বিশেষ অভিযানের প্রথম দিনেই প্রায় এক হাজার গ্রেপ্তার
2016.06.10
জঙ্গি দমনে সাঁড়াশি অভিযানের প্রথম দিনে সারাদেশে প্রায় এক হাজার সন্দেহভাজন ব্যক্তি ও আসামীকে আটক করেছে আইনশৃঙ্খলাবাহিনী। এদের মধ্যে জামায়াত-শিবিরের কর্মীসহ বিভিন্ন মামলার পলাতক আসামিও রয়েছে।
পুলিশের এই অভিযানের মধ্যে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ সাতক্ষীরায় চরমপন্থী সংগঠনের নেতা মোজাফফর নিহত হয়েছে। গত সোমবার থেকে শুক্রবার পর্যন্ত পুলিশের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে নিহতের সংখ্যা দাঁড়ালো নয়জন। এঁদের মধ্যে সন্দেহভাজন জঙ্গি পাঁচজন।
শুক্রবার ভোর থেকে শুরু হওয়া এই সাঁড়াশি অভিযান আগামী সাত দিন চলবে বলে জানিয়েছে পুলিশ সদরদপ্তর।এই অভিযানে পুলিশের পাশাপাশি র্যাব এবং বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ—বিজিবি অংশ নিচ্ছে।
দেশে একের পর এক সন্ত্রাসী হামলায় বিভিন্ন শ্রেণি, পেশা ও ধর্মের প্রায় অর্ধশত মানুষ নিহত হওয়া এবং চট্টগ্রামে পুলিশ কর্মকর্তা বাবুল আক্তারের স্ত্রী মাহমুদা খানমকে হত্যার পরিপ্রেক্ষিতে বৃহস্পতিবার পুলিশের মহাপরিদর্শক এ কে এম শহীদুল হক এই অভিযানের ঘোষণা দেন।
গ্রেপ্তার প্রায় এক হাজার
প্রথম দিনের অভিযান শেষে পুলিশের পক্ষ থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে আটকৃতদের সংখ্যা জানানো হয়নি। তবে পুলিশ সদর দপ্তরের এক কর্মকর্তাকে উদ্ধৃত করে বিবিসি বাংলা জানিয়েছে, এই অভিযান শুরু করার পর এ পর্যন্ত অন্তত ৯০০ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
তবে বার্তা সংস্থা ইউএনবির খবরে বলা হয়েছে, শুক্রবার বিএনপি-জামায়াতের নেতা-কর্মীসহ সারা দেশে ৬১২ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়। এর মধ্যে রাজধানী ঢাকায় গ্রেপ্তার হয়েছেন ১৭৭ জন।
এদিকে স্থানীয় সাংবাদিকদের মাধ্যমে বিভিন্ন জেলা থেকে পাওয়া তথ্যে আটকৃতদের সংখ্যা সম্পর্কে একটি ধারণা পাওয়া গেছে। এই সংখ্যা প্রায় এক হাজারের কাছাকাছি। এদের মধ্যে ঝিনাইদহে ২৭ জন, দিনাজপুরে ১০০, কুষ্টিয়ায় ৬৭, সাতক্ষীরায় ৩৫, রাজশাহীতে ৩৪, মাগুরায় ২৪, টাঙ্গাইলে ৬৮, ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় ৩১, পঞ্চগড়ে ২৬, শেরপুরে ২৪ এবং সিলেটে ৬১ জনকে আটক করার খবর পাওয়া গেছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক পুলিশের একটি সূত্র বলছে, চলমান অভিযানে আটকের সংখ্যা প্রতিমুহুর্তে বাড়ছে। অভিযান শেষের আগে সুনির্দিষ্ট সংখ্যা বলা যাচ্ছে না। তবে সংখ্যাটি এক হাজারের কাছাকাছি হবে। শনিবার দুপুরের আগে পুলিশ আনুষ্ঠানিকভাবে এ–সংক্রান্ত তথ্য প্রকাশ করতে পারে বলে বেনারকে জানান পুলিশের গণমাধ্যম শাখার একজন কর্মকর্তা।
‘বন্দুকযুদ্ধে’ চরমপন্থী নেতা নিহত
সাতক্ষীরার তালা উপজেলায় পুলিশের সঙ্গে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ মোজাফফর সানার নামে এক ব্যক্তি নিহত হয়েছে। পুলিশের দাবি, মোজাফফর চরমপন্থী সংগঠন পূর্ব বাংলার কমিউনিস্ট পার্টির আঞ্চলিক নেতা।
গতকাল বৃহস্পতিবার দিবাগত রাত আড়াইটার দিকে উপজেলার মাগুরা ইউনিয়নের চারা বটতলায় এ ঘটনা ঘটে।
পুলিশ জানায়, তার বিরুদ্ধে সাতক্ষীরা ও নওগাঁ জেলার বিভিন্ন থানায় হত্যা, ডাকাতি, ছিনতাই, অস্ত্র আইন ও চাঁদাবাজির অভিযোগে ১৮টি মামলা রয়েছে।
সাতক্ষীরা জেলা পুলিশের সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়, তালা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) ছগির মিয়ার নেতৃত্বে পুলিশের একটি দল গতকাল বিশেষ অভিযান পরিচালনা করছিলেন। রাত আড়াইটার দিকে মাগুরা বাজার থেকে জেঠুয়ার দিকে একটি মোটরসাইকেল আসতে দেখে থামার সংকেত দেওয়া হয়।
এ সময় মোটরসাইকেল আরোহীরা পুলিশকে লক্ষ্য করে পরপর দুটি বোমার বিস্ফোরণ ঘটায় ও গুলি ছোড়ে। পুলিশও পাল্টা গুলি ছোড়ে। এতে মোজাফফর আহত হয়। দুজন সন্ত্রাসী মোটরসাইকেল ফেলে পালিয়ে যায়। তালা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের কর্তব্যরত চিকিৎসক আহত মোজাফফরকে মৃত ঘোষণা করেন।
পুলিশের অভিযানের পক্ষে–বিপক্ষে
ঘোষণা দিয়ে অভিযানের নামে পুলিশের এমন গ্রেপ্তারের সমালোচনা করছেন মানবাধিকার কর্মীরা।
প্রধান বিরোধী দল বিএনপি এই অভিযানের উদ্দেশ্য নিয়ে সংশয় প্রকাশ করে এর মাধ্যমে বিরোধীদের ওপর দমন-পীড়নের আশঙ্কা প্রকাশ করেছে।
আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী এই সাঁড়াশি অভিযানের নামে সরকারবিরোধীদের ওপর দমন ও পীড়ন চালাবে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছে বিএনপি।
একে ‘জনগণের আন্দোলনকে দমিয়ে রাখতে সরকারের একটি কৌশল’ হিসেবে উল্লেখ করে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, “এই সাঁড়াশি অভিযানের অজুহাতে আবারও আইনশৃঙ্খলা বাহিনী বিরোধী দলের ওপর চড়াও হবে।”
শুক্রবার সকালে নির্বাচনী সংঘাতে আহত গাইবান্ধার বিএনপি নেতা আজিজুর রহমানকে ঢাকার একটি হাসপাতালে তিনি সাংবাদিকদের সঙ্গে এসব কথা বলেন।
এদিকে অভিযানের নামে নির্বিচারে শত শত মানুষ আটক হওয়ার সমালোচনা করছেন মানবাধিকার কর্মীরা।
এ প্রসঙ্গে আইন ও শালিস কেন্দ্রের ভারপ্রাপ্ত নির্বাহী পরিচালক মো. নূর খান বেনারকে বলেন, “বাংলাদেশে বর্তমান যে প্রেক্ষাপট বিরাজ করছে, একের পর এক হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হচ্ছে, আনসার আল ইসলাম বা আইএস দায় স্বীকার করছে—এমন পরিস্থিতিতে আইনশৃ্ঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী অভিযান পরিচালনা করবে এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু এত ব্যাপক গ্রেপ্তার অস্বাভাবিক।”
সন্দেভাজন হিসেবে গ্রেপ্তার নিয়ে বাণিজ্যে হওয়ার সম্ভাবনা থাকে—এ কথা উল্লেখ করে এই মানবাধিকার কর্মী বলেন, “আজকের বাস্তবতা বিবেচনায় রেখে অভিযান পরিচালনা করতে হবে। তবে গণতান্ত্রিক সমাজে আইনের মধ্য থেকেই সবকিছু পরিচালিত হওয়া উচিত।”
অপরাধী ধরতে ঘোষণা দিয়ে অভিযান পরিচালনার সমালোচনা করে তিনি বলেন, “এর ফলে মূল অপরাধীরা সজাগ হয়ে ওঠে। তারা পালিয়ে যাওয়ার সুযোগও পায়।”
সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের নেতারা অবশ্য পুলিশের এই অভিযানের পক্ষে। সাবেক রাষ্ট্রদূত এবং বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের নেতা নিম চন্দ্র ভৌমিক বেনারকে বলেন, সংখ্যালঘুসহ সাধারণ মানুষের নিরাপত্তায় এমন অভিযান অনিবার্য হয়ে উঠেছিল। তাই এই অভিযানকে স্বাগত জানাই।
তিনি বলেন, “আমরা নিরাপত্তা চাই। এটা যেন লোক দেখানো অভিযান না হয়। মানবাধিকার সমুন্নত রেখে যে কোনও উপায়ে দুর্বৃত্তদের গ্রেপ্তার ও শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে।”