‘রোহিঙ্গা’ পরিচয়েই মিয়ানমারে ফিরতে চায় শরণার্থীরা
2016.05.23
মিয়ানমারে গণতন্ত্র ফিরে আসায় এবং গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত সরকার ক্ষমতা নেওয়ার পর বাংলাদেশে অবৈধভাবে বসবাসকারী রোহিঙ্গাদের মধ্যে নিজ দেশে ফিরে যাওয়ার আকাঙ্ক্ষা প্রবল হয়ে উঠেছে। এই দাবিতে গত শুক্রবার কক্সবাজারের নয়াপাড়া শরণার্থী ক্যাম্পের সামনে বিক্ষোভ করেছেন শতাধিক রোহিঙ্গা শরণার্থী।
তবে রোহিঙ্গা ইস্যু সমাধানে ‘সময়’ চেয়েছেন মিয়ানমারের গণতন্ত্রপন্থি নেতা বর্তমান পররাষ্ট্রমন্ত্রী অং সান সু চি। গত রোববার যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী জন কেরির সঙ্গে বৈঠকের পর রাজধানী নে পি দোতে এক যৌথ সংবাদ সম্মেলনে সু চি এ কথা বলেন।রয়টার্স ও বিবিসির প্রতিবেদনে উল্লেখ করা তথ্য অনুযায়ী, বৈঠকে কেরি মিয়ানমারের নেতাকে দেশটির মানবাধিকার পরিস্থিতি উন্নয়নের দিকে জোর দেওয়ার আহ্বান জানান।
অং সান সু চির সঙ্গে বৈঠকের পর যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী কেরি জানান, ওই নেত্রীর সঙ্গে তিনি ‘খুব স্পর্শকাতর’ ও ‘বিরোধপূর্ণ’ রোহিঙ্গা ইস্যু নিয়ে কথা বলেছেন।কেরি বলেন, “আমি জানি এটি এখানে তীব্র আবেগের কারণ হয়। সমস্যাগুলো কীভাবে সমাধান করা হবে তা নির্ধারণ করা বেশ জটিল। এর মধ্যেই মানবাধিকার নিশ্চিত করতে হবে এবং রাখাইন রাজ্যসহ মিয়ানমারে যারাই বসবাস করেন সবার সুবিধার দিকে নজর দিতে হবে।”
জন কেরির সঙ্গে অং সান সু চির বৈঠকের পর শুক্রবার নয়াপাড়া শরণার্থী ক্যাম্পের সামনে বিক্ষোভ হয়। রেডিও ফ্রি এশিয়ার প্রতিবেদনে একথা বলা হয়, যেটি বেনার নিউজের সহযোগী সংগঠন।
রেডিও ফ্রি এশিয়ার প্রতিবেদনে বলা হয়, বিক্ষোভকারীরা রোহিঙ্গা পরিচয়ে মিয়ানমারে ফিরে যাওয়ার দাবি জানায়, যেটি বৌদ্ধ অধ্যুষিত মিয়ানমারে একটি স্পর্শকাতর বিষয়।
“আমরা মিয়ানমারে জন্মগ্রহণ করেছি। কিন্তু পরিস্থিতির শিকার হয়ে বাংলাদেশে এসেছি। শরণার্থী ক্যাম্পের জীবন আমাদের কাম্য নয়। এ জন্য অং সান সুচির কাছে আমাদের অনুরোধ তিনি যেন আমাদের জন্য কিছু করেন,” রেডিও ফ্রি এশিয়াকে জানান নয়াপাড়া ক্যাম্প স্কুলের প্রধান শিক্ষক শাহ আলম।
ওই শিক্ষক বলেন, রোহিঙ্গা পরিচয় বাদ দিয়ে তাঁরা মিয়ানমারের নাগরিক হতে চান না। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, মিয়ানমার যদি রোহিঙ্গা হিসাবে তাঁদের গ্রহণ করতে রাজি না হয়, তাহলে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় ও সংস্থার সহায়তা চাওয়া ছাড়া তাদের সামনে আর বিকল্প কোনো উপায় নেই।
রোহিঙ্গারা বাংলাদেশের নাগরিক মর্মে মিয়ানমারের দাবির ভিত্তি নেই—এ কথা উল্লেখ করে শাহ আলম বলেন, “রোহিঙ্গারা হাজার বছর ধরে মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের আরাকানে বসবাস করছে। এ কারণে আমাদের মিয়ানমারে রোহিঙ্গা হিসেবে বসবাস করার অধিকার রয়েছে।”
ফেরত পাঠানোর দাবি
কক্সবাজারের বিভিন্ন নাগরিক সংগঠন অবৈধভাবে আসা এই রোহিঙ্গাদের চিহ্নিত করে ফেরত পাঠানোর দাবিতে আন্দোলন করছে।
এই আন্দোলনের একজন সংগঠক নূর মোহাম্মদ শিকদার বেনারকে বলেছেন, “এদের বিরুদ্ধে প্রশাসন মাঝেমধ্যে অভিযান চালালেও খুব একটা লাভ হয় না। অনেক জায়গায় রোহিঙ্গারা প্রভাবশালী হয়ে উঠছে। এদের অনেকের বিরুদ্ধে মাদক পাচার, চুরি, ডাকাতিসহ বিভিন্ন ধরনের অপরাধে জড়িত থাকার অভিযোগ রয়েছে।”
গত সপ্তাহে নয়াপাড়া আনসার ক্যাম্পে হামলা চালিয়ে আনসার কমান্ডারকে হত্যা ও অস্ত্র লুটের ঘটনায় রোহিঙ্গাদের নাম এসেছে। এ পর্যন্ত তিনজনকে গ্রেপ্তার দেখানো হয়েছে, যাদের সবাই রোহিঙ্গা।
সমস্যা সমাধানে ‘সময়’ চান সু চি
গেল সপ্তাহে মিয়ানমারের উপর থেকে বেশ কিছু অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিক নিষেধাজ্ঞা তুলে নেয় যুক্তরাষ্ট্র। কিন্তু মানবাধিকার ও সামরিক প্রভাবের বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের আপত্তি থাকায় মূল নিষেধাজ্ঞাগুলো বহাল থাকে।
রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব ও মৌলিক অধিকার দিতে অস্বীকৃতি জানিয়ে আসছে মিয়ানমার। এদের মধ্যে সু চির নিজ দলেরও অনেকে আছেন।
“ক্ষুব্ধতার কারণ হয় এমন শব্দ ব্যবহার সমস্যার শান্তিপূর্ণ ও গ্রহণযোগ্য সমাধানকে খুব কঠিন করে তোলে। সমস্যা সমাধান করার জন্য আমাদের পর্যাপ্ত সময় দেওয়ার আহ্বান জানাচ্ছি,” জানান সু চি।গত সপ্তাহে মিয়ানমারে নিযুক্ত যুক্তরাষ্ট্রের নতুন রাষ্ট্রদূত স্কট মার্শিয়েলকে ‘রোহিঙ্গা’ শব্দটি ব্যবহার না করার পরামর্শ দিয়েছেন সু চি। কেরির সঙ্গে সংবাদ সম্মেলনেও বিষয়টি নিয়ে কথা বলেছেন সু চি।
মিয়ানমারে নিযুক্ত বাংলাদেশের সাবেক রাষ্ট্রদূত অনুপ কুমার চাকমা বেনারকে বলেন, “অং সান সুচির নেতৃত্বে বাংলাদেশে বসবাসরত অবৈধ শরণার্থীদের ফিরিয়ে নেওয়া সম্ভব। ২০০৯ থেকে ২০১৪ পর্যন্ত অনুপ মিয়ানমারে বাংলাদেশে প্রতিনিধিত্ব করেন।
তিনি বলেন, মিয়ানমারে ‘রোহিঙ্গা’ শব্দ নিয়ে প্রচণ্ড আপত্তি আছে। মিয়ানমারের বেশিরভাগ মানুষ তাদের বাংলাদেশে বিশেষ করে চট্টগাম থেকে অবৈধ অনুপ্রবেশকারি বলে মনে করে।“যদি তাঁরা এই শব্দ বা পরিচয় বর্জন করে তাহলে মিয়ানমারের নাগরিকত্ব ফিরে পেতে পারে,” মত দেন অনুপ চাকমা।
রোহিঙ্গাদের ওপর জরিপ শুরু হচ্ছে
দেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলে কক্সবাজার জেলায় মিয়ানমার থেকে অবৈধভাবে আসা রোহিঙ্গাদের তথ্য সংগ্রহের জন্য জরিপ চালানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) স্থানীয় প্রশাসন এবং ইউনিয়ন পরিষদের সহায়তা নিয়ে চলতি সপ্তাহে এই জরিপ শুরু করবে।
মিয়ানমার থেকে বাস্তুভিটা ছেড়ে আসা অনিবন্ধিত রোহিঙ্গাদের সংখ্যা কারও মতে তিন লাখ, আবার কারও মতে চার থেকে পাঁচ লাখ।
“আমরা আশা করছি ২৫ মে থেকে কাজ শুরু করতে পারব। ২ জুন থেকে তথ্য সংগ্রহ করা শুরু হবে, শেষ হবে ১৫ জুনের মধ্যে। আগামী নভেম্বরের মধ্যে এ–সংক্রান্ত প্রতিবেদন প্রকাশ করা সম্ভব হবে,” বেনারকে জানান এই প্রকল্পের পরিচালক আলমগীর হোসেন। এই প্রথম অনিবন্ধিত রোহিঙ্গা শরণার্থীদের জন্য বাংলাদেশ সরকার প্রকল্পটি গ্রহণ করে।
প্রকল্প পরিচালক জানান, মোট চার হাজার দুইশ কর্মী নিয়োগ করা হবে এ–সংক্রান্ত তথ্য উপাত্ত সংগ্রহের জন্য।