সব্যসাচী লেখক সৈয়দ শামসুল হকের বিদায়,সাংস্কৃতিক অঙ্গনে শোকের ছায়া
2016.09.27
“আমার আরও বেশ কিছু লেখা বাকি। একটা নাটক, একটা কাব্যগ্রন্থ, দুটো উপন্যাস, আত্মজীবনীর আরও একটি পর্ব।” কিন্তু এসব লেখা শেষ না করেই চলে গেলেন সব্যসাচী লেখক সৈয়দ শামসুল হক, যিনি মৃত্যুকে অগ্রাহ্য করতে চেয়েছিলেন।
যাত্রাশিল্পী অমলেন্দু বিশ্বাস মারা যাওয়ার পর ১৯৮৭ সালে চিরকুটে তিনি লিখেছিলেন, ‘আমাকে তুমি বলার লোক ক্রমশ কমে আসছে।’ এর পরের বছর বিদেশ থেকে বাইপাস অপারেশন করে আসেন।
তখন তিনি বলেছিলেন, এখন চার-পাঁচ বছর বাঁচলেই যথেষ্ট। কিন্তু প্রায় ২৮ বছর তিনি বেঁচে ছিলেন। মঙ্গলবার চলে গেলেন না ফেরার দেশে।
মঙ্গলবার রাতে জাতীয় সংসদ অধিবেশন চলার সময় অনির্ধারিত আলোচনায় দাঁড়িয়ে বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ প্রখ্যাত এই কবির মৃত্যুর কথা আইনসভার সদস্যদের জানান।
তোফায়েল বলেন, “আজ বিকালে সৈয়দ হক মারা গেছেন। আজীবন তিনি মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতার চেতনা বুকে ধারণ করেছেন। যত্নের সঙ্গে তিনি মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষে দায়িত্ব পালন করে গেছেন।”
ফুসফুসের জটিলতা নিয়ে চিকিৎসার জন্য গত এপ্রিলে যুক্তরাজ্য গেলে সৈয়দ হকের ক্যান্সার ধরা পড়ে। লন্ডনের রয়্যাল মার্সডেন হাসপাতালে কিছু দিন চিকিৎসার পর চিকিৎসকরা আশা ছেড়ে দেন। জীবনের বাকি দিনগুলো দেশে কাটানোর জন্য গত ১ সেপ্টেম্বর ফিরে আসেন তিনি।
সৈয়দ হক সৃষ্টিশীলতার জোয়ার তুলে নিজেকে ভাসিয়ে দেন। সময়ের সর্বোচ্চ ব্যবহার করেছেন। লিখে গেছেন কবিতা, গান, ছোটগল্প, নাটক। যতক্ষণ পেরেছেন, লিখেছেন নিজের হাতে। না পারলে মুখে বলে গেছেন। তাঁর স্ত্রী, লেখক-চিকিৎসক আনোয়ারা সৈয়দ হক, টুকে রেখেছেন কাগজে।
সাহিত্যের সব ক্ষেত্রে বিচরণ করা সৈয়দ হকের বয়স হয়েছিল ৮১ বছর। মৃত্যুকালে তিনি স্ত্রী আনোয়ারা সৈয়দ হক এবং এক ছেলে ও এক মেয়ে রেখে গেছেন।
রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা স্বাধীনতা পুরস্কার, একুশে পদক ও বাংলা একাডেমি পুরস্কারজয়ী এই লেখকের মৃত্যুতে শোক জানিয়েছেন। গত ১০ সেপ্টেম্বর হাসপাতালে তাঁকে দেখে এসে তাঁর চিকিৎসার পুরো ব্যয়ভার নেওয়ার ঘোষণা দেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
বিশিষ্ট এই নাগরিকের মৃত্যুর খবর প্রচারের সঙ্গে সঙ্গে দেশের সাংস্কৃতিক অঙ্গনে শোকের ছায়া নেমে আসে। স্বাধীনতা সংগ্রাম ও স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে সক্রিয় সৈয়দ হকের শোকে মুহ্যমান রাজনীতিক ও সাংস্কৃতিক অঙ্গনের ব্যক্তিরা ছুটে যান হাসপাতালে।
হাসপাতালে থাকা সংস্কৃতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূর কান্নায় ভেঙে পড়েন। নূরলদীনের সারাজীবনসহ এই নাট্যকারের অনেক নাটকে অভিনয় করেন তিনি।
ইউনাইটেড হাসপাতাল থেকে কবির মরদেহ গুলশানে তার বাসা ‘মঞ্জু বাড়ি’তে নেওয়া হয়। স্ত্রী আনোয়ারার ডাক নামে এই বাড়ির নাম।
মৃত্যুর তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় অমরত্বের ব্যাখ্যা দিয়ে কবি মুহম্মদ নূরুল হুদা বেনারকে বলেন, “সমকালীন বাংলা কবিতা ও বহুমাত্রিক সৃষ্টিশীলতার এক সর্বাগ্রগণ্য কারুকৃৎ কবিশ্রেষ্ঠ সৈয়দ শামসুল হক এখন খেকে চিরজীবিত।”
বৈশাখে রচিত পংক্তিমালা, পরাণের গহীন ভেতর, নাভিমূলে ভস্মাধার, আমার শহর ঢাকা, বেজান শহরের জন্য কেরাম, বৃষ্টি ও জলের কবিতা—এসব কাব্যগ্রন্থের অজস্র কবিতা জনপ্রিয়তা এনে দেয় তাঁকে।
ঈর্ষণীয় সফলতা পায় তাঁর লেখা নূরলদীনের সারাজীবন, পায়ের আওয়াজ পাওয়া যায়, গণনায়ক, ঈর্ষা ইত্যাদি নাটক। ‘আয়না বিবির পালা’সহ ৫০টির বেশি উপন্যাস এসেছে তাঁর হাত দিয়ে।
সেই ১৯৩৫ সালের ২৭ ডিসেম্বর কুড়িগ্রামে জন্ম নিয়েছিলেন যে সৈয়দ শামসুল হক, তাঁর মধ্যে জেগে উঠল আরও ভিন্নতর এক তৃষ্ণা—সাহিত্যের বেদনা। তরুণ বয়সে বাবাকে হারিয়ে মা হালিমা খাতুনকে সঙ্গে নিয়ে এলেন নবীন রাজধানী ঢাকায়। নতুন এক ইতিহাসের ভেতর অভিষেক ঘটেছিল তাঁর।
১৯৫১ সালে বাড়ি থেকে পালিয়ে চলে গিয়েছিলেন চলচ্চিত্র নগরী ভারতের বোম্বেতে। দেশে ফেরেন ১৯৫২ সালে। ঢাকার চলচ্চিত্রের উন্মেষের যুগে হয়ে পড়লেন এক স্বপ্নদলের সঙ্গী।
মাটির পাহাড় নামে একটি সিনেমা হবে—তার গান লিখলেন কবি শামসুর রাহমান, সংগীত পরিচালনায় সমর দাশ, আর চিত্রনাট্য লিখলেন সৈয়দ হক। এরপরও জড়িয়ে থাকলেন আরও কত ছবির কাহিনি, চিত্রনাট্য আর গান রচনায়।
“মৌলবাদ ও অসাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে হক ভাই ছিলেন একজন যোদ্ধা। আমরা ছিলাম তাঁর সৈনিক,” বেনারকে জানান কবি মুহাম্মদ সামাদ। তাঁর মতে, বাংলা সাহিত্য সৈয়দ হকের নাম মুছে ফেলতে পারবে না।
বুধবার সকাল ১০টায় কবির মরদেহ নেওয়া হবে বাংলা একাডেমিতে। সেখানে শ্রদ্ধা জানানোর পর ১১টায় মরদেহ কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে রাখা হবে সর্বস্তরের মানুষের শ্রদ্ধা জানানোর জন্য।
দুপুরে জোহরের নামাজের পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় মসজিদে জানাজার পর কুড়িগ্রামে নিজের জমিতে কবিকে সমাহিত করা হবে।
‘হায়রে মানুষ রঙিন ফানুস, দম ফুরাইলে ঠুস’—প্রায় তিন যুগ আগে এই গানটি লিখেছিলেন সৈয়দ শামসুল হক। ১৯৮২ সালে মুক্তি পাওয়ার ‘বড় ভালো লোক ছিল’ চলচ্চিত্রের এই গানটি এখনও মানুষের মুখে মুখে ফেরে।
“তাঁকে হারানোর এই শূন্যতা পূরণ হবার নয়। বাংলা সাহিত্যে এমন প্রতিভাবান লেখক আর কবে আসবে, কে জানে?” বেনারকে বলেন বিশিষ্ট নাট্যব্যক্তিত্ব মামুনুর রশীদ।