ইউপি চেয়ারম্যান হত্যার অভিযোগে কথিত ‘বন্দুকযুদ্ধে’ নিহত দুই যুবক
2016.06.14
দেশের উত্তরাঞ্চলের জেলা জয়পুরহাটে সদ্য অনুষ্ঠিত ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে বিজয়ী এক চেয়ারম্যানকে কুপিয়ে আহত করার পর গত রোববার তিনি মারা গেছেন। এই হত্যা মামলার দুই আসামী পুলিশের সঙ্গে কথিত ‘বন্দুকযুদ্ধে’ গতকাল মঙ্গলবার নিহত হয়েছেন।
গত ৪ জুন রাতে জয়পুরহাট সদর উপজেলার দুর্গাদহ বাজার থেকে মোটরসাইকেলে করে কোঁচকুঁড়ি গ্রামে বাড়ি ফেরার পথে একদল মুখোশধারী ভাদসা ইউনিয়নের নবনির্বাচিত চেয়ারম্যান এ কে আজাদকে কুপিয়ে ও গুলি করে আহত করে।
আট দিন চিকিৎসাধীন থাকার পর রোববার ঢাকার একটি হাসপাতালে মারা যান আজাদ। তাঁকে হত্যার অভিযোগে পুলিশের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে নিহত হন দুজন।
এরা হলেন উপজেলার ছাওয়ালপাড়া গ্রামের নুরুল ইসলামের ছেলে সোহেল হোসেন (২৫) এবং কুচকুড়ি গ্রামের লুৎফর রহমানের ছেলে মুনির হোসেন (২৮)।
মঙ্গলবার ভোর রাতে এই গোলাগুলির এ ঘটনা ঘটে।
“নিহতদের বিরুদ্ধে চেয়ারম্যান আজাদ হত্যা ছা্ড়াও ছিনতাই, চাঁদাবাজিসহ বিভিন্ন ধরনের অপরাধে জড়িত থাকার অভিযোগ রয়েছে,” বেনারকে জানান সহকারী পুলিশ সুপার অশোক কুমার পাল।
তিনি বলেন, সম্প্রতি ‘সন্ত্রাসীদের হাতে’ নিহত সদর উপজেলার ভাদসা ইউপির চেয়ারম্যান এ কে আজাদের বাড়িতে হামলা করতে ‘একদল সন্ত্রাসী’ গোপালপুর গ্রামের মাঠে জড়ো হচ্ছে খবর পেয়ে পুলিশের একটি টহল দল সেখানে যায়।
“এ সময় সন্ত্রাসীরা পুলিশের টহল দলের দিকে গুলি ছুড়লে আত্মরক্ষার জন্য পুলিশও পাল্টা গুলি চালায়। এতে দুই সন্ত্রাসী ঘটনাস্থলেই মারা যায়,” জানান সহকারী পুলিশ সুপার।
পুলিশ ঘটনাস্থল থেকে একটি পিস্তল ও ধারালো অস্ত্র উদ্ধার করেছে পুলিশ। এ ঘটনায় সদর থানার ওসি ফরিদ হোসেনসহ তিন পুলিশ সদস্য আহত হয়েছেন; তাদের প্রাথমিক চিকিৎসা দেওয়া হয়েছে।
জয়পুরহাট জেলা আধুনিক হাসপাতাল মর্গে মুনিরুজ্জামানের মৃতদেহ নিতে আসা তার চাচা আব্দুস সালাম জানান, গত ৮ জুন রাতে সাদা পোষাকে পুলিশ পরিচয় দিয়ে মুনিরকে ধরে নেওয়া হয়। পরে থানা পুলিশের কাছে খোঁজ নিলে পুলিশ তাকে গ্রেপ্তারের বিষয় অস্বীকার করে।
তিনি আরো জানান, মুনির ভাদসা ইউনিয়নের ৪ নম্বর ওয়ার্ড যুবলীগের সভাপতি ছিলেন। তার বিরুদ্ধে কোন মামলা নেই। পুলিশ তাকে ধরে এনে হত্যা করেছে বলে তিনি দাবি করেন।
নিহত সোহেল হোসেন এর ভগ্নিপতি আক্কেলপুর পৌর এলাকার হাজিপাড়া মহল্লার মহিবুল ইসলাম মর্গে থেকে তার মৃতদেহ নিয়ে যান। তিনি মুঠোফোনে জানান, সোহেল গত ৭ জুন দুপুরের দিকে মঙ্গলবাড়ি বাজারে মাছ বিক্রির টাকা নিতে গিয়ে আর ফেরেনি। থানা-পুলিশ সহ বিভিন্ন জায়গায় খোঁজ নিয়ে তাকে পাওয়া যায়নি।
মঙ্গলবার ভোরে লোকমুখে জানতে পেরেছেন সোহেল বন্দুক যুদ্ধে মারা গেছে। তিনি আরো জানান, সোহেল যুবলীগের রাজনীতির সঙ্গে দীর্ঘদিন থেকে জড়িত ছিল। তবে কোন কমিটিতে ছিল কি-না তা জানা নেই।
নিহতের বড় ভাই মুকুল মাস্টার স্থানীয় সাংবাদিকদের জানান, আওয়ামী লীগের মনোনয়ন না পেয়ে স্বতন্ত্র প্রার্থী হন আজাদ (৫৩)।৩১ মার্চ অনুষ্ঠিত ভোটে জয়ী হয়ে তিনি চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন।গত ২৯ মে শপথ নিলেও দায়িত্ব বুঝে নেওয়ার আগেই তাঁকে হত্যা করা হলো।
আজাদ হামলার শিকার হওয়ার পরদিন তাঁর ছোট ভাই এনামুল হক ছয়জনের নাম উল্লেখ করে সদর থানায় মামলা করেন। সোহেল ও মুনির দুজনই ওই মামলায় আসামি বলে থানা পুলিশের তথ্য।
মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) তথ্য অনুযায়ী, গত বছর আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সঙ্গে কথিত বন্দুকযুদ্ধে বা ‘ক্রসফায়ারে’ মোট ১৯২ জনের মৃত্যু হয়েছে।
এ ধরনের ঘটনাকে ‘বিচারবহির্ভূত হত্যা’ হিসেবে চিহ্নিত করে সরকার ও আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সমালোচনা করে আসছে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠনগুলো।
“আমরা কোনোভাবেই বিচারবহির্ভূত হত্যাকে সমর্থন করি না। একজন নির্বাচিত ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যানকে হত্যা করাটা দুঃখজনক। কিন্তু অপরাধ প্রমাণ না হলে কাউকে ক্রসফায়ারের নামে হত্যাও করা যায় না,” বেনারকে জানান সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ও মানবাধিকারকর্মী সুলতানা কামাল।
তাঁর মতে, এভাবে খুনের বদলে খুন সমাজে স্থিতিশীলতা আনতে পারে না। এর বদলে প্রয়োজন আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা, মামলার সুষ্ঠু তদন্ত ও বিচার।