ছেন, সেদিক থেকেও পিছিয়ে আছেন নার্সরা। তৃতীয় বর্ষ থেকে নিয়মিত চিকিৎসকদের সঙ্গে ওয়ার্ডে যাওয়ার কথা থাকলেও সেই সুযোগও তাঁরা সেভাবে পাচ্ছেন না।
অপর্যাপ্ত শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ কাজের ক্ষেত্রে প্রভাব ফেলছে বলে মনে করেন চিকিৎসকেরা।